কাশ্মীর সংকট বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি!

0 371

ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের সংকট বিভিন্ন সময় নানা দিকে মোড় নিলেও প্রায় ৭০ বছরের পুরনো এই সংকটের জটিলতা ও তীব্রতা মোটেই কমছে না।

সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসনের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করায় এবং সেখানে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়ন বাড়তে থাকার খবর আসায় পাক-ভারত উত্তেজনা ও বাক-যুদ্ধ জোরদার হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কাশ্মির সংকটকে আবারও আন্তর্জাতিক সংকট হিসেবে তুলে ধরে বিশ্ব-সমাজের সমর্থন কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। এ জন্য তিনি কথা বলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও এমনকি সৌদি যুবরাজ ট্রাম্পের সঙ্গেও! যদিও তিনি নিজেও জানেন যে ভারতের বিরুদ্ধে কখনও কঠোর কোনো অবস্থান নেবে না কোনো মার্কিন সরকার। আরব বিশ্ব ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা রাখলেও তা কখনও প্রয়োগ করতে চায়নি কাশ্মির ইস্যুতে।

ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা ওআইসিও মৌখিক নিন্দাবাদ ছাড়া কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার মত অবস্থায় নেই। ইরান কাশ্মির সংকটের বিষয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। ইসলামী এই দেশটি কাশ্মিরি জনগণের অধিকার রক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে।

সম্প্রতি দীর্ঘ ৪৯ বছর পর জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের আলোচনায় উঠে এসেছে জম্মু ও কাশ্মীর ইস্যু। যে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিল পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনও। বৃহত্তর কাশ্মিরের কিছু অংশ রয়েছে চীনের নিয়ন্ত্রণে।

চীন তার নানা প্রভাব খাটিয়ে অন্য নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্য দেশগুলোকে কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-বিরোধী অবস্থানে নিতে চায়। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে রুশ প্রতিনিধি কাশ্মির সমস্যার সমাধানকে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বিষয় বলে উল্লেখ করার পাশাপাশি এও বলেছেন যে, এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের সনদ এবং প্রস্তাবগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। অথচ ভারত কাশ্মির সমস্যার সমাধানে তৃতীয় কোনো পক্ষের ভূমিকার বিরোধী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ইস্যুতে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের সংকটময় অবস্থার প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালের দোসরা জুলাইয়ে স্বাক্ষরিত পাক-ভারত চুক্তিতে দুদেশের সব বিরোধের সুরাহা দ্বিপাক্ষিক সংলাপের মাধ্যমে করতে হবে বলে লেখা রয়েছে। এই চুক্তির আলোকে ভারত কাশ্মির সংকটকে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়ার বিরোধী।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনামল শেষে পাকিস্তান ও ভারত গঠনের সময় শুরু হয় কাশ্মীর সংকট। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও রাজা ছিলেন হিন্দু।  ১৯৪৭ সনে কাশ্মীর ভারতে না পাকিস্তানে যোগ দিবে তা নিয়ে বিরোধের জেরে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে ভারত পরাজয়ের আশঙ্কার মুখে জাতিসংঘে ইস্যুটিকে তোলে। এরিমধ্যে পাকিস্তান কাশ্মিরের প্রায় ৩৫ শতাংশ ও ভারত প্রায় ৬৫ শতাংশ নিজ দখলে রাখতে সক্ষম হয়। জাতিসংঘ কাশ্মীর থেকে প্রথমে পাকিস্তানি সেনা ও পরে ভারতের বেশিরভাগ সেনা সরিয়ে নেয়ার এবং এরপর সেখানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেয় যাতে কাশ্মীরি জনগণই তাদের ভাগ্য নির্ধারণে সক্ষম হয়। কিন্তু পাকিস্তানও সেনা প্রত্যাহার করেনি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুও গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা কখনও পালন করেননি। নেহেরু জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার পর বিদেশ নীতি ও যোগাযোগ ব্যতীত বাকি সব বিষয়ে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়ে সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত করেন। সম্প্রতি মোদি সরকার এই ধারা বাতিল করে।

১৯৫৭ সালে কাশ্মীর আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং দেশটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৭০-এ অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অকাশ্মীরি ভারতীয়দের তথায় ভূমি ক্রয়ের অধিকার হরণ করা হয়। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রপতি দেশটির সংবিধানের ধারা ৩৭০ এবং ৩৫ক অকার্যকর করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা খর্ব করেন। ধারা দু’টি অকার্যকরের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর পৃথক রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হল।

কাশ্মীর শর্তসাপেক্ষে ভারতের সাথে যোগ দেয়ার কারণে শর্তের অনুকূলে ভারতের সংবিধানে অনুচ্ছেদ নং ৩৭০ যুক্ত হয়। ৩৭০ অনুচ্ছেদের কারণে জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণ ভারতের অন্য যেকোনো অংশের জনগণের চেয়ে অধিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। এ অনুচ্ছেদে জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য স্বতন্ত্র সংবিধান ও পতাকা দেয়া হয়। এ অনুচ্ছেদটির বলে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, অর্থ ও যোগাযোগ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং অবশিষ্ট বিষয়গুলো রাজ্যের বিধানসভার অধীন ন্যস্ত করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভার অনুমোদন ছাড়া অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারত না। তবে যুদ্ধ বা বহিঃশক্তির আক্রমণের কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা ছিল।

জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হওয়ার কারণে এবং রাজ্যটি এ যাবতকাল পর্যন্ত বিশেষ সুবিধা ভোগ করায় তথায় মুসলিমদের সংখ্যা কমে যাওয়ার কোনো সঙ্গত কারণ ছিল না। কিন্তু সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৩৭০ ও ৩৫এ বাতিলের কারণে ভারতের অন্য যেকোনো অংশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জম্মু ও কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাবে। আর এ সুযোগটি প্রদানের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী বিজেপি ভবিষ্যতে ভারতের একমাত্র এ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটিকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যে রূপান্তরের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জাতিসঙ্ঘের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী, গণভোটের ব্যবস্থা করা হলে রাজ্যটির জনমানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বাধীনতা অথবা পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্তির সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে বলে মনে করা হয়।

ভারত দীর্ঘকাল কাশ্মীরিদের স্বাধিকারের বিষয়কে নানা অজুহাতে চাপিয়ে রাখতে সক্ষম হবে এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না। অধিকারহারা বহু জাতিই পরাশক্তিগুলোর অক্টোপাস ও শোষণের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তাই ফিলিস্তিনি ও কাশ্মীরি জাতিও যে একদিন পরিপূর্ণ বিজয় ও মুক্তি অর্জন করবে তা অসম্ভব মনে করার কোনো কারণ নেই।  #

পার্সটুডে

Leave A Reply

Your email address will not be published.