আহলে সুন্নাতের হাদীস ও মনীষীদের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আ.)

0 4,089

আহলে সুন্নাতের হাদীস ও মনীষীদের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আ.)

 

কেউ কেউ ধারণা করে যে ,প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.) সংক্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস কেবল শিয়াদের সাথেই সংশ্লিষ্ট। অথচ শিয়াদের কাছে যেমন এটি মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসস ঠিক তেমনি আহলে সুন্নাতের কাছেও এটি একটি মৌলিক আকীদা বিশ্বাস। শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সবার কাছে মহানবী (সা.)কর্তৃক প্রদত্ত প্রতীক্ষিত আল মাহদী সংক্রান্ত সুসংবাদ প্রমাণিত হওয়া ,তার আন্তর্জাতিক দায়িত্ব ও মিশন ,তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও পবিত্র ব্যক্তিত্ব এবং তার আবির্ভাব ও বিপ্লবের নিদর্শন ও বৈশিষ্ট্যসমূহের ক্ষেত্রে কোন মতপার্থক্য নেই। এতৎসংক্রান্ত একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে ,শিয়ারা বিশ্বাস করে যে ,তিনি দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আল আসকারী (আ.) যিনি ২৫৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং মহান আল্লাহ যেমনভাবে হযরত খিযির (আ.)-এর বয়স দীর্ঘ করেছেন তেমনি তিনি তার জীবনকেও দীর্ঘায়িত করেছেন। তাই তিনি জীবিত আছেন এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক আবির্ভূত হবার অনুমতি দেয়া পর্যন্ত তিনি অন্তর্ধানে থাকবেন। অথচ আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ আলেম বিশ্বাস করেন যে ,তিনি যে জন্মগ্রহণ করেছেন ও বর্তমানে অন্তর্ধানে আছেন তা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি ;বরং তিনি ভবিষ্যতে জন্মগ্রহণ করবেন এবং মহানবী (সা.) তার সম্পর্কে যে সুসংবাদ দিয়েছেন তা তিনি বাস্তবায়ন করবেন। তবে অল্প সংখ্যক সুন্নী আলেম আমাদের (বার ইমামী শিয়াদের) সাথে ইমাম মাহদী (আ.) যে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং অন্তর্ধানে আছেন সে ব্যাপারে একমত প্রকাশ করেছেন।

আহলে সুন্নাতের হাদীস ও মৌল বিশ্বাস সংক্রান্ত (কালামশাস্ত্র) গ্রন্থাদিতে অগণিত হাদীসে এবং তাদের আলেমদের ফতোয়ার গ্রন্থসমূহে ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত আকীদা যে মৌলিক তা সুস্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের রাজনৈতিক ও ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে এ বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে।

এ ভিত্তির ওপরই হিজরী চতুর্দশ শতকে সুদানী মাহদীর আন্দোলন ,পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে পবিত্র মক্কার হারাম শরীফের আন্দোলন এবং এতদসদৃশ আরো বহু আন্দোলন সুন্নী মুসলমানদের মাঝে (মাহদী হওয়ার দাবীকারী আন্দোলনসমূহ এবং ইমাম মাহদী সংক্রান্ত সুস্পষ্ট চিন্তা-ধারণা লালনকারী আন্দোলনসমূহ ,যেমন মিশরের হিজরত ও জিহাদ আন্দোলন এবং এতদ ;সদৃশ আন্দোলনসমূহ) চিন্তাগত কোন ভিত্তি ছাড়া অথবা ইমাম মাহদী সংক্রান্ত শিয়া চিন্তা-ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণে উদ্ভূত হয়নি। তবে কতিপয় সুন্নী মুসলিম এমনই বিশ্বাস করে থাকেন।

সাহাবী ও সুন্নী তাবেয়ীদের থেকে বর্ণিত প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.) সংক্রান্ত হাদীসসমূহের রাবীদের সংখ্যা এতৎসংক্রান্ত শিয়া রাবীদের সংখ্যা অপেক্ষা কম নয় ,আর তাদের মধ্যে এমন সব ব্যক্তিত্ব আছেন যারা হাদীস বিষয়ক প্রামাণ্য গ্রন্থ ,হাদীস বিষয়ক বিশ্ব-কোষ এবং বিশেষ বিশেষ গ্রন্থও রচনা করেছেন।

সম্ভবত ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত আমাদের কাছে বিদ্যমান সবচেয়ে প্রাচীন সুন্নী গ্রন্থ হচ্ছে হাফেয নাঈম ইবনে হাম্মাদ আল মারওয়াযী (মৃ.২২৭ হি.) প্রণীত আল ফিতান আল মালাহিম নামক গ্রন্থটি। আর তিনি সিহাহ অর্থাৎ সুন্নী সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহের রচয়িতাদের অনেকের ,যেমন ইমাম বুখারী ও অন্যদেরও শেখ (হাদীস বিষয়ক শিক্ষাগুরু) ছিলেন। এ গ্রন্থের একটি হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি ভারতের হায়দ্রাবাদের দায়েরাতুল মাআরিফ আল উসমানিয়াহ লাইব্রেরীতে (ক্যাটালগ নং ৩১৮৭-৮৩) বিদ্যমান। এ গ্রন্থের আরেকটি হস্ত লিখিত পাণ্ডুলিপি দামেস্কের আয যাহিরিয়াহ লাইব্রেরীতে (ক্যাটালগ নং ৬২: সাহিত্য) সংরক্ষিত আছে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরীতে এ গ্রন্থের যে কপি বিদ্যমান তাতে প্রায় ২০০ পৃষ্ঠা রয়েছে। ৭০৬ হিজরীতে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ কপির কতিপয় পৃষ্ঠায় হুসাইন আফেন্দীর ওয়াকফ এ বাক্যাংশ বিদ্যমান যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,তা তুরস্কের ওয়াকফকৃত গ্রন্থসমূহ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরীতে তা নিবন্ধন করা হয়। আমরা আমাদের এ গ্রন্থে কপিটি থেকেই উদ্ধৃতি পেশ করেছি। তবে অন্যান্য সুন্নী হাদীস ও আকীদা-বিশ্বাস বিষয়ক প্রামাণ্য উৎসসমূহ যেগুলোয় প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.) এর ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে অথবা অন্তত একটি অধ্যায় বিদ্যমান সেগুলোর সংখ্যা পঞ্চাশেরও অধিক হবে। এগুলোর মধ্যে আহলে সুন্নাতের সহীহ হাদীস গ্রন্থসমূহও বিদ্যমান। তবে ইমাম মাহদী (আ.) বিষয়ক ম্বতন্ত্র গ্রন্থ ও প্রবন্ধসমূহের সংখ্যা উপরিউক্ত প্রামাণ্য উৎসসমূহের সংখ্যার সমান হতে পারে।

ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত সবচেয়ে প্রাচীন শিয়া গ্রন্থ যা আমাদের হাতে রয়েছে তা হচ্ছে আল গাইবাত অথবা ফাদল ইবনে শামান আল আযদী আন নিশাপুরী (যিনি নাঈম ইবনে হাম্মাদের সমসাময়িক ছিলেন) প্রণীত আল কায়েম । ফাদল ইবনে শামান উক্ত গ্রন্থ ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম গ্রহন ও অন্তর্ধানের আগেই রচনা করেছিলেন । এ গ্রন্থের হস্তলিখিত কপিসমূহ আমাদের আলেমদের নিকট ছিল। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে বর্তমানে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে । তবে আলেমগণ এ গ্রন্থ থেকে তাদের প্রণীত গ্রন্থসমূহে যতটুকু উদ্ধৃত করেছেন কেবল ততটুকুই এখন বিদ্যমান । বিশেষ করে আল্লামা মাজলিসী তার হাদীস বিষয়ক গ্রন্থ বিহারুল আনওয়ারে এ গ্রন্থ থেকে বেশ কিছু রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন ।

কালক্রমে আহলে সুন্নাতের আলেম ও সর্বসাধারণের কাছে প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.) সংক্রান্ত আকীদা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও তর্কাতীত বিশ্বাসসমূহের অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হয়েছে । ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত বিশ্বাস অস্বীকারকারী অথবা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণকারী কোন ব্যতিক্রমধর্মী ও বিরল অভিমত ও ধারণার উদ্ভব হয় তাহলে সুন্নী আলেম ও গবেষকগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন । তারা ইসলাম ধর্মের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস যা মহানবী (সা.) থেকে মুতাওয়াতির হাদীস সূত্রে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়েছে সে সম্পর্কে সংশয় পোষণকারীদের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন । আমাদের হাতে ইমাম মাহদী সম্পর্কে যারা সন্দেহ পোষণ করেছে তাদের কতিপয় নমুনা বিদ্যমান । উল্লেখ্য যে ,আহলে সুন্নাতের আলেমগণ এ সব সন্দেহ পোষণকারীদের ধারণা ও অভিমত প্রত্যাখ্যান করেছেন ।

কালক্রমে আহলে সুন্নাতের আলেম ও সর্বসাধারণের কাছে প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.) সংক্রান্ত আকীদা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও তর্কাতীত বিশ্বাসসমূহের অন্তর্ভূক্ত বলে গণ্য হয়েছে । যদি ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত বিশ্বাস অস্বীকারকারী অথবা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণকারী কোন ব্যতিক্রমধর্মী ও বিরল অভিমত ও ধারণার উদ্ভব হয় তাহলে সুন্নী আলেম ও গবেষকগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন । তার ইসলাম ধর্মের অন্যতম মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস যা মহানবী (সা.) থেকে মুতাওয়াতির হাদীস সূত্রে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়েছে সে সম্পর্কে সংশয় পোষণকারীদের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন । আমাদের হাতে ইমাম মাহদী সম্পর্কে যারা সন্দেহ পোষণ করেছে তাদের কতিপয় নমুনা বিদ্যমান । উল্লেখ্য যে ,আহলে সুন্নাতের আলেমগণ এ সব সন্দেহ পোষণকারীদের ধারণা ও অভিমত প্রত্যাখ্যান করেছেন ।

প্রথম নমুনা : হিজরী অষ্টম শতাব্দীর আলেম ইবনে খালদুন তার প্রসিদ্ধ তারিখে (তারিখে ইবনে খালদুন) গ্রন্থের ভূমিকায় (পৃ. ৩১১ ;দারু ইহয়ায়িত তুরাস আল আরাবী কর্তৃক প্রকাশিত)

বলেছেন : জেনে রাখুন ,যুগের পর যুগ ধরে যে বিষয় সকল মুসলমানের মাঝে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তা হচ্ছে ,শেষ যুগে রাসূলের আহলে বাইতভুক্ত এক ব্যক্তির অবশ্যই আবির্ভাব হবে যিনি ধর্মকে সাহায্য করবেন ও ন্যায়পরায়ণতাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন । মুসলমানরা তার অনুসরণ করবে এবং তিনি সকল মুসলিম দেশের ওপর শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন । তাকে মাহদী বলা হবে । দাজ্জালের আবির্ভাব (ও বিদ্রোহ) এবং তারপর যা কিছু ঘটবে সে সব কিছুই কিয়ামতের লক্ষণ যেগুলো সহীহগ হাদীসে প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত । হযরত ঈসা (আ.) তার পরে অবতরণ করে দাজ্জালকে হত্যা করবেন অথবা তিনি তার (মাহদী) সাথে অবতরণ করে দাজ্জালকে বধ করার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করবেন এবং মাহদীর পেছনে নামায পড়বেন ।

এরপর ইবনে খালদুন ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত ২৮টি হাদীস উদ্ধৃত করে সেগুলোর সনদসমূহের কতিপয় রাবী সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন এবং ৩২২ পৃষ্ঠায় নিম্নোক্ত কথা বলে তার সমালোচনার ইতি টেনেছেন : অতঃপর এগুলো হচ্ছে ঐ সব হাদীস যেগুলো হাদীসশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞগণ ইমাম মাহদী (আ.) এবং শেষ যামানায় তার আবির্ভাব ও আন্দোলন সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন । ইতিমধ্যে আপনারা দেখতে পেয়েছেন যে ,মাত্র গুটিকতক হাদীস ব্যতীত বাকী হাদীসগুলি সমালোচনামুক্ত নয় ।

এরপর তিনি প্রতীক্ষিত মাহদী (আ.) সংক্রান্ত কয়েকজন সূফীর কিছু অভিমত তুলে ধরেছেন এবং ৩২৭ পৃষ্ঠায় এ সব অভিমত সম্পর্কে চুলচেরা সমালোচনা করার পর বলেছেন : আর যে সত্য আপনাদের কাছে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয় তা হচ্ছে ,ধর্ম ও রাজত্বের দিকে আহবান কেবল তখনেই সম্ভব হবে যখন কোন শক্তিশালী ধর্মীয়-গোত্রীয় অনুভূতি বিদ্যমান থাকবে । এ বিষয়টিই ধর্ম ও রাজত্বের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর আদেশ বা ফয়সালা না আসা পর্যন্ত ধর্মকে আক্রমণকারীর হাত থেকে সংরক্ষণ করে থাকে । আর আমরা অকাট্য দলীল উপস্থাপন করার মাধ্যমে আগেই তা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করেছি । ফাতিমীয়সহ সকল কুরাইশ বংশের গোত্রীয় বন্ধনের অনুভূতি সব দিক থেকেই ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং তাদের স্থলে অন্যান্য জাতির আবির্ভাব হয়েছে যাদের মধ্যে গোত্রীয় বন্ধনের অনুভূতি তীব্র অবস্থায় রয়েছে । তাই আমরা লক্ষ করি হিজাজের মক্কা এবং মদীনার ইয়াম্বুতে বসবাসকারী তালেবীয়দের (আবু তালিবের বংশধর) মধ্য থেকেই ইমাম হাসান ,ইমাম হুসাইন ও ইমাম জাফর আস সাদিকের বংশধরগণ ব্যতীত বাকী সব কুরাইশ বংশ গোত্রীয় সংখ্যায় হাজার হাজার হওয়া সত্ত্বেও আবাসভূমি ,শাসনক্ষমতা ,আকীদা-বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তারা বহু দল ও উপদলে বিভক্ত । তাই এ মাহদীর আবির্ভাব যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তার আবির্ভাব ও আন্দোলনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য কারণ হবে তার ফাতিমী (হযরত ফাতিমার বংশধর) হওয়া এবং মহান আল্লাহ কর্তৃক সকল ফাতিমীর অন্তরকে তার প্রতি আনুগত্যশীল করা যাতে ঐশী বাণী অর্থাৎ ইসলাম ধর্মকে জয়ী করা এবং সমগ্র মানব জাতিকে তা গ্রহণ করতে বাধ্য করার ব্যাপারে তার জন্য পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও গোত্রীয় সমর্থনের ক্ষেত্র তৈরী করা যায় । গোত্রীয় সমর্থন ও ক্ষমতা ব্যতীত নিছক মহানবী (সা.) এর আহলে বাইতের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কারণে পৃথিবীর কোন এক অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের দিকে কোন ফাতিমীর আহবান বাস্তবে কখনো সফল হবে না ।

অধিকন্ত ইবনে খালদুন পতীক্ষিত মাহদী সংক্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস ও ধারণা প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে নিশ্চিত হন নি ,তবে তিনি তা বাহ্যত অসম্ভব বলে মনে করেছেন এবং এতৎসংক্রান্ত বেশ কিছু হাদীসের সমালোচনাও করেছেন । কিন্তু আলেমগণ ইবনে খালদুনের এ মতকে ইসলামী আকীদার পরিপন্থি ও একরূপ বিকৃতি বলে গণ্য করেছেন । কারণ ,আলোচ্য বিষয়ের সমর্থনে অগণিত ও মুতাওয়াতির হাদীস বিদ্যমান । তাই তারা সমালোচনা করে বলেছেন যে ,তিনি একজন ঐতিহাসিক এবং কখনই হাদীস বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভূক্ত নন যার ফলে হাদীসের সমালোচনা ,তা গ্রহণ বা বর্জন এবং এ সম্পর্কিত ইজতিহাদ (গবেষণা) তার জন্য বৈধ নয় । আমি ইবনে খালদুনের অভিমত অপনোদন সংক্রান্ত যা কিছু দেখেছি তার মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক হচ্ছে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আলেম আহমাদ ইবনুস সিদ্দিকী আল মাগরিবী প্রণীত আল ওয়াহম আল মাকনূন মিন কালামি ইবনে খালদুন (ইবনে খালদুনের বক্তব্যের মধ্যে লুক্কায়িত ভ্রান্ত ধারণা) নামক গ্রন্থ যা ১৫০ পৃষ্ঠা সম্বলিত । লেখক উক্ত গ্রন্থের  একটি পূর্ণাঙ্গ ভুমিকাও লিখেছেন যাতে তিনি প্রতীক্ষিত মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের সত্যতার ব্যাপারে হাদীসশাস্ত্রের ইমামদের বেশ কিছু অভিমতও উল্লেখ করেছেন । এরপর তিনি ইবনে খালদুনের উল্লিখিত ২৮টি হাদীসের সনদের সমালোচনাগুলোকেও একের পর এক খণ্ডন করেছেন এবং ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসের সংখ্যা একশ পর্যন্ত পূর্ণ করেছেন ।

দ্বিতীয় নমুনা : لا مهدی ینتظر بعد الرسول خیر البشر অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পর কোন প্রতীক্ষিত মাহদী নেই নামক গ্রন্থ যার রচয়িতা হচ্ছেন কাতারের ধর্মীয় আদালতের প্রধান বিচারপতি শেখ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ । তিনি এ গ্রন্থ (১৪০০ হিজরীর শুরুতে) মসজিদুল হারাম বিপ্লব এবং এ বিপ্লবের নেতা মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল কারাশীর প্রতীক্ষিত মাহদী বলে নিজেকে দাবী করার পরপরই প্রকাশ করেন । অতঃপর হিজাযের কতিপয় আলেম এর প্রতিবাদ ও খণ্ডন করেছেন । এ মত খণ্ডনকারী আলেমদের মধ্যে আছেন শেখ আব্দুল মুহসিন আল আব্বাদ যিনি الرد علی من کذّب بالأحدیث الصحیحة الواردة فی المهدی অর্থাৎ মাহদী সংক্রান্ত বর্ণিত সহীহ হাদীস যারা পত্যাখ্যান করেছে তাদের অভিমত খণ্ডন শিরোনামে পঞ্চাশের অধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধে উক্ত উক্ত লেখকের মত খণ্ডন করেছেন । উক্ত আলোচনা মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে ৪৫তম সংখ্যায় (মুহররম ,১৪০০ হিজরী) প্রকাশিত হয়েছে। লেখক শেখ আব্দুল মুহসিন আল আব্বাদ উক্ত ম্যাগাজিনে তার প্রকাশিত প্রবন্ধের ভুমিকায় উল্লেখ করেছেন : আর প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরকে দুঃখ ও বেদনা দানকারী এ ঘটনা ঘটার পর শেষ যুগে ইমাম মাহদীর আবির্ভাব ও আন্দোলন সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে ,যেমন মাহদী মাহদীর আবির্ভাব প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) থেকে কি বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত বিদ্যমান ?এর পরিপ্রেক্ষিতে কতিপয় আলেম রেডিও ,পত্র পত্রিকা ,ম্যাগাজিন এবং বই পুস্তকে মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত মুস্তাফীয ও বিশুদ্ধ হাদীসের দ্বারা ইমাম মাহদীর আবির্ভাবের বিষয়টি প্রমাণ করেছেন এবং এসব বাতিলপন্থী যারা পবিত্র বাইতুল্লাহর ওপর আগ্রাসন পরিচালনা করেছে তাদের ব্যাপারে কঠোর নিন্দা করে রেডিওতে বক্তব্য দিয়েছেন এবং কতিপয় পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রবন্ধ লিখেছেন । তাদের মধ্যে মসজিদে নববীর ইমাম ও খতীব শেখ আবদুল আযীয বিনসালেহও আছেন । তিনি জুমআর এক খুতবায় এ জালেম পাপী গোষ্ঠির বিভ্রান্ত দল কর্তৃক বাইতুল্লাহ আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং বলেছেন যে ,তারা এবং যারা তাকে মাহদী বলে মনে করেছে তারা সবাই এক উপত্যকায় রয়েছে । আর যে মাহদীর কথা বলে হাদীসসমূহে বর্ণিত তিনি এদের থেকে ভিন্ন এক উপত্যকায় অবস্থান করছেন ।

উক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপই কাতারের ধর্মীয় আদালতে প্রধান শেখ আবদুল্লাহ বিন যায়দ আল মাহমুদ সর্বশেষ্ঠ মানব রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পরে কোন প্রতীক্ষিত ,মাহদী নেই শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকাশ করেছেন । তিনি উক্ত প্রবন্ধে হিজরী চতুর্দশ শতকের কতিপয় লেখকের সাথে সূর মিলিয়েছেন যাদের হাদীসের বিষয়ে গভীর পাণ্ডিত্য এবং তার বিশুদ্ধতা ও অবিশুদ্ধতা সংক্রান্ত কোন জ্ঞান নেই । এদের মধ্যে এমন সব ব্যক্তিও আছেন যারা বুদ্ধিবৃত্তিক সন্দেহ-সংশয়ের ওপর নির্ভর করে ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি ঠিক তাদের মতই বলেছেন : এগুলো হচ্ছে কুসংস্কারাচ্ছন্ন কথাবার্তা

আমি এ প্রবন্ধে তার ভুল-ভ্রান্তি ও অলীক ধারণাসমূহ তুলে ধরে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করব যে ,শেষ যুগে মাহদীর আবির্ভাব ও আন্দোলন সংক্রান্ত বিশ্বাস সহীহ হাদীসসমূহের দ্বারা সমর্থিত এবং বিরল কতিপয় ব্যক্তি ব্যতীত আহলে সুন্নাতের সকল আলেম এ বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছেন এবং এ আকীদা-বিশ্বাস প্রসঙ্গে অতীত ও বর্তমান কালে লেখা বই পুস্তকও বিদ্যমান ।

প্রসঙ্গত একটি বিষয় উল্লেখ করা আমি সমীচীন মনে করি । আর তা হলো আমি আগেরও প্রতীক্ষিত মাহদী সংক্রান্ত আহলে সন্নাতের আকীদা-বিশ্বাস এবং তাদের লেখা বই পুস্তক শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলাম যা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনের প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় (১৩৮৮ হিজরীর যীলকদ মাসে প্রকাশিত) ছাপা হয়েছিল । এ প্রবন্ধ দশটি বিষয় সম্বলিত ছিল । যথা :

১. মহানবী (সা.) এর ঐ সব সাহাবীর নাম যারা রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে মাহদীর হাদীসসমূহ রেওয়ায়েত করেছেন ;

২. ঐ সব শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির নাম যারা তাদের গ্রন্থসমূহে মাহদী সংক্রান্ত হাদীস ও সাহাবীদের বক্তব্য বর্ণণা করেছেন ;

৩ ঐ সব আলেমের নাম যারা ইমাম মাহদী সংক্রান্ত স্বতন্ত্র গ্রন্থাবলী রচনা করেছেন ;

৪. ঐ সব আলেম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহকে মুতাওয়াতির বলে সাব্যস্ত করেছেন ,তাদের নাম এবং এতৎসংক্রান্ত তাদের বক্তব্য বর্ণনা ;

৫. মাহদীর সাথে সংশ্লিষ্ট সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসমূহ ;

৬. অন্যান্য হাদীস গ্রন্থসমূহে মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের দ্বারা যুক্তি ও দলিল পেশ করেছেন এবং এগুলোর সূত্রও বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাস পোষণ করেছেন তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের নামও উল্লেখ এবং এতৎসংক্রান্ত তাদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি ;

৮. যারা মাহদী সংক্রান্ত বিশ্বাসের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন এবং মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ অস্বীকার করেছেন অথবা সেগুলোর ব্যাপারে দ্বিধা-সংশয় প্রকাশ করেছেন ,তাদের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত সমালোচনাসহ তাদের নাম ;

৯. যে সব হাদীস মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের বিরোধী বলে ধারণা করা হয় সেগুলো এবং সেগুলোর জবাব দান ;

১০. শেষ যুগে মাহদীর আবির্ভাব সত্য বলে মেনে নেয়া আসলে গায়েবে ঈমাম বা বিশ্বাসেরই অন্তর্গত এবং (মাহদী সংক্রান্ত) শিয়াদের আকীদা-বিশ্বাসের সাথে আহলে সুন্নাতের আকীদা-বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নেই এতৎসংক্রান্ত একটি সমাপনী বক্তব্য ।

সত্যিই ইবনে খালদুনের দৃষ্টিভঙ্গির অপনোদন সংক্রান্ত ইবনুস সিদ্দীক আল মাগরিবীর আলোচনা এবং শেখ আব্বাদের উপরোল্লিখিত আলোচনাদ্বয় প্রতীক্ষিত মাহদী সংক্রান্ত আহলে সুন্নাতের হাদীস ও আকীদাভিত্তিক আলোচনাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ । তবে ইসফাহানের ইমাম আমীরুল মুমিনীন লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত আহলে সুন্নাতের নিকট ইমাম মাহদী নামক গ্রন্থ থেকে অন্যান্য সুন্নী আলেমের বক্তব্য ও অভিমত উদ্ধৃত করা যদি অধিক উপকারী না হতো তাহলে আমি ইবনুস সিদ্দীক আল মাগরিবীর প্রবন্ধ এবং শেখ আব্বাদের প্রবন্ধদ্বয় থেকে আরো কিছু উদ্ধৃতি পেশ করার ইচ্ছা করতাম । উল্লেখ্য যে , আহলে সুন্নাতের নিকট ইমাম মাহদী গ্রন্থে প্রতীক্ষিত মাহদী প্রসঙ্গে বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থ এবং পঞ্চাশ জনেরও অধিক সুন্নী আলেম ও ইমামের লিখিত স্বতন্ত্র প্রবন্ধ থেকে বেশ কয়েকটি অধ্যায় সংযোজন করা হয়েছে । আর ইমাম আমীরুল মুমিনীন লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ আরো একটি খণ্ডে হস্তলিখিত অবশিষ্ট সূত্রসমূহ প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ।

ইবনুর কাইয়্যেম আল জাওযীয়াহ :

তিনি তার আল মানার আল মুনীফ ফীস সহীহ ওয়াদ দাইফ গ্রন্থে প্রতীক্ষিত মাহদী সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করার পর বলেছেন : এ সব হাদীস চার শ্রেণীতে বিভক্ত । যতা:- সহীহ ,হাসান ,গরীব এবং বানোয়াট । আর মাহদী প্রসঙ্গে সাধারণ মুসলমান চারটি ভিন্ন অভিমত পোষণ করেছে ।

প্রথম অভিমত : মসীহ ইবনে মারিয়ামই হচ্ছেন মাহদী । এ অভিমত পোষণকারীরা পূর্বে উল্লিখিত মুহাম্মদ ইবনে খালিদ আল জুনদীর হাদীসের ( لا مهدی الا عیسی অর্থাৎ মাহদী-ই ঈসা )দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছে আমরা এ হাদীসের অবস্থা বর্ণনা করে বলেছি যে ,এ হাদীস সহীহ নয় । আর তা যদি সহীহ হয় তবু তাতে স্বতন্ত্র কোন মাহদীর অস্তিত্বের প্রমাণে কোন যুক্তি নেই । কেননা ঈসা (আ.)-ই মহানবী (সা.) ও কিয়ামতের মাঝে সবচেয়ে বড় মাহদী বলে গণ্য ।

দ্বিতীয় অভিমত : বনি আব্বাসের মধ্য থেকে যে মাহদী খিলাফত ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তার সময় গত হয়ে গেছে । আর এ অভিমতের প্রবক্তারা মুসনাদে আহমাদে যে রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে তা দিয়ে এ মতের পক্ষে যুক্তি-প্রমান পেশ করেছে । হাদীসটি নিম্নরূপ:

যখন তোমরা প্রত্যক্ষ করবে যে ,খোরাসান থেকে কালো পতাকাসমূহ আগমন করেছে তখন এমনকি বরফের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তোমরা সেগুলোর কাছে যাবে । কারণ ,সেগুলোর মাঝে মহান আল্লাহর খলীফা আল মাহদী থাকবেন ।

সুনানে ইবনে মাজায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত : আমরা একদা মহানবী (সা.) এর কছে উপস্থিত ছিলাম ,তখন বনি হাশিমের একদল যুবক সামনের দিকে এগিয়ে আসল । অতঃপর যখন মহানবী তাদেরকে দেখলেন তখন তার নয়নদ্বয় অশ্রুতে পূর্ণ হয়ে গেল এবং রং পরিবর্তিত হয়ে গেল । আমি তখন তাকে বললাম :আপনার পবিত্র মুখমণ্ডলে এমন কিছু এখনো দেখতে পাচ্ছি যা আমার কাছে পছন্দনীয় নয় । তিনি বললেন : মহান আল্লাহ আমাদের (আহলে বাইতের) জন্য দুনিয়ার পরিবর্তে আখেরাতকে মনোনীত করেছেন । আর আমার আহলে বাইত অচিরেই বিপদাপদ ,নির্বাসন ও দেশান্তরের শিকার হবে । এ অবস্থা প্রাচ্যবাসীর মধ্য থেকে একটি দল যাদের সাথে কালো পতাকা থাকবে ,তাদের আগমন পর্যন্ত চলতে থাকবে । ঐ কালো পতাকাবাহীরা তখন ন্যায্য অধিকার দাবী করবে ,কিন্তু তাদেরকে তা দেয়া হবে না । তাই তারা যুদ্ধ করবে এবং বিজয়ী হবে । অতঃপর তারা যা চেয়েছিল তা তাদেরকে দেয়া হবে । কিন্তু এবার তারা নিজেরাই তা গ্রহণ করবে না । তাই তারা যুদ্ধ করবে এবং বিজয়ী হবে । অতঃপর তারা যা চেয়েছিল তা তাদেরকে দেয়া হবে । কিন্তু এবার তারা নিজেরাই তা গ্রহণ করবে না । অবশেষে তারা তাদের পতাকাসমূহ আমার আহলে বাইতভুক্ত এক ব্যক্তি- যে এ পৃথিবী যেভাবে অন্যায়-অত্যাচার দিয়ে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল তদ্রূপ তা ন্যায়পনায়ণতা দিয়ে ভরে দেবে-তার হাতে তুলে দেবে । সুতরাং যারা তা প্রত্যক্ষ করবে তাদের উচিত হবে বরফের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাদের সাথে যোগ দেয়া ।

এ হাদীস এবং এর পূর্ববর্তী হাদীসটি যদি সঠিক হয় তুবুও এগুলো থেকে প্রমাণিত হয় না যে ,বনি আব্বাসের মধ্য থেকে যে মাহদী শাসনকর্তৃত্ব লাভ করেছিলেন তিনিই ঐ মাহদী যিনি শেষ যুগে আবির্ভূত হবেন । বরং তিনি অন্যতম মাহদী হিসেবে মাহদীর অন্তর্ভুক্ত । যেমন উমর ইবনে আব্দুল আযীযও মাহদী ছিলেন এবং তিনি বনি আব্বাসের মাহদীর চেয়েও মাহদী নাম বা উপাধি গ্রহণ করার জন্য অধিক যোগ্য ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ।

দাজ্জাল যেমন পথভ্রষ্টতা ও অমঙ্গলের এক প্রান্তে ও শীর্ষে অবস্থান করেছে তদ্রূপ মাহদীও হেদায়েত ,কল্যাণ ও মঙ্গলের শীর্ষে ও অপর প্রান্তে অবস্থান করছেন । যেরূপ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সবচেয়ে বড় দাজ্জালের আগমনের পূর্বে বহু মিথ্যাবাদী দাজ্জাল আছে তদ্রূপ প্রধান বা সর্বশ্রেষ্ঠ মাহদীর পূর্বেও অনেক হেদায়েতপ্রাপ্ত মাহদীও রয়েছেন ।

তৃতীয় অভিমত : তিনি মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ও হাসান ইবনে আলী (রা.)- এর বংশধর হবেন । তিনি শেষ যুগে বের হবেন যখন পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচার দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে । তখন তিনি পৃথিবীকে ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দিবেন । অধিকাংশ হাদীসই এ বিষয় নির্দেশ করে । মাহদী যে ইমাম হাসানের বংশধর হবেন তাতে এক সুক্ষ্ণ রহস্য বিদ্যমান । আর তা হল হাসান (রা.) মহান আল্লাহর উদ্দেশে খেলাফত ত্যাগ করেছিলেন । তাই মহান আল্লাহও তার বংশধরদের খিলাফতে অধিষ্ঠিত করবেন যিনি সমগ্র পৃথিবীকে ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন । আর এটিই হচ্ছে স্বীয় বান্দাদের মধ্যে মহান আল্লাহর সুন্নাত অর্থাৎ যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর জন্য কোন কিছু ত্যাগ করে মহান আল্লাহ তাকে অথবা তার সন্তান-সন্তুতিকে (বংশধর) ঐ জিনিসের চেয়েও উত্তম জিনিস প্রদান করেন । (আল ইমাম আল মাহদী ইনদা আহলুস সুন্নাহ (আহলে সুন্নাতের নিকট ইমাম মাহদী) ,পৃ. ২৮৯)

ইবনে হাজার আল হাইসামী

তিনি তার আস সাওয়ায়িক আল মুহরিকাহ নামক গ্রন্থে বলেছেন : মুকাতির ইবনে সুলাইমান এবং তাকে যে সব মুফাসসির অনুসরণ করেছেন তারা বলেছেন যে ,দ্বাদশ আয়াত

) و إنه لعلم للساعة (

অর্থাৎ নিশ্চয়ই তিনি কিয়ামতের নিদর্শন -মাহদীর শানে অবতীর্ণ হয়েছে । যে সব হাদীসে স্পষ্ট ভাষায় উল্লিখিত হয়েছে যে ,মাহদী মহানবী (সা.) এর আহলে বাইতভুক্ত সেগুলো শীঘ্রই বর্ণনা করা হবে । আর হযরত আলী ও ফাতেমা (রা.)- এর বংশধারার মধ্যে যে বরকত ও কল্যাণ আছে এবং মহান আল্লাহ যে তাদের দু জন থেকে অসংখ্য পবিত্র ও যোগ্য মানুষ সৃষ্টি এবং তাদেরকে প্রজ্ঞার চাবিকাঠি ও করুণার খনি করে দেবেন এতৎসংক্রান্ত নির্দেশনা এ আয়াতে বিদ্যমান । এর অন্তর্নিহিত কারণ হলো এই যে ,মহানবী (সা.) দোয়ার মাধ্যমে হযরত ফাতিমা এবং তার সন্তান ও বংশধদেরকে বিতাড়িত শয়তানের হাত থেকে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় দিয়েছেন এবং আলীর জন্যও তিনি অনুরূপ প্রার্থনা করেছেন । এ বিষয় নির্দেশকারী হাদীসসমূহের বাচনভঙ্গি থেকেও জানা যায় এর সবগুলোই ইমাম মাহদী ?(আ.) সম্পর্কিত । ৪৪৭

আমার অভিমত হচ্ছে و إنه لعلم للساعة এ আয়াতের যে ব্যাখ্যাদ্বয়ের একটিতে ইমাম মাহদীকে কিয়ামতের নিদর্শন এবং আরেকটিতে হযরত ঈসাকে কিয়ামতের নিদর্শন বলা হয়েছে সে ব্যাখ্যাদ্বয়ের মধ্যে এভাবে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব যে ,হযরত ঈসা (আ.) ইমাম মাহদী (আ.)-এর যুগে অবতরণ করবেন এবং তাকে সাহায্য করবেন । আর তাদের উভয়ের মাধ্যমেই একসঙ্গে মহাসত্য ও কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ প্রকাশিত হবে ।

মাহদী সংক্রান্ত কিছু হাদীস বর্ণনা করার পর ইবনে হাজার ঈসা ইবনে মারিয়ামই মাহদী

( لا مهدی إلا عیسی بن مریم )এ হাদীসের ওপর টীকা লিখতে গিয়ে  বলেছেন : অতঃপর  ঈসাই মাহদী ( لا مهدی إلا عیسی )এর ব্যাখ্যা কেবল এ হাদীসটি প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হওয়ার ভিত্তিতেই সম্ভব । তা না হলে হাকিম এতদপ্রসঙ্গে যা বলেছেন সেটাই বলতে হবে । তিনি বলেছেন : আমি আশ্চর্যান্বিত হয়েই এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছি এবং আমি যুক্তি পেশ করার জন্য তা করিনি । আর বায়হাকী বলেছেন : এ হাদীস কেবল মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বর্ণনা করেছে। হাকিম বলেছেন : মুহাম্মদ ইবনে খালিদ একজন অজ্ঞাত ( مجهول ) হাদীস বর্ণনাকারী এবং তার বর্ণনা মহানবী (সা.) এর সাথে সম্পর্কিত করা যাবে কিনা সে সম্পর্কে মত পার্থক্য রয়েছে । নাসাঈ স্পষ্টভাবে বলেছেন : সে মুনকার অর্থাৎ প্রত্যাখ্যাত বর্ণনাকারী । নাসাঈ ছাড়াও হাদীসের অন্যান্য হাফেয দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে ,এ হাদীসটির আগে সে সব হাদীস আছে অর্থাৎ যেগুলোতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে মাহদী ফাতিমার বংশধর সেসব হাদীস সূত্রের দিক থেকে অধিকতর সহীহ ।৪৪৮

আবুল ফিদা ইবনে কাসীর

তার রচিত গ্রন্থ আন নিহায়াহ য় তিনি বলেছেন : শেষ যুগে যে মাহদী আবির্ভূত হবেন তার আলোচনা স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে এবং তাতে বলা হয়েছে যে ,তিনি হেদায়েতপ্রাপ্ত খলীফা ও ইমামদের অন্তর্ভুক্ত । মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহে তার সংক্রান্ত বর্ণনা বিদ্যমান এবং বলা হয়েছে যে ,তিনি শেষ যুগে আবির্ভূত হবেন ।

تخرج من خراسان رایات سود فلا یردها شئ حتی تنصب بإلیاء   অর্থাৎ খোরাসান থেকে কালো পতাকাসমূহ বের হবে । ঈলিয়ায় সেগুলো স্থাপন করা পর্যন্ত কোন কিছুই সেগুলোকে বাধা দান করতে পরবে না এ হাদীস বর্ণনার পরপরই তিনি বলেছেন : এসব পতাকা ঐসব পতাকা নয় যেগুলো নিয়ে আবু মুসলিম খোরাসানী বিদ্রোহ করেছিলেন এবং ১৩২ হিজরীতে উমাইয়্যা শাসনের মূলোৎপাটন করেছিলেন ;বরং এগুলো হচ্ছে অন্য কালো পতাকা যেগুলো মাহদীর সাথে আসবে । আর তিনি হচ্ছেন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল আলাভী আর ফাতিমী আল হাসানী (রা.) । মহান আল্লাহ এক রাতের মধ্যেই তাকে প্রস্তুত এবং তার সবকিছু ঠিক করে দেবেন অর্থাৎ তার তওবা কবুল করবেন ,তাকে সামর্থ্য এবং ঐশী নির্দেশনা দেবেন ও সুপথ প্রদর্শন করবেন । তাকে একদল প্রাচ্যবাসী সমর্থন ও সাহায্য করবে ,তার শাসনকর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করবে ,তার ক্ষমতার ভিত মজবুত করবে ;তার পতাকাও হবে কালো ;আর এটি হচ্ছে এমন এক পতাকা যা মর্যাদ ও ব্যক্তিত্বের প্রতীক । কেননা মহানবী (সা.) এর পতাকা কালো বর্ণের ছিল যা উকাব ঈগল নামে অভিহিত ছিল ।

যা হোক শেষ যুগে যে মাহদীর আগমন প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে ,মূলত তার আবির্ভাব ও উত্থান হবে প্রাচ্য (ইরান) থেকে এবং বায়তুল্লাহয় (মক্কায়) তার হাতে বাইআত করা হবে । এ বিষয়টি কিছু হাদীসেও উল্লিখিত হয়েছে…এবং আমি মাহদীর আলাচনায় একটি পৃথক খণ্ডও রচনা করেছি। আর সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর । ৪৪৯

জালালুদ্দীন সুয়ূতী

তিনি আল হাভী লিল ফাতাওয়া নামক গ্রন্থে বলেছেন : ইবনে জারীর তার তাফসীর গ্রন্থে

و من أظلم ممن مساجد الله أن یذکر فیها اسمه و سعی فی خرابها

অর্থাৎ যারা মহান আল্লাহর মসজিদসমূহে তার নাম স্মরণ করার ব্যাপারে বাধা দান করেছে এবং সেগুলো (মসজিদসমূহ) ধ্বংস করার ব্যাপারে চেষ্টা করেছে তাদের চেয়ে অধিক অত্যাচারী আর কে আছে ? -এ আয়াত প্রসঙ্গে সুদ্দী থেকে বর্ণনা করেছেন : তারা হচ্ছে রোমীয় যারা বাইতুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করার ব্যাপারে বাখতুন নাসরকে সাহায্য করেছিল ;

) اولئک ما کان لهم أن یدخلوها إلا خائفین (

অর্থাৎ তাদেরকে অবশ্যই ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাকে প্রবেশ করতে হবে -এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন : সেদিন পৃথিবীর বুকে রোমের সকল অধিবাসী (রোমান জাতি) নিজেদের গর্দান কর্তিত হওয়ার ভয়ে জিযিয়া কর প্রদানের ব্যাপারে ভীত হয়েই সেখানে প্রবেশ করবে । অতঃপর তারা জিযিয়া কর প্রদান করবে । لهم فی الدنیا خزی   অর্থাৎ তাদের জন্য রয়েছে এ পৃথিবীতে লাঞ্ছনা ও অপমান -এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন : তবে পৃথিবীতে তাদের লাঞ্ছনা ও অপমান হচ্ছে এমন যে ,যখন মাহদী আবির্ভূত হবেন এবং কন্সাট্যানটিনোপোল বিজয় করা হবে তখন তিনি তাদেরকে হত্যা করবেন ;আর এটিই হচ্ছে তাদের জন্য লাঞ্ছনা ও অপমান । ৪৫০

لا مهدی إلا عیسی بن مریم অর্থাৎ ঈসা ব্যতীত কোন মাহদী নেই অথবা ঈসাই হচ্ছেন মাহদী -এ হাদীসের ওপর টীকা লিখতে গিয়ে তিনি বলেছেন : আল কুরতুবী তার আত তাযকিরাহ নামক গ্রন্থে বলেছেন : এ হাদীসটির সনদ দুর্বল । মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত থেকে মাহদীর আবির্ভাব এবং তিনি যে হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বংশধর হবেন এতৎসংক্রান্ত মহানবী থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত এবং এ হাদীসটির চেয়েও অধিক সহীহ । তাই এ হাদীসটি দিয়ে নয় ,বরং ঐ সকল হাদীসের ভিত্তিতেই অভিমত প্রদান ও ফয়সালা করতে হবে।

আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে ইবরাহীম ইবনে আসেম আস সাহরী বলেছেন : মাহদীর আগমন ও আবির্ভাব ,তিনি যে আহলে বাইতভুক্ত হবেন ,সাত বছর শাসন করবেন ,পৃথিবীকে ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন ,তার সাথে হযরত ঈসা (আ.) আবির্ভূত হয়ে ফিলিস্তিনের বাব-ই লুদ্দের (লদ-এর ফটক) কাছে দাজ্জালকে বধ করার ব্যাপারে তাকে সাহায্য করবেন ,তিনি এ উম্মতের নেতৃত্ব দান করবেন এবং ঈসা (আ.) তার শাসনামলে তার পেছনে নামায আদায় করবেন-এতৎসংক্রান্ত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহ মহানবী (সা.) থেকে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং বরণনাকারীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে এ হাদীসগুলো ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে । ৪৫১

ইবনে আবীল হাদীদ মুতাযিলী

তিনি শারহু নাহজিল বালাগাহ গ্রন্থেو بنا یختم لا بکم এবং আমাদের দ্বারাই তিনি সমাপ্ত করবেন ,তোমাদের দ্বারা নয় -হযরত আলী (আ.)-এর এ বাণীর ব্যাখ্যায় বলেছেন : এ বাণী (ইমাম) মাহদীর প্রতি ইঙ্গিত যিনি শেষ যুগে আবির্ভূত হবেন । অধিকাংশ মুহাদ্দিস একমত যে ,তিনি হযরত ফতিমার বংশধর হবেন এবং আমাদের মুতাযিলা ভাইগণও তা অস্বীকার করেন না এবং তারা তাদের গ্রন্থসমূহে মাহদী প্রসঙ্গটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের প্রসিদ্ধ শিক্ষকগণও তা স্বীকার করেছেন । তবে আমাদের বিশ্বাস মতে তিনি এখনো জন্মগ্রহণ করেন নি এবং ভবিষ্যতে জন্মগ্রহণ করবেন । এ একই অভিমত হাদীসপন্থিগণও পোষণ করে থাকেন । ৪৫২

ক্ষিপ্ত উষ্ট্রীর ক্ষিপ্ততার পর নিজ শাবকের প্রতি সদয় হবার মতো পৃথিবী বিদ্রোহ ও বিরুদ্ধাচরণ করার পর আমাদের প্রতি অবশ্যই সদয় হবে -হযরত আলী এ কথা বলার পর তিলাওয়াত করলেন : যারা পৃথিবীতে নিপীড়িত-নির্যাতিত হয়েছে আমরা তাদের ওপর অনুগ্রহ প্রদর্শন এবং তাদেরকে ও উত্তরাধিকারী (অধিপতি) করতে চাই । হযরত আলীর এ বাণী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন : আর ইমামীয়া শিয়ারা ধারণা করে যে ,এটি হচ্ছে তার পক্ষ থেকে গায়েব ইমাম সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি যিনি শেষ যুগে পৃথিবী শাসন করবেন । তবে আমাদের মাজহাবের ভাইয়েরা (মুতাযিলারা) বলেন যে ,এটি হচ্ছে ঐ ইমাম সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি যিনি পৃথিবী শাসন করবেন এবং সকল রাষ্ট্র ও দেশের ওপর স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন । আর এ থেকে তার বর্তমান জীবিত ও বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য হয় না । আর যায়দীয়ারা বলেন যে ,যিনি পৃথিবী শাসন করবেন তিনি অবশ্যই ফাতিমী হবেন যাকে যায়দী মাজহাবের একদল ফাতিমী অনুসরণ করবে ,এমনকি যদিও বর্তমানে তাদের একজনও নেই । ৪৫৩

بأبی ابن خیرة الإماء সর্বশ্রেষ্ঠ দাসীমাতাদের সন্তানের জন্য আমার পিতা উৎসর্গীকৃত হোক হযরত আলী (আ.)- এর এ বাণী ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইবনে আবীল হাদীদ বলেন : তবে ইমামীয়া শিয়ারা ধারণা করে যে ,তিনি তাদের দ্বাদশ ইমাম এবং তিনি দাসীমাতার সন্তান যার নাম নারজিস । কিন্তু আমাদের মুতাযিলা ভাইয়েরা মনে করে যে ,তিনি হযরত ফাতিমার বংশধর যিনি ভবিষ্যতে দাসীমাতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তিনি বর্তমানে নেই পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তিনি তা ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার দিয়ে ভরে দিবিন ,তিনি জালেমদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং তাদেরকে কঠোর শাস্তি দেবেন । ৪৫৪

তবে উদাহরণস্বরূপ তিনি যদি আমাদের যুগে জন্মগ্রহণ করেন ,তাহলে এখন তিনি কোথাকার দাসী এবং তিনি কিভাবে দাসীমাতার সন্তান এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দাসীমাতার সন্তান হবেন ?

ইবনে আবীল হাদীদ বলেছেন : فی سترة من الناس   সে (মাহদী) জনচক্ষুর অন্তরালে থাকবে -আলীর এ বাণীতে যে ব্যক্তির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে ,তা মোটেও ইমামীয়া শিয়াদের মাজহাবের অনুকূলে যায় না ,যদিও তারা ধারণা করেছে যে ,হযরত আলীর উক্ত উক্তি তাদের অভিমতকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত ও সমর্থন করে । আর তা এ কারণে যে ,মহান আল্লাহর পক্ষে এ ইমামকে শেষ যুগে সৃষ্টি করা এবং তাকে কিছুকাল লোকচক্ষুর অন্তরালে গোপন রাখা সম্ভব । তার বেশ কিছু প্রচারক থাকবেন যারা তার দিকে জনগণকে আহবান জানাবেন এবং তার নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন । অতঃপর তিনি গোপন থাকার পর আবির্ভূত হয়ে সকল দেশের ওপর শাসন পরিচালনা করবেন এবং সমগ্র পৃথিবীকে তার শাসনকর্তৃত্ব মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করবেন। ৪৫৫

ফাইযুল কাদীর গ্রন্থে লেখক আল্লামা মান্নাভী

 المهدی رجل من ولدی وجهه کالکوکب الدّرّی   মাহদী আমার বংশধরদের মধ্যকার এক ব্যক্তি তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল তারকার মতো উজ্জ্বল হবে -এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল মাতামিহ গ্রন্থে বলেছেন : বর্ণিত আছে যে ,এ উম্মতের মাঝে একজন খলীফা হবেন যার চেয়ে হযরত আবু বকর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী নন । আর মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ অগণিত এবং প্রসিদ্ধ । অনেকেই সেগুলোর ব্যাপারে স্বতন্ত্র পুস্তক রচনা করেছেন । আস সামহুদী বলেছেন : তার(মহানবী) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহে প্রতিষ্ঠিত বিষয় হচ্ছে এই যে ,মাহদী ফাতিমার বংশধর হবেন । আর সুনানে আবী দাউদে বর্ণিত আছে যে ,তিনি হাসানের বংশধর হবেন ।এ ক্ষেত্রে মূল রহস্য হচ্ছে ,মহান আল্লাহর উদ্দেশে উম্মতের প্রতি সদয় হয়ে ইমাম হাসানের খিলাফত ত্যাগ । তাই মহান আল্লাহ প্রথিবীবাসীর প্রচণ্ড প্রয়োজনের মুহূর্তে এবং অন্যায়-অবিচার দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর ইমাম হাসানের বংশধর হতে এক ব্যক্তির ওপর সত্য খিলাফত প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করবেন । স্বীয় বান্দাদের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর সুন্নাত বা রীতি হচ্ছে এই যে ,যে ব্যক্তি তার জন্য কোন কিছু ত্যাগ করবে তিন ঐ ব্যক্তিকে অথবা তার বংশধরকে যা সে ত্যাগ করেছে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু প্রদান করেন ।

এরপর তিনি বলেছেন : ঈসা ইবনে মারিয়াম ব্যতীত কোন মাহদী নেই- এ হাদীসটি মাহদী সংক্রান্ত অন্যান্য হাদীসের পরিপন্থি নয় । কারণ ,আল কুরতুবীর বক্তব্য অনুসারে এ হাদীসের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে হযরত ঈসা ব্যতীত আর কোন মাহদী পূর্ণরূপে মাসুম (নিষ্পাপ) নন । আর রুয়ানী হুযাইফা থেকে বর্ণনা করেছেন যে ,ইবনুল জাওয়ী ও ইবনুল আহমদ আর রাযী বলেছেন : উক্ত হাদীস আসলে একটি বাতিল হাদীস । এ হাদীসের সনদে (রাবীদের পরস্পরায়) মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম আস সূরী বিদ্যমান । তার সম্পর্কে ইবনুল জাল্লাব থেকে আল মীযান নামক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে ,তিনি রাওয়াদ থেকে মাহদী সংক্রান্ত একটি প্রত্যাখ্যাত হাদীস বর্ণনা করেছেন । এরপর তিনি উক্ত হাদীস উদ্ধৃত করে বলেছেন : এ হাদীসটি বাতিল । ৪৫৭

আল্লামা খাইরুদ্দীন আল আলূসী

তিনি গালিয়াতুল মাওয়ায়েয নামক গ্রন্থে বলেছেন : অধিকাংশ আলেমের বিশুদ্ধ ও সঠিক অভিমতের ভিত্তিতে কিয়ামতের নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন মাহদী (আ.) এর আবির্ভাব । আলেমদের মধ্যে যারা তার আবির্ভাবের বিষয়টি অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করেছেন তাদের এ মতের কোন মূল্য নেই আর মাহদীর আবির্ভাব সংক্রান্ত বেশ কিছু হাদীস বিদ্যমান ।

ঐ সকল হাদীসের একটি অংশ আলোচনা করার পর তিনি বলেছেন : যা কিছু আমরা মাহদী প্রসঙ্গে উল্লেখ করলাম আসলে তা হচ্ছে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্যতম বিশুদ্ধ অভিমত । ৪৫৮

শেখ মুহাম্মদ আল খিদর হুসাইন শাইখুল আযহার

আত তামাদ্দুন আল ইসলামী নামক ম্যাগাজিনে মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের ওপর এক পলক দৃষ্টি -এ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি বলেছেন : খবরে ওয়াহিদের (একক সূত্রে বর্ণিত হাদীস) দ্বারা যুক্তি পেশ করার বৈধতার বিষয়টি ব্যবহারিক বিধির অন্তর্ভুক্ত । এটি এমন একটি বিষয় যার মাধ্যমে শরীয়ত প্রণেতা মহান আল্লাহ এমন কিছু সম্পর্কে সর্বসাধারণকে অবহিত করেন যা জানা ঈমানের সঠিকতার মানদণ্ড হিসাবে পরিগণিত নয় ,তবে তাদের তা অবশ্যিই জানা উচিত । ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কিত হাদীসসমূহ এরূপ (খবরে ওয়াহিদ) হাদীসের অন্তর্ভুক্ত । তাই যখন মহানবী (সা.) থেকে শেষ যামানা সম্পর্কে এমন কোন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় তখন যদি তা মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হাদীসের পর্যায়ে না-ও পৌছায় অর্থাৎ রাবীদের সংখ্যা অধিক না-ও হয় তবুও তা গ্রহণ করা ও মেনে নেয়া অপরিহার্য ।

সহীহ বুখারীতে মাহদী সংক্রান্ত কোন হাদীস বর্ণিত হয় নি । সহীহ মুসলিমে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তাতে মাহদীর নাম স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয় নি এবং কতিপয় হাদীসশাস্ত্রবিদের মতে এ হাদীসের উদ্দেশ্য হলো মাহদী অথবা অন্তত এতে তার কতিপয় বৈশিষ্ট্য বা গুণের দিকে ইঙ্গিত করা । তবে আহমদ ইবনে হাম্বল ,আবু দাউদ ,আত তিরমিযী ,ইবনে মাজাহ ,তাবারানী ,আবু নাঈম ইবনে হাম্মাদসহ অন্যান্য হাদীসবেত্তা তাদের নিজ নিজ হাদীসগ্রন্থে মাহদী সংক্রান্ত হাদীস রেওয়ায়েত করেছেন ।

মোল্লা আলী আল কারী প্রণীত আল উরফুল ওয়াদী ফী হাকীকাতিল মাহদী এবং শাওকানী প্রণীত আত তাওহীদ ফি তাওয়াতুরে মা জায়া ফিল মুনতাজার ওয়াদ দাজ্জাল ওয়াল মাসীহ (প্রতীক্ষিত মাহদী ,দাজ্জাল ও মাসীহ সক্রান্ত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহের মুতাওয়াতির হওয়া সংক্রান্ত ব্যাখ্যা) নামক সন্দর্ভে এসব হাদীস সংকলিত হয়েছে ।

আমাদের জানা মতে প্রথম যে ব্যক্তি মাহদী সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছিলেন তিনি হলেন আবু যাইদ আবদুর রহমান ইবনে খালদুন । তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে , (মাহদী সংক্রান্ত) কতিপয় হাদীস সমালোচনার উর্দ্ধে । আর আমাদের অভিমত হচ্ছে ,এ সব হাদীসের মধ্যে যখন অন্তত একটি হাদীস সঠিক বলে প্রমাণিত হবে এবং সমালোচনার উর্দ্ধে বলে গণ্য হবে তখন ঐ হাদীস শেষ যুগে এমন এক ব্যক্তি যিনি শরিয়ত অনুসারে মানব জাতিকে নেতৃত্বদান এবং ন্যায়পরায়ণতাসহ পৃথিবীতে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন ,তার আবির্ভাবের বিষয়টিতে বিশ্বাস অর্জনের জন্য যথেষ্ট হবে ।

যে সব সাহাবীর সূত্রে মাহদী সংক্রান্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাদের সংখ্যা সাতাশ জন । প্রকৃত ব্যাপার হলো বানোয়াট এবং নিকটবর্তী দুর্বল হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহকে প্রথক করার ব্যাপার হলো বানোয়াটের নিকটবর্তী দুর্বল হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহকে প্রথক করার পর মাহদী সংক্রান্ত অবশিষ্ট হাদীস সম্পর্কে কোন বিচক্ষণ গবেষক ও আলেমেই উপিক্ষা করতে পারেন না । আর একটু আগে উল্লিখিত সন্দর্ভে শাওকানী স্পষ্টভাবে বলেছেন যে ,মাহদী সংক্রান্ত হাদীসগুলো মুতাওয়াতির হাদীসের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে । তিনি বলেছেন : এ সংক্রান্ত যে সব হাদীসের ওপর নির্ভর করা সম্ভব সেগুলোর সংখ্যা পঞ্চাশ ,যার মধ্যে সহীহ ,হাসান ও সংশোধনযোগ্য দুর্বল হাদীস (যে দুর্বল হাদীসের সমর্থক হাদীসসমূহ রয়েছৈ যার দ্বারা তার বিষয়বস্তুগত দুর্বলতা দূর করা সম্ভব) বিদ্যমান । তাই এ সংক্রান্ত হাদীস নিঃসন্দেহে মুতাওয়াতির ;বরং যে সব হাদীস এ হাদীসসমূহ অপেক্ষাও স্বল্প সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রেও উসূলশাস্ত্রের গ্রহীত পারিভাষিক নীতিমালার ভিত্তিতে মুতাওয়াতির পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে অর্থাৎ সেগুলোরকেও মুতাওয়াতির হাদীস বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।

মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ প্রত্যাখ্যানকারীদের মধ্যে কেউ কেউ এ কথাও বলেছেন যে ,এসব হাদীস শিয়াদের তৈরী । কিন্তু তাদের বক্তব্য এভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায় যে ,হাদীসগুলো তার সংশ্লিষ্ট সূত্রসহই বর্ণিত হয়েচে এবং আমরা এগুলোর সনদসমূহের রাবীদের ব্যাপারে অনুসন্ধান গবেষণা করেছি । অতঃপর আমরা তাদেরকে এমন ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পেয়েছি যারা ন্যায়পরায়ণতা এবং সূক্ষ্ণ স্মরণশক্তির জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং যাদের মধ্যে কেউই জারহ ও তাদীল (হাদীসসমূহের বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততা ,নির্ভরযোগ্যতা ও ক্রটি পর্যালোচনা) বিশেষজ্ঞ আলেমদের পক্ষ থেকে শিয়া বলে অভিযুক্ত হন নি । অথচ এ সব বিশেষজ্ঞ আলেমের মধ্যে এমন অনেক রয়েছেন হাদীসের রাবীদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে যারা খ্যতি লাভ করেছেন । আবার কোন কোন শাসক তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিষয়কে নিজ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে । তাই তারা জনগণকে নিজেদের চারপাশে সমবেত করার জন্য নিজেদেরকে মাহদী বলে দাবী করেছে । ফাতেমীয় সাম্রাজ্যে এ দাবীর ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । কারণ ,এর প্রতিষ্ঠিাতা উবাইদুল্লাহ মনে করতেন যে ,তিনিই মাহদী । মুওয়াহহিদদের প্রশাসনও এ দাবীর ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । কারণ ,এ প্রশাসনের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইবনে তূমার্ত এ দাবীর ওপরই তার শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।

মুরিইনিয়াহ রাজবংশের শাসনামলে মরক্কোর ফেজ নগরীতে তূযদী নামক এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল এবং মানহাজাহ গোত্রের সর্দাররা তার চারপাশে জড়ো হয়েছিল । সে মাসমাতীদেরকে হত্যা করেছিল ।

৬৯০ হিজরীতে মরক্কোর এক পল্লীতে আব্বাস নামের এক ব্যক্তি নিজেকে মাহদী দাবী করে বিদ্রোহ করে । একটি গোষ্ঠি তার অনুসারী হয় । অবশেষে সে নিহত হয় । এভাবে তার দাবী ও প্রচার কার্যক্রমেরও যবনিকাপাত হয় ।

মিশরে আরাবীর বিপ্লবের পর মুহাম্মদ আহমদ নামের এক ব্যক্তি সুদানে আবির্ভূত হয়ে নিজেকে মাহদী বলে দাবী করে এবং ১৩০০ হিজরীতে জাহীনা অঞ্চলের বাক্কারাহ গোত্র তাকে মাহদী হিসেবে মেনে নিয়ে তার অনুসারী হয় । তার স্বভাবিক মৃত্যুর পর বাক্কারাহ গোত্রের এক সর্দার তার স্থলাভিষিক্ত হয় ।

যখন জনগণ মহানবী (সা.)এর কোন হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে ভুল করে অথবা তা সঠিকভাবে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ না করার ফলে ফিতনার উৎপত্তি হয় তখন হাদীসের এরূপ অপব্যবহারের বিষয়টি যেন হাদীসটি সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে সন্দেহ পোষণ অথবা তা অস্বীকার করার কারণ না হয় । কারণ ,নবুওয়াত নিঃসন্দেহে একটি প্রকৃত বিষয় ;অথচ বেশ কিছু ব্যক্তি নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করেছে এবং এ দাবী দ্বারা অনেক লোককে পথভ্রষ্টও করেছে ,যেমন বর্তমানকালে কাদিয়ানী ফিরকার কর্মকাণ্ড (এ ভ্রান্ত ফিরকার প্রতিষ্ঠাতা মীর্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী) । আর উলূহীয়াতের (উপাস্য হওয়া) বিষয়টি একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হওয়া সত্বেও এবং তা দ্বিপ্রহরের মধ্যে আকাশে দীপ্তমান সূর্য়ের চেয়েও উজ্জল জানার পরও কিছু কিছু সম্প্রদায় তাদের নেতাদের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছেন । যেমন এ যুগে বাহাঈ সম্প্রদায় এমন দাবীই করে থাকে । তাই পরম সত্য মহান আল্লাহকে তার (উলূহীয়াতের) ক্ষেত্রে যে ভ্রান্ত ধারণা (শিরক) পোষণ করা হয়েচে সেজন্য অস্বীকার করা মোটেও সমীচীন হবে না । ৪৫৯

শেখ নানিরুদ্দীন আলবানী

শেখ নাসিরুদ্দীন আল আলবানী আত তামাদ্দুন আল ইসলামী ম্যাগাজিনে মাহদী প্রসঙ্গে শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন : মাহদী প্রসঙ্গে জানা থাকা উচিত যে ,তার আবির্ভাব সংক্রান্ত প্রচুর সহীহ হাদীস বিদ্যমান যার বেশ কিঠু সহীহ সনদযুক্ত অর্থাৎ মহানবী (সা.) হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে । আমি এ প্রবন্ধে এগুলোর মধ্য থেকে কতিপয় সনদ উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করব । এর পরপরই যারা এ সব হাদীস ও রেওয়ায়েত প্রসঙ্গে আপত্তি করেছেন এবং এগুলোর দোষ-ক্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাদের আপত্তি ও সংশয়সমূহ অপনোদন করব । তিনি উদাহরণস্বরূপ এ সংক্রান্ত কতিপয় হাদীসের উল্লেখ করে সেগুলো মুতাওয়াতির হওয়ার পক্ষে বিশেষজ্ঞ আলেমদের অভিমত তুলে ধরেছেন ।

এরপর তিনি বলেছেন : সাইয়্যেদ রশীদ রিযা এবং অন্যরা ইমাম মাহদী সংক্রান্ত যে সব হাদীস বার্ণত হয়েছে সেগুলোর ওপর স্বতন্ত্রভাবে গবেষণা চালান নি এবং সূক্ষ্ণভাবে যাচাই করে দেখেন নি ;আর  এ সব হাদীসের প্রতিটির সনদও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেন নি । যদি তা করতেন তাহলে তারা প্রত্যক্ষ করতেন যে ,এ হাদীসগুলোর মধ্যে এমন সব হাদীস আছে যেগুলো দিয়ে শুধু এ বিষয়েই নয় ,এমনকি গায়েবী অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও শরীয়তের দলিল পেশ করা সম্ভব । অথচ কেউ কেউ ধারণা করেন যে ,এসব গায়েবী বিষয় কেবল মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয় । রশীদ রিযা (রহ.) দাবী করেছেন যে ,মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের সনদ শিয়া বর্ণনাকারী মুক্ত নয় । কিন্তু ব্যাপারটি একেবারেই এমন নয় । আমি যে চরাটি হাদীস উল্লেখ করেছি সেগুলোয় শিয়া বলে প্রসিদ্ধ কোন রাবী নেই । যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে ,এ দাবী সত্য ,তবুও তা মাহদী (আ.) সংক্রান্ত হাদীসসমূহের সত্য হওয়ার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা সৃষ্টি করে না । কারণ হাদীস সত্য ও বিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র শর্ত বা বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে রাবীর সত্যবাদিতা এবং সূক্ষ্ণভাবে স্মরণ রাখার ক্ষমতা । তাই রাবীর ভিন্ন মাজহাবের অনুসারী হওয়ার বিষয়টি কোন হাদীস অগ্রহণযোগ্য হওয়ার মাপকাটি হতে পারে না । তেমনি সম মাজহাবের অনুসারী হওয়াও কোন হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার শর্ত নয় । আর বিষয়টি হাদীসশাস্ত্রের মূলনীতির মধ্যেও গ্রহণ করা হয়েছে এবং হাদীসশাস্ত্রবিদদের নিকট এটি একটি সর্বস্বীকৃত নীতি । তাই শায়খাইন (বুখারী ও মুসলিম) তাদের সহীহ গ্রন্থদ্বয়ে অনেক শিয়া ও অন্য মাজহাবের অনুসারী রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং এ ধরনের হাদীসের দ্বারা দলিল-প্রমাণও পেশ করেছেন ।

তবে সাইয়্যেদ রশীদ রিযা অন্য কোন কারণে এ সব হাদীসকে ক্রুটিমুক্ত বলে থাকতে পারেন । আর তা হলো তাআরুদ  ( تعارض ) বা পরস্পর বিরোধিতা অর্থাৎ হয়তো তার মতে মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ পরস্পর বিরোধী এবং সেগুলো পরস্পরকে বাতিল করে দেয় । কিন্তু এ কারণটি প্রত্যাখ্যাত । কেননা পরস্পর বিরোধী হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে ,প্রামাণ্যের দৃষ্টিতে হাদীসসমূহের সমান হওয়া । তাই শক্তিশালী ও দুর্বল হাদীসদ্বয়ের মধ্যে তাআরুদ-এর নীতি কার্যকর হওয়াকে কোন সুবিবেচক ও জ্ঞানী ব্যক্তিব বৈধ বিবেচনা করেন না । সাইয়্যেদ রশীদ রিযা মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের ক্ষেত্রে  যে তাআরুদ-এর কথা উল্লেখ করেছেন তা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বিধায় বিবেকবান জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে তা স্বীকৃত ও বৈধ নয় ।

মোটকথা হলো মাহদীর আবির্ভাব সংক্রান্ত বিশ্বাস হচ্ছে এমন একটি বিশ্বাস যা মুতাওয়াতির সূত্রে বার্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং যেহেতু এ বিশ্বাস গায়েবী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত এ বিষয়ে বিশ্বাস পোষণ করা ওয়াজিব । এ বিষয়ে বিশ্বাস রাখা খোদাভীরু (মুত্তাকী) বন্দার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । যেমনটি মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন :

) الم ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ (

আলিফ লাম মীম । এটি ঐ গ্রন্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই এবং পরহেজগারদের জন্য পথ প্রদর্শক যারা গায়েবে বিশ্বাস রাখে ।

এ সব বিষয় একমাত্র অজ্ঞ অথবা অহংকারী ব্যতীত আর কেউ অস্বীকার করে না । আমি মহান আল্লাহর কাছে প্রর্থনা করছি ,তিনি যেন আমাদেরকে যে সব বিষয় পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়েছে তাতে বিশ্বাস আনার তাওফীক দেন। ৪৬০

আল কিত্তানী আল মালিকী

তিনি তার নাজমুল মুনতাসির মিনাল হাদীস আল মুতাওয়াতির গ্রন্থে যে বিশ জন সাহাবী মাহদী সংক্রান্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের বিবরণ দানের পর বলেছেন : আল হাফিয আস সাখাভী থেকে একাধিক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন যে ,তিনি বলেছেন : মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির । আর সাখাভী এ কথা ফাতহুল মুগীস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন এবং আবুল হাসান আল আবিরী থেকে তা উদ্ধৃত করেছেন ।

এ সন্দর্ভের শুরুতে এ কথার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে । মাহদী সংক্রান্ত আবুল আলা ইদ্রীস আল হুসাইনী আল ইরাকীর একটি লেখায় মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির অথবা প্রায় মুতাওয়াতির -এ কথা বিদ্যমান । তিনি বলেছেন : একাধিক সমালোচক হাফিয মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির হবার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন

শারহু রিসালাহ পুস্তিকায় শেখ জাওস হতে বর্ণিত হয়েছে : আস সাখাভী বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে মাহদী সংক্রান্ত হাদীস বিদ্যমান এবং বলা হয়েছে যে ,এ হাদীসগুলো মুতাওয়াতির হাদীসের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে । শারহুল মাওয়াহিবে শাফিঈর মানাকিব অধ্যায়ে আবুল হাসান আল আবিরীর উদ্ধিৃতি দিয়ে বলা হয়েছে : মাহদী যে এ উম্মতের মধ্য থেকে হবেন এবং তার পেছনে ঈসা (আ.) নামায পড়বেন- এতৎসংক্রান্ত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির । আর ঈসাই মাহদী ( لا مهدی الا عیسی ) ইবনে মাজার এ হাদীস রদ্দ করার জন্য মাহদী এ উম্মতের মধ্য থেকেই হবেন এবং ঈসা মাসীহ তার পেছনে নামায পড়বেন- এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে

মাআনীল ওয়াফা ফি মাআনীল ইকতিফা গ্রন্থে শেখ আবুল হাসান আল আবিরী বলেছেন : মাহদীর আগমন ,তিনি যে সাত বছর রাজত্ব করবেন এবং পৃথিবীকে ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার দিয়ে ভরে দেবেন এতৎসংক্রান্ত হাদীস মহানবী (সা.) থেকে অগণিত রাবী কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে । তাই এ হাদীসসমূহ বর্ণনাকারীর সংখ্যার দৃষ্টিতে মুস্তাফিয হাদীসের পর্য়ায় অতিক্রম করে মুতাওয়তিরের পর্যায়ে পৌছেছে । শেখ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আস সাফারাইনী আল হাম্মলী তার শারহুল আকীদাহ গ্রন্থে বলেছেন : মাহদীর আবির্ভাব সংক্রান্ত হাদীসসমূহ অগণিত এবং তা অর্থগতভাবে মুতাওয়তিরের পর্যায়ে পৌছেছে এবং আহলে সুন্নাতের আলেমদের মাঝে এতটা প্রচলিত হয়েছে যে ,তারা মাহদীর আবির্ভাবকে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেছেন । এরপর তিনি কতিপয় সাহাবী থেকে মাহদী সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসসমূহ থেকে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন : সাহাবীদের থেকে ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে ,তাদের মধ্য থেকে অনেকেরই নাম উল্লিখিত হয়েছে এবং অনেকের নাম উল্লিখিত হয় নি । যদি এ সকল হাদীসের সাথে তাবেয়ীদের হতে বর্ণিত এ সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে যোগ করা হয় তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জিত হয় । তাই মাহদীর আবির্ভাব সংক্রান্ত বিশ্বাস ওয়াজিব । আর এ বিষয়টি আলেম ও বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের কাছে প্রতিষ্ঠিত এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত ৪৬১

আল আদভী আল মিশরী

তিনি তার মাশারিকুল আনওয়ার গ্রন্থে বলেছেন : কতিপয় রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে ,মাহদী আবির্ভুত হবার সময় তার মাথার ওপর এক ফেরেশতা আহবান জানিয়ে বলতে থাকবে : এই মাহদী মহান আল্লাহর খলিফা ;অতএব ,তোমরা সবাই তার আনুগত্য কর । অতঃপর জনগণ তার দিকে ছুটে আসবে এবং তাদেরকে মাহদী-প্রেমের সুধা পান করানো হবে । তিনি সাত বছর পশ্চিম ও পূর্ব অর্থাৎ সমগ্র বিশ্ব শাসন করবেন ;প্রথমে যারা কাবা ঘরের রুকন ও মাকামের মাঝখানে তার বাইআত করাবে তাদের সংখ্যা হবে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলিম যোদ্ধাদের সমান অর্থাৎ তিনশ তের জন । এরপর শামের ঈমানদার ব্যক্তিরা ,মিশরের সম্ভান্ত বংশীয়রা ,প্রাচ্যের (ইরানের) বিভিন্ন গোত্র ও দল এবং অন্যান্য জাতি তার কাছে আসবে এবং তার হাতে বাইআত করবে । মহান আল্লাহ খোরাসান থেকে তার সাহায্যার্থে কালো পতাকাবাহী এক সেনাবাহিনীকে প্রেরণ করবেন ;তারা এক বর্ণনামতে শামের দিকে এবং আরেক বর্ণনা অনুসারে কুফার দিকে অগ্রসর হবে । আর এতদুভয়ের মধ্য সমন্বয় সাধন করা সম্ভব । মহান আল্লাহ তাকে তিন হাজার ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করবেন । পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আসহাব-ই কাহাফ (গুহাবাসী সাত যুবক) তার সাহায্যকারী হবেন । উস্তাদ সুয়ূতী বলেছেন : এ সময় পর্যন্ত তাদের জীবিত রাখার রহস্য হচ্ছে এ উম্মতের মধ্যে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সত্যাশ্রয়ী খলীফা ইমাম মাহদীকে সাহায্য করার মহান মর্যাদা দান করা । তার সেনাবাহীনি তার সামনে ও পেছনে যথাক্রমে হযরত জিবরাইল ও মীকাঈল থাকবেন । ৪৬২

সাদুদ্দীন তাফতাযানী

তিনি শারহু মাকাসিদ গ্রন্থে বলেছেন : আলোচনার পরিসমাপ্তি : মাহদীর আবির্ভাব এবং ঈসার অবতরণ ইমামতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত । তারা দু জন হচ্ছেন কিয়ামতের নিদর্শন । এতদপ্রসঙ্গে বেশ কিছু সহীহ হাদীস বিদ্যমান যদিও সেগুলো হচ্ছে খবরে ওয়াহিদ ( একক বা স্বল্প সূত্রে বর্ণিত হাদীস )

আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন এক বিপদের কথা উল্লেখ করলেন যা এ উম্মতকে এমনভাবে স্পর্শ করবে যে ,এর ফলে কোন লোকই তখন অন্যায়-অত্যাচার থেকে বাচার জন্য কোন আশ্রয়স্থলই খুজে পাবে না । অতঃপর মহান আল্লাহ আমার বংশধারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যে পৃথিবীকে অন্যায়-অত্যাচার দিয়ে যেমনভাবে ভরে যাবে ঠিক তেমনি ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন । তাই আহলে সুন্নাতের আলেমদের অভিমত হচ্ছে ,তিনি হবেন একজন ন্যায়পরায়ণ ইমাম এবং হযরত ফাতিমার বংশধর । মহান আল্লাহ যখন ইচ্ছা করবেন তখন তাকে সৃষ্টি করবেন এবং ঐশী ধর্ম ইসলামকে সাহায্য করার জন্য তাকে প্রেরণ করবেন । আর ইমামীয় শিয়ারা ধারণা করেছে যে ,তিনি মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আল আসকারী যিনি শত্রুর আশংকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছেন অর্থাৎ আত্মগোপন করেছেন এবং নূহ (আ.) লোকমান খিযির (আ.)- এর মত তার জীবন দীর্ঘায়িত হওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয় । তবে অন্য সকল মাজহাব ও ফিরকা তাদের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছে । কারণ ,তা অত্যন্ত দূরবর্তী সম্ভাবনার একটি বিষয় । এ উম্মতের ক্ষেত্রে এ ধরণের দীর্ঘ জীবনের ঘটনা বিরল বলে গণ্য এবং অনুরূপ নজীরের কথা কোন দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে জানা যায় নি । ৪৬৩

আল কিরমানী আদ দামেশকী

তিনি আখবারুদ দুওয়াল ওয়া আসরারুল আউয়াল গ্রন্থে বলেছেন : আলেমদের মধ্যে ঐক্যমত্য আছে যে ,মাহদী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি শেষ যুগে আবির্ভূত হবেন এবং বিপ্লব করেবেন । এমন ব্যক্তির আবির্ভাব সংক্রান্ত হাদীসসমূহ ইমাম মাহদীর অস্তিত্ব সমর্থন করে এবং তার মতো ব্যক্তিত্বের দ্যূতি ও আলোর বিচ্ছুরণের সাথেই তা সামাঞ্জস্যশীল । তার আবির্ভাব ও আত্মপ্রকাশে শতাব্দীর অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোকোদ্ভাসিত হবে । তার দর্শনে রাতের কালো আধার আলোকোজ্জ্বল প্রভাতে পরিণত হবে । তার ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচারের দিগন্তপ্রসারী আলোকচ্ছটা সমগ্র বিশ্বকে আলোদানকারী চাঁদ অপেক্ষাও উজ্জ্বল করবে । ৪৬৪

মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী

তিনি তার আল ফুতুহাত আল মাক্কীয়া গ্রন্থে বলেছেন : জেনে রাখ (মহান আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন) ,মহান আল্লাহর একজন খলীফা আছেন যিনি এমন অবস্থায় আবির্ভূত হবেন যখন পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচার দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাবে । আর যদি পৃথিবীর আয়ু শেষ হতে একদিনও অবশিষ্ট থাকে তাহলে মহান আল্লাহ ঐ দিনটাকে এতটা দীর্ঘায়িত করবেন যে ,রাসূলুল্লাহ (সা.) এর বংশধারায় হযরত ফাতিমার সন্তানদের মধ্য থেকে আল্লাহর খলীফা এক ব্যক্তি শাসনভার গ্রহণ করবেন ;মহনবী (সা.)- এর নামের সাথে তার নাম মিলে যাবে ।

মারজ আক্কায় মহান আল্লাহর সর্ববৃহৎ দস্তরখান প্রত্যক্ষ করবে ;তিনি অন্যায়-অনাচার ও অত্যাচারীদের নিশ্চিহ্ন করবেন ,দীন প্রতিষ্ঠা করবেন এবং ইসলামে নতুন প্রাণ সঞ্চার করবেন । হীন অবস্থায় থাকার পর তার মাধ্যমে ইসলাম সম্মানিত হবে এবং মৃত্যুর পর তা পুনরুজ্জীবন লাভ করবে । তিনি জিযিয়া কর চালু করবেন এবং মহান আল্লাহর দিকে তরবারির সাহায্যে আহবান জানাবেন । তাই যে তার আহবান প্রত্যাখ্যান করবে তাকে তিনি হত্যা করবেন এবং যে তার সাথে সংঘর্ষ ও দ্বন্দে লিপ্ত হবে সে অপদস্ত ও লাঞ্চিত হবে । তিনি যে প্রকৃত দীনের ওপর আছেন সেই দীনকেই প্রকাশ করবেন ;রাসূলুল্লাহ (সা.) যদি থাকতেন তবে যেভাবে ধর্ম পালন করতে বলতেন সেভাবে তা পালন করার আদেশ দেবেন । তিনি পৃথিবীর বুক থেকে সকল ধর্ম ও মাজহাব বিলুপ্ত করবেন । যার ফলে পৃথিবীতে একমাত্র বিশুদ্ধ ধর্ম (ইসলাম) ব্যতীত আর কোন ধর্ম থাকবে না ।

তার শত্রুরা হবে ফকীহ-মুজতাহিদদের অনুসারী । কারণ তারা দেখবে তাদের ইমামরা যে ফতোয়া প্রদান করেছে সেগুলোর পরিপন্থি নির্দেশ ও হুকুম ইমাম মাহদী প্রদান করেছেন । কিন্তু তারা তার তরবারি ও কর্তৃত্বের ভয়ে বাধ্য হয়ে এবং তার কাছ থেকে সুবিধা লাভের আশায় তার নির্দেশ মেনে নেবে ।

সাধারণ মুসলিম জনতা ,অভিজাত মুসলমানদের চেয়ে মাহদীকে পেয়ে বেশী আনন্দিত হবে । হাকীকতপন্থী আরেফগণ যাদের কাশফ ও শুহুদ (আধ্যাত্মিক জগতের বিষয় ও রহস্যাবলী উন্মোচন ও প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা) আছে তারা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার পরিচিতি লাভ করার কারণে স্বভাবিকভাবেই তার হাতে বাইআত করবেন ।

তার আল্লাহওয়ালা সঙ্গী-সাথী থাকবেন যারা তার রাষ্ট্র কায়েম করবেন এবং তাকে সাহায্য করবেন । তারা হবেন তার মন্ত্রী । তার রাষ্ট্র ও প্রশাসনে গুরুদায়িত্ব পালন করবেন এবং মহান আল্লাহর বিধি-বিধান প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও তাকে সাহায্য করবেন ।

তার নেতৃত্বে যুদ্ধকারী শহীদরা হবেন শ্রেষ্ঠ শহীদ ;তার বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা হবেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বস্ত ;মহান আল্লাহ তার জন্য একটি দলকে সাহায্যকারী নিযুক্ত করবেন যাদেরকে তিনি তার গায়েবী জগতে তার জন্য লুক্কায়িত রেখেছেন তিনি কাশফ ও শুহুদের মাধ্যমে তাদেরকে হাকীকতসমূহ (সত্যের প্রকৃত রূপ)দেন এবং স্বীয় বান্দাদের প্রতি করণীয় দায়িত্ব তাদের মাধ্যমেই সম্পাদন করেন ,তাদের সাথে পরামর্শ করে ইমাম বিভিন্ন বিষয়ে ফয়সালা করবেন । কারণ ,তারা গায়েবী জগতে যা আছে তা জানেন ।

তবে তিনি নিজেই সত্যের তরবারি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সবচেয়ে যোগ্য রাজনীতিক তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তার দায়িত্ব পালনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু অবহিত অর্থাৎ তিনি তার অবস্থান ও মর্যাদা অনুসারে তার নিকট হতে জ্ঞাত । কারণ ,তিনি নিষ্পাপ খলীফা যাকে মহান আল্লাহ ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত ও পবিত্র রেখেছেন ;তিনি পশুর ভাষাও বুঝবেন ;মহান আল্লাহ তার জন্য যে সব সহযোগী নিযুক্ত করেছেন তাদের জ্ঞানের রহস্যাবলী দ্বারা তিনি মানুষ ও জ্বিন জাতির মাঝে ন্যায় ও সুবিচার কায়েম করবেন । কারণ ,মহান আল্লাহ বলেছেন : মুমিনদেরকে সাহায্য করাই হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব ( و کان حقا علینا نصر المؤمنین ) । এসব সহযোগী হবেন তার সঙ্গীদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী ও শ্রেষ্ঠ ;তারা হবেন অনারব-তাদের মধ্যে একজনও আরব থাকবেন না । তবে তারা আরবী ভাষায় কথা বললেন ;তাদের একজন রক্ষক আছেন যিনি তাদের (মানব) জাতিভুক্ত নন । তারা কখনো মহান আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করেন নি এবং তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বাসভাজনদের অন্তর্ভুক্ত । ৪৬৫

শরীফ বারযানজী

তিনি তার আল ইশাআহ ফী আশরাতিস সাআহ গ্রন্থে লিখেছেন : মাহদী প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে বর্ণনাগত পার্থক্য থাকলেও তা নিতান্ত কম নয় ;তাই মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আদ দাস্তরী তার মানাকিবুশ শাফিঈ গ্রন্থে বলেছেন : মাহদী প্রসঙ্গে এবং তিনি যে তার (মহানবীর) আহলে বাইতভুক্ত হবেন এতৎসংক্রান্ত মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির বা মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে ।

আনাস ইবনে সীরীন থেকে বর্ণিত আছে যে ,মাহদী আবু বকর ও উমর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ । তাকে বলা হলো : হে আনাস! তিনি কি আবু বকর ও উমর অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ ?তিনি বললেন : এমনকি তিনি কতিপয় নবী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ । আর তার থেকে আরো বর্ণিত আছে : তার (মাহদীর) ওপর আবু বকর ও উমরের শেষ্ঠত্ব নেই । সুয়ূতী আল উরফ আল ওয়ার্দী গ্রন্থে বলেছেন : এটি সনদের দিক থেকে সঠিক (অর্থাৎ মাহদীর ওপর আবু বকর ও উমরের শ্রেষ্ঠত্ব নেই- এ কথা ইবনে সীরীন থেকে প্রকৃতই বর্ণিত হয়েছে) এবং তা প্রথম বাক্যের (মহদী আবু বকর ও উমর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ) চেয়ে হালকা । তিনি বলেছেন : আমার কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত হচ্ছে বরং তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জনের পুরস্কার ( بل أجر خمسین منکم ) এ হাদীসটি যে বিষয় নির্দেশ করে তার ভিত্তিতে উপরিউক্ত বাক্যদ্বয় (মাহদী আবু বকর ও উমর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং এমনকি তিনি কতিপয় নবী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ )ব্যাখ্যা করা । কারণ ,মাহদীর যুগে ফিতনা অত্যন্ত প্রবল হবে ।

আমার মতে আসলে শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে বিভিন্ন ;আর মহানবী (সা.) কোন ব্যক্তিকে যেভাবে অগ্রাধিকার প্রদান করেছেন এবং শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিপন্ন করেছেন সেভাবেই তাকে প্রাধান্য দেয়া ও শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা উচিত এবং নিরঙ্কুশভাবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান কখনোই সমীচীন হবে না । কারণ ,অনুত্তম ব্যক্তির মধ্যেও কোন কোন গুণ থাকে যা উত্তম ব্যক্তির মধ্যে নেই । ফুতুহাত গ্রন্থে শেখ মুহিউদদ্দীন আরাবী থেকে ইতোমধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে ,তিনি বিচার ও ফয়সালা প্রদান করার ক্ষেত্রে নির্ভুল হবেন ;করাণ ,তিনি মহানবী (সা.)-এর পদাঙ্কের অনুসারী হবেন বলে কখনো ভুল করবেন না । নিঃসন্দেহে এটি আবু বকর ও উমরের মধ্যে ছিল না । আর যে নয়টি বৈশিষ্ট্য আগে বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলোর সব কয়েকটি তার আগের কোন নেতার মধ্যে সন্নিবেশিত হয় নি । তাই এ সব দিক থেকে তাদের দু জনের ওপর তাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা যায় । যদিও তাদের দু জনেরই মহানবী (সা.) এর সাহাবী হওয়া ,ওহী অবলোকন ,ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রগামিতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব বিদ্যমান । আর মহান আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন ।

শেখ আলী কারী আল মাশরাব আল ওয়ার্দী ফী মাজহাবিল মাহদী নামক গ্রন্থে বলেছেন : আর তার শ্রেষ্ঠত্বের দলিল হচ্ছে মহানবী (সা.) তাকে খালিফাতুল্লাহ (মহান আল্লাহর খলীফা) বলে অভিহিত করেছেন এবং আবু বকরকে কেবল খলিফাতু রাসূলিল্লাহর (রাসূলুল্লাহর খলীফা) বলা হয় । ৪৬৬


পরিশিষ্ট


আহলে সুন্নাতের হাদীস ও মনীষীদের দৃষ্টিতে ইমাম মাহদী (আ.)

আর সে হচ্ছে কিয়ামতের একটি নিদর্শন। (সূরা যুখরূফ :৬১)

আহলে সুন্নাতের নিকট সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলন ছয়টি যা সিহাহ সিত্তাহ নামে পরিচিত । হাদীসের প্রামাণ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করার জন্য আহলে সুন্নাতের হাদীস সংকলকগণ যে সব মূলনীতি প্রণয়ন করেছেন এ ছ টি সংকলন সে সব মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত । এ ছ টি গ্রন্থ হচ্ছে : সহীহ আল বুখারী ,সহীহ আল মুসলিম ,সহীহ আত তিরমিযী ,সুনানে ইবনে মাজাহ ,সুনানে আবু দাউদ ও সহীহ আন নাসাঈ । ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে সিহাহ সিত্তাহ ও আহলে সুন্নাতের অন্যান্য সূত্রে অসংখ্য হাদীস রয়েছে । এখানে উদ্ধৃত নিম্নোক্ত হাদীস ও বর্ণনাগুলো এমন যেগুলোর সত্যতা ও প্রামাণ্যতার ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের হাদীস বিশারদগণ একমত ।

১. মহানবী (সা.) বলেছেন : এমনকি সমগ্র বিশ্বের আয়ু যদি শেষ হয়ে গিয়ে থাকে এবং কিয়ামত হতে একদিনও অবশিষ্ট থাকে তাহলেও মহান আল্লাহ ঐ দিবসকে এতটা দীর্ঘায়িত করবেন যাতে তিনি ঐ দিবসেই আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারেন যাকে আমর নামেই ডাকা হবে । পৃথিবী অন্যায়-অত্যাচারে ভরে যাওয়ার পর সে তা শান্তি ও ন্যায়ে পূর্ণ করে দেবে । (তিরমিযী ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৮৬ ৯ম খণ্ড ,পৃ. ৭৪-৭৫ ;আবু দাউদ ,২য় খণ্ড ,পৃ. ৭ ;মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল ,১ম খণ্ড পৃ. ৩৭৬ ৩য় খণ্ড ,পৃ.৬৩ ;মুস্তাদরাকুস সাহীহাইন (হাকেম) ,৪র্থ খণ্ড ,পৃ. ৫৫৭ ;আল মাজমা (তাবারানী) ,পৃ. ২১৭ ;তাহযীবুস সাবিত (ইবনে হাজার আসকালানী) ,৯ম খণ্ড ,পৃ. ১৪৪ ;আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ (ইবনে হাজার হাইসামী) ,১১শ অধ্যায় ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৪৯ ;কানযুল উম্মাল ,৭ম খণ্ড পৃ. ১৮৬ ;ইকদুদ দুরার ফী আখবারিল মাহদী আল মুনতাযার ,১২শ খণ্ড ,১ম অধ্যায় ;আল বায়ান ফী আখবারি সাহিবিয যামান (গাঞ্জী শাফিয়ী) ,১২শ অধ্যায় ;ফাতহুল বারী (ইবনে হাজার আসকালানী) ,৭ম খণ্ড ,পৃ. ৩০৫ ;আল তাযকিরাহ (কুরতুবী) ,পৃ. ৬১৭ ;আল হাভী (সুয়ূতী) পৃ. ১৬০ ;আল উরফুল ওয়ারদী (সুয়ূতী) পৃ. ২ ।

আশ শাফিয়ী (ওফাত ৩৬৩/৯৭৪) বলেছেন যে ,এ হাদীস বিপুলসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত এবং বহু বর্ণনাকারী কর্তৃক তা মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বর্ণিত ও প্রচারিত হয়েছে । এছাড়া হাদীসটি ইবনে হিব্বান ,আবু নাঈম ,ইবনে আসাকির প্রমুখ কর্তৃক লিখিত গ্রন্থাদিতেও উদ্ধৃত হয়েছে ।

২. মহানবী (সা.) বলেছেন : মাহদী আমাদের অর্থাৎ আহলে বাইতের সদস্যদের একজন । (ইবনে মাজাহ ,২য় খণ্ড ,হাদীস নং-৪০৮৫)

হাদীসে যেমন আমরা দেখতে পাই ,ইমাম মাহদী (আ.) মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত । তাই তিনি হযরত ঈসা (আ.) হতে পারেন না । ইমাম মাহদী (আ.) এবং ঈসা (আ.) ভিন্ন দুই ব্যক্তি ,তবে তারা দু জন একই সময় আগমন করবেন । নিম্নোক্ত হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে যে ,ইমাম মাহদী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর বংশধর হবেন ।

৩. রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : মাহদী ফতিমার বংশধর। (ইবনে মাজাহ ,২য় খণ্ড ,হাদীস নং ৪০৮৬ ;নাসাঈ ;বাইহাকী ;আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৪৯- এর বর্ণনানুসারে অন্যান্য হাদীস-সংকলকগণ) ।

৪. মহানবী (সা.) বলেছেন : আমরা আবদুল মুত্তালিবের বংমধরগণ বেহেশতবাসীদের নেতা : স্বয়ং আমি ,হামযাহ ,আলী ,জাফর ,হাসান ,হুসাইন ,ও মাহদী। (ইবনে মাজাহ ,২য় খণ্ড ,হাদীস নং ৪০৮৭ ;মুস্তাদরাকে হাকেম (আনাস ইবনে মালিক-এর সূত্রে বর্ণিত) ;দাইলামী ;আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৪৫)

৫. মহানবী (সা.) বলেছেন : মাহদী আমার উম্মাহর মাঝে আবির্ভূত হবে। সর্বনিম্ন ৭ বছর এবং সর্বোচ্চ ৯ বছরের জন্য আবির্ভূত হবে । এ সময় আমার উম্মাহ অফুরন্ত আশীর্বাদ ও অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে যা তারা আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি । উম্মাহ তখন বিপুল পরিমাণ খাদ্যের অধিকারী হবে যার ফলে তাদের (খাদ্য) সঞ্চয় করে রাখার প্রয়োজন হবে না । সে সময় ধন-সম্পদের প্রাচুর্য এত বেশী হবে যে ,তখন কোন ব্যক্তি মাহদীর কাছে কোন কিছু প্রর্থনা করলে সে বলবে : ওখানে আছে নিয়ে যাও । (ইবনে মজাহ ,২য় খণ্ড ,হাদীস নয় ৫০৮৩)

৬. মহানবী (সা.) বলেছেন : আমার ও আমার আহলে বাইতের সদস্যদের জন্য আল্লাহ পারলৌকিক জীবনকে ইহলৌকিক জীবনের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন ও মনোনীত করেছেন । আমার (ওফাতের) পরে আমার আহলে বাইতের সদস্যরা অনেক কষ্ট ভোগ করবে এবং তাদেরকে ঘর-বাড়ি থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা হবে । তখন প্রাচ্য থেকে একদল লোক কালো পতাকাসহ আগসন করবে এবং তাদেরকে কিছু ভাল জিনিষ (অধিকার) প্রদান করার জন্য তারা আবেদন করবে । কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যাত হবে অর্থাৎ তাদেরকে সেই অধিকার দেয়া হবে না । এ কারণে তারা যুদ্ধ করবে । সে যুদ্ধে তারা বিজয়ী হবে এবং তারা যা প্রথমে চেয়েছিল তা-ই তাদেরকে দেয়া হবে । কিন্তু তারা তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে যতক্ষণ না আমার আহলে বাইত থেকে এক ব্যক্তি আবির্ভূত হবে এবং যেভাবে পৃথিবী অন্যায়-অবিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে ঠিক সেভাবে তা ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবে । তাই যে ব্যক্তি ঐ যুগ প্রত্যক্ষ করবে তার উচিৎ হবে বরফের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তাদের সাথে মিলিত হওয়া । (ইবনে মাজাহ ,২য় খণ্ড ,হাদীস নং-৪০৮২ ;তারিখে তাবারী ;আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৫০-২৫১)

৭. আবু নাদরা বর্ণনা করেছেন : আমরা জাবির ইবনে আবদুল্লাহর সাথে ছিলাম । জাবির ইবনে আবদুল্লাহ দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন ,রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আমার উম্মতের সর্বশেষ যুগে একজন খলীফা হবে যে গণনা না করেই জনগণকে হাত ভরে ধন-সম্পদ দান করবে । (বর্ণনাকারী বলেন 🙂 আমি আবু নাদরা ও আবুল আ লাকে জিজ্ঞাসা করলাম : আপনারা কি উমর ইবনে আবদুল আযীযকে বুঝাতে চাচ্ছেন  তারা বললেন : না । (অর্থাৎ তিনি হবেন ইমাম মাহদী ।) (মুসলিম ,কিতাবুল ফিতান ,৪র্থ খণ্ড ,পৃ. ২২৩৪ ,হাদীস নং ৬৭)

৮. মহানবী (সা.) বলেছেন : সর্বশেষ যুগে আমার উম্মত অত্যন্ত কঠিন দুঃখ যাতনা ভোগ করবে যেরূপ তারা আগে কখনো ভোগ করে নি ;তখন মানুষ মুক্তির পথ খুজে পাবে না । তখন আল্লাহ আমার বংশধারা থেকে এক ব্যক্তিকে আবির্ভূত করবেন যে অন্যায়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়া পৃথিবীকে ন্যায় দ্বারা পূর্ণ করে দেবে । পৃথিবীবাসী ও আসমানবাসী তাকে ভালবাসবে । আকাশ থেকে পৃথিবীর সকল স্থানের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং পৃথিবীও যা কিছু দিতে পার তার সব কিছু উজাড় করে দেবে । আর সমগ্র পৃথিবী সবুজ শ্যামল হয়ে যাবে । (আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৫০ ,হাকেম প্রণীত সাহীহ ফিল হাদীস)

৯. রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আরবদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবী ধ্বংস হবে না যার নাম হবে আমার নামের অনুরূপ । (তিরমিযী ,৯ম খণ্ড ,পৃ. ৭৪)

১০. রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : মাহদী আমার আহলে বাইত থেকে আবির্ভূত হয়ে একটি বিপ্লব ঘটাবে এবং পৃথিবী অন্যায়-অবিচার ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তাকে ন্যায় ও সাম্য দ্বারা পূর্ণ করে দেবে । (মুসনাদে আহমাদ ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৮৪ ;জামিউস সাগীর ,পৃ ২ ও ১৬০ ;আল উরফুল ওয়ার্দী ,পৃ. ২ ;কানযুর উম্মাল ,৭ম খণ্ড ,পৃ ১৮৬ ;ইকদুদ দুরার ,১২শ খণ্ড ,অধ্যায় ১ ;আল বায়ান ফী আখবারি সাহিবিয যামান ,১২শ অধ্যায় ;আল ফুসুসুল মুহিম্মাহ ,১২শ অধ্যায় ;আরজাহুল মাতালিব ,পৃ. ৩৮০ ;আল মুকাদ্দিমাহ ,পৃ. ২৬৬)

১১. মহানবী (সা.) বলেছেন : আল্লাহ শেষ বিচার দিবসের আগে ,এমনকি এ পৃথিবীর আয়ুস্কাল যদি একদিনও অবশিষ্ট থাকে ,আমার আহলে বা্ইতের মধ্য থেকে মাহদীকে অন্তর্ধান থেকে আবির্ভূত করবেন । সে এ পৃথিবীতে ন্যায় ও সুবিচারের প্রসার ঘটাবে এবং সব ধরণের অন্যায় অত্যাচার ও অবিচারের মূলোৎপাটন করবে । (মুসনাদে আহমাদ ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৯৯)

সুনানে আবু দাউদেও উপরিউক্ত হাদীসের অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে । (ইংরেজি অনুবাদ ,অধ্যায় ৩৬ ,হাদীস নং ৪২৭০)

১২. মহানবী (সা.) বলেছেন : মাহদী আমার আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত ;নিঃসন্দেহে আল্লাহ এক রাতের মধ্যেই তাকে আবির্ভূত করবেন (অর্থাৎ তিনি কখন আবির্ভূত হবেন সে ব্যাপারে পূর্ব হতে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয় । এবং তার আবির্ভাব হবে আকস্মিক)। (ইবনে মাজাহ ,২য় খণ্ড ,পৃ. ২৬৯ ;মুসনাদে আহমাদ ;আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৫২)

১৪. হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা.) বলেছেন : আমি রাসূলুল্লাহকে বলতে শুনেছি :আমার উম্মাহর একদল ব্যক্তি শেষ বিচার দিবসের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত সত্যের জন্য যুদ্ধ করতে থাকবে । তখন ঈসা ইবনে মারিয়াম অবতরণ করবেন এবং তাদের নেতা (মাহদী) তাকে নামায পড়ানোর জন্য অনুরোধ করবে ;কিন্তু ঈসা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে বলবেন : না ,আপনাদেরকে মহান আল্লাহ অণ্যদের  (মানব জাতির) জন্য মনোনীত করেছেন । (মুসলিম ,২য় খণ্ড ,পৃ. ১৯৩ ;মুসনাদে আহমাদ ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ৪৫ ও ৩৮৪ ;আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৫১ ;সুয়ূতী প্রণীত নুযূল ইসা ইবনে মারিয়াম আখিরি যামান)

১৫. জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বলেছেন ; রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আমার উম্মতের মধ্য থেকে একদল লোক ঈসা ইবনে মারিয়ামের অবতরণ পর্যন্ত সত্যের জন্য যুদ্ধ করতে থাকবে । ঈসা ইবনে মারিয়াম অবতরণ করলে তাদের ইমাম (মাহদী) তাকে নামায পড়ানোর জন্য অনুরোধ করবে । কিন্তু ঈসা বলবেন : এ কাজ করার জন্য আপনি অধিক হকদার । আর মহান আল্লাহ এ উম্মতে আপনাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে অন্যদের ওপর মর্যাদা দিয়েছেন । (মুসনাদে আবু ইয়ালা ;সহীহ ইবনে হিব্বান)

ইবনে আবী শাইবাহ (আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ হাদীসশাস্ত্রবিদ এবং সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার) ইমাম মাহদী সম্পর্কে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে বলা হয়েছে যে ,ইমাম যিনি নামাযে হযরত ঈসা ইবনে মারিয়ামেরও ইমাম হবেন তিনি মাহদী (আ.) ।

সুয়ূতী উল্লেখ করেছেন : হযরত ঈসা যখন অবতরণ করবেন তখন ইমাম মাহদীর পিছনে নামায পড়বেন-এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ যে সব ব্যক্তি অস্বীকার করেছে তাদের মধ্যে কতিপয় ব্যক্তিকে আমি সত্য অস্বীকার করে বলতে শুনেছি : এমন ব্যক্তি যিনি নবী নন ,তার পিছনে নামায পড়া অপেক্ষা ঈসা (আ.) এর মর্যাদা উচ্চতর । কিন্তু পরম সত্যবাদী মহানবী (সা.) থেকে বহু সংখ্যক সহীহ হাদীসের মাধ্যমে ইমাম মাহদী (আ.) এর পিছনে হযরত ঈসা ইবনে মারিয়ামের নামায পড়ার বিষয়টি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এটি একটি অদ্ভুত অভিমত ।

আল্লামা সুয়ূতী এ ব্যাপারে বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন । (নুযূলু ঈসা ইবনে মারিয়াম আখিরি যামান)

ইবনে হাজার আসকালানী বলেছেন : মাহদী এ উম্মতেরই একজন । হযরত ঈসা অবতরণ করে তার পিছনে নামায পড়বেন । (ফতহুল বারী ,৫ম খণ্ড ,পৃ. ৩৬২)

আহলে সুন্নাতের আরেক বিখ্যাত আলেম ইবনে হাজার হাইসামীও একই কথা উল্লেখ করে বলেছেন : আহলে বাইত আকাশের তারকারাজির ন্যায় যাদের মাধ্যমে আমরা সঠিক দিকে পরিচালিত হই এবং তারকারাজি যদি অস্ত যায় (ঢাকা পড়ে যায়) তাহলে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমার কিয়ামত দিবসের নিদর্শনাদির মুখোমূখি হবো । আর হাদীস অনুযায়ী এটি তখনই ঘটবে যখন ইমাম মাহদীর আগমন হবে ,নবী হযরত ঈসা (আ.) তার পিছনে নামায পড়বেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করা হবে । আর তখনই সর্বশক্তিমান আল্লাহর নির্দেশসমূহ একের পর এক প্রকাশ পেতে থাকবে । (আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৩৪)

আবুল হুসাইন আল আজীরীর উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে হাজার বলেছেন : ইমাম মাহদী (আ.) এর আবির্ভাব ও উত্থান সম্পর্কিত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর হাদীসসমূহ বিপুল সংখ্যক সনদসহ বর্ণিত হয়েছে এবং তা মুতাওয়াতির হওয়ার পর্যায়কেও ছাড়িয়ে গেছে । এসব হাদীসে মহানবী (সা.) এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,মাহদী তার (রাসূলুল্লাহর) আহলে বাইতভুক্ত হবেন ,তিনি পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন এবং হযরত ঈসা মাসীহ (আ.) ও ঐ একই সময় আগমন করবেন । মাহদী ফিলিস্তিনে দাজ্জালকে বধ করার ব্যাপারে ঈসা (আ.) কে সাহায্য করবেন । তিনি এ উম্মতের নেতৃত্ব দবেন এবং হযরত ঈসা (আ.) তার পিছনে নামায পড়বেন । (আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৫৪)

ইবনে আলী আশ শাওকানী (ওফাত ১২৫০/১৮৩৪) আত তাওহীদ ফী তাওয়াতুরি মা জাআ ফীল মুনতাযার ওয়াদ দাজ্জাল ওয়াল মাসীহ (প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী ,দাজ্জাল ও মাসীহ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির হওয়ার ব্যাপারে ব্যাখ্যা) নামক গ্রন্থে ইমাম সম্পর্কে লিখেছেন : মাহদী সংক্রান্ত হদীসসমূহ বহু নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে এবং এ করাণেই এসব হাদীস নিঃসন্দেহে নির্ভরযোগ্য ;কারণ ,ফিকহশাস্ত্রে ঐ সব হাদীসের ক্ষেত্রেও মুতাওয়াতির হওয়ার বৈশিষ্ট্য প্রযোজ্য যেগুলো ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের সংখ্যার চেয়েও অল্প সংখ্যায় বর্ণিত হয়েছে । মহানবীর সাহাবীদের প্রচুর বাণী আছে যেগুলোতে স্পষ্ট ও বিশদভাবে মাহদী (আ.) সংক্রান্ত আলোচনা বিদ্যমান । এসব বাণী মহানবী (সা.) এর নিকট থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহের সমপর্যায়ভুক্ত । কারণ ,ইজতিহাদের মাধ্যমে এসব বাণী প্রতিষ্ঠিত করায় কোন সমস্যা নেই। লেখক আল ফাতহুর রাব্বানী নামক তার অপর এক গ্রন্থেও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন । (এতৎসংক্রান্ত বিষয়ে দেখুন মাওযূআতুল ইমাম আল মাহদী ,১ম খণ্ড ,পৃ. ৩৯১-৩৯২ ,৪১৩-৪১৪ ও ৪৩৪ এবং তুহাফুল আহওয়াযী ,৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃ. ৪৮৫)

আস সাবান তার ইসআফুর রাগিবীন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : ইমাম মাহদীর আবির্ভাব সংক্রান্ত হাদীসসমূহ যে মহানবঅ (সা.) কর্তৃক বর্নিত তা বোঝা যায় । তিনি (মাহদী) মহানবীর আহলে বাইতের সদস্য এবং তিনি পৃথিবীকে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন ।

সুয়ূতী তার সাবাইকুয যাহাব গ্রন্থে লিখেছেন : আলেমগণ ঐকমত্য পোষণ করেন যে ,মাহদী শেষ যুগে আবির্ভূত হয়ে সমগ্র বিশ্বকে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন । তার আবির্ভাব সংক্রান্ত হাদীস বিপুল সংখ্যক ।

হাফেজ আবুল হাসান সিজিস্তানী (ওফাত ৩৬৩হি/৯৭৪হিখ্রি.) বলেছেন : মহানবীর নিকট থেকে ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ বিপুল সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে । মাহদী (আ.) মহানবীর আহলে বাইতভুক্ত হবেন এবং সমগ্র বিশ্বকে ন্যায় ও সুবিচার দিয়ে পূর্ণ করে দেবেন।

পরবর্তী যেসব খ্যাতনামা আলেম এ বক্তব্য মেনে নিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন ইবনে হাজার আসকালানী (তাহযীবুত তাহযীব ,৯ম খণ্ড ,পৃ. ১৪৪ ফাতহুল বারী ,৭ম খণ্ড ,পৃ ৩০৫ ,কুরতুবী (আত তাযকিরাহ ,পৃ. ৬১৭) ,সুয়ূতী (আল হাভী ,২য় খণ্ড পৃ. ১৬৫-১৬৬) ,মুত্তাকী হিন্দি (আল বুরহান ফী আলামাতি মাহদীয়ে আখিরিয যামান ,পৃ. ১৭৫-১৭৬) ,ইবনে হাজার হাইসামী (আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,অধ্যায় ১১ ,উপাধ্যায় ১ ,পৃ. ২৪৯) যুরকানী (শারহুল মাওয়াহিবুল লাদুন্নীয়াহ ,৫ম খণ্ড ,পৃ. ৩৪৮) ,সাখাভী (ফাতহুল মুগীস ,৩য় খণ্ড ,পৃ. ৪১)

ইমাম মাহদী (আ.) সংক্রান্ত সমগ্র মুসলিম উম্মাহর আকীদার সর্বোৎকৃষ্ট চিত্র এমন এক ব্যক্তি কর্তৃক চিত্রিত হয়েছে যিনি নিজে ইমাম মাহদীর আগমনে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং এতৎসংক্রান্ত হাদীসসমূহের সত্যতা অস্বীকার করেছিলেন । তিনি হলেন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন (ওফাত ৮০৮ হি./ ১৪০৬খ্রি.) । তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল মুকাদ্দিমায় লিখেছেন : এটি একটি প্রসিদ্ধ ও জ্ঞাত বিষয় যে ,সকল মুসলিম কর্তৃক সকল যুগে বর্ণিত হয়েছে সর্বশেষ যুগে মহানবী (সা.) এর আহলে বাইতের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি নিশ্চতভাবে আবির্ভূত হবেন । তিনি ইসলাম ও ন্যায়বিচারকে শক্তিশালী করবেন । আর মুসলমানগণ তার অনুসরণ করবে এবং তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবেন । তাকে আল মাহদী বলা হবে । (আল মুকাদ্দিমা ,ইতিহাস সংক্রান্ত ভূমিকা ,ইংরেজি অনুবাদ ,লন্ডন ,১৯৬৭ ,পৃ. ২৫৭-২৫৮)

উপরিউক্ত উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে ,ইমাম মাহদী সংক্রান্ত আকীদা ইসলামের বিশেষ কোন সম্প্রদায়ের নয় ;বরং এ হচ্ছে সকল মুসলমানের মধ্যে প্রচলিত একটি সর্বজনীন আকীদা ।

সমকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদীস ও তাফসীরশাস্ত্র বিশারদ শেখ আহমদ মুহাম্মদ শাকের (ওফাত ১৩৭৭হি/১৯৫৮ খ্রি.) লিখেছেন : মাহদীর আগমনে বিশ্বাস কেবর শিয়াদের সাথেই সংশ্লিষ্ট নয় । কারণ ,এ আকীদা মহানবী (সা.) এর অনেক সাহাবীর বর্ণনা থেকে এমনভাবে এসেছে যে ,কেউই এর সত্যতার ব্যাপারে সন্দিহান হতে পারে না । এরপর তিনি ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ ইবনে খালদুন কর্তৃক দুর্বল বলে আখ্যায়িত করার কঠোর সমালোচনা করেন । [আহমদ মুহাম্মদ শাকের প্রণীত (ব্যাখ্যাসহ) মুসনাদে আহমাদ ইবনে হাম্বল ,দারুল মাআরেফ ,মিশর থেকে প্রকাশিত ,৫ম খণ্ড ,পৃ. ১৯৬-১৯৮ ,১৪শ খণ্ড ,পৃ. ২৮৮]

ইখওয়ানুল মুসলিমীন সংগঠনের মুফতী সাইয়্যেদ সাবেক তার গ্রন্থ আল আকাইদুল ইসলামিয়াহ গ্রন্থে লিখেছেন : মাহদী সংক্রান্ত আকীদা আসলেই সত্য যা ঐস সব ইসলামী আকীদা ও মূলনীতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত যেগুলো অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে ।

দু জন বিখ্যাত শাফেয়ী আলেম আল্লামা গাঞ্জী তার গ্রন্থ আল বায়ান -এ এবং সাবলানজী তার গ্রন্থ নুরুল আবসার -এ তিনিই সেই সত্তা ,যিনি তার রাসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে তিনি তা সকল ধর্মের ওপর বিজয়ী করে দেন -কোরআন মজীদের এ আয়াতের ব্যাপারে সাঈদ ইবনে জুবাইর থেকে বর্ণনা করেছেন যে ,মহানবীর প্রতি মহান আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতি আল মাহদীর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে যিনি হযরত ফাতিমার বংশধর ।

ইবনে তাইমিয়াহ (মৃ. ৭২৮হি./১৩২৮ খ্রি.) মিনহাজুস সুন্নাহয় (৪র্থ খণ্ড ,পৃ. ২১১-২১২) লিখেছেন যে ,ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহ অবশ্যই নির্ভরযোগ্য এবং তার শিষ্য যাহাবী এ গ্রন্থের সার সংক্ষেপে  এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন । (মুখতাসার মিনহাজুস সুন্নাহ ,পৃ. ৫৩৩-৫৩৪)

রা্বেতায়ে আলমে ইসলামী কর্তৃক ১১ অক্টোবর ১৯৭৬ তারিখে প্রদত্ত এক ফতোয়ায় বলা হয়েছে যে ,২০ জনেরও অধিক সাহাবী ইমাম (আ) সংক্রান্ত এসব হাদীস বর্ণনা করেছেন । এছাড়া যে হাদীসশাস্ত্রবিদগণ এসব হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম মাহদীর ওপর বই-পুস্তক লিখেছেন তাদের একটি তালিকাও ফতোয়ার সাথে প্রদান করা হয়েছে । এ ফতোয়ায় বলা হয়েছে : হাদীসের হাফেজ এবং হাদীসশাস্ত্র বিশারদগণ প্রত্যয়ন করেছেন যে ,ইমাম মাহদী সংক্রান্ত হাদীসসমূহের মধ্যে অনেক সহীহ এবং হাসান হাদীস বিদ্যমান । এর অধিকাংশ হাদীসই বিপুল সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত (অর্থাৎ মুতাওয়াতির বা অকাট্য) । তারা আরো প্রত্যয়ন করেছেন যে ,মাহদীর আগনে বিশ্বাস স্থাপন করা ফরয এবং এটি হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকীদার অন্যতম । সুন্নী মাজহাবের কেবল অজ্ঞ ব্যক্তিরা ও বিদআতপন্থীরা মাহদী সংক্রান্ত আকীদা অস্বীকার করেছেন । (এ ফতোয়ার পূর্ণ পাঠের জন্য আল বায়ান গ্রন্থে লেখক আল গাঞ্জী আশ শাফেয়ীর ভূমিকা দেখুন ,বৈরুত ১৩৭৯হি./১৯৭৯ খ্রি. ,পৃ. ৭৬-৭৯)

আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট আলেম শেখ খাজা মুহাম্মদ পার্সা নাকশাবন্দীর বক্তব্য : আবু মুহাম্মদ আসকারী (আ.) আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত । তিনি ৬ রবিউল আওয়াল ২৬০ হি. শুক্রবার ইন্তেকাল করেন এবং তাকে তার পিতার সমাধির কাছে সমাহিত করা হয় ।তিনি তার পিতার ইন্তেকালের পর ৬ বছর জীবতি ছিলেন এবং (মৃত্যুকালে) কেবল এক পুত্র সন্তান রেখে যান যিনি হচ্ছেন আবুল কাশেম মুহাম্মদ । তিনিই প্রতীক্ষিত ত্রাণকর্তা । প্রতীক্ষিত ত্রাণকর্তা ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান জন্মগ্রহণ করেন ;তার মায়ের নাম ছির নারজিস (রা.) । যখন তার বয়স ৫ বছর তখন তার পিতা ইমাম হাসান আসকারী (আ.) ইন্তেকাল করেন ।

সাইয়্যেদ হাকীমাহ বিনতে আবি জাফর মুহাম্মদ আল জাওয়াদ (আ.) ছিলেন ইমাম হাসান আল আসকারীর ফুপু ,তিনি বলেছেন : ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান আমি ইমাম হাসান আসকারীর বাড়িতে ছিলাম । তিনি আমাকে তার বাড়তে থাকতে অনুরোধ করেন । ফজরের ওয়াক্ত হলে আমি দেখতে পেলাম । ইমাম হাসান আসকারী তাকে দু হাতে তুলে নিয়ে তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামাত দিলেন । এরপর তিনি আমাকে বললেন : ফুপু! এ সদ্যপ্রসূত শিশুই হচ্ছে প্রতীক্ষিত ত্রাণকর্তা । (ফাসলুল খেতাব ,পৃ. ৪৪৩ ও ৪৪৭ ,তাশখন্দ থেকে মুদ্রিত গ্রন্থটির মূল নাম হচ্ছে লামাহ আলামাতুল আউলিয়া ;আহলে সুন্নাতের অন্যতম মনীষী ভারতের মাদ্রাসায়ে দেওবন্দের বিখ্যাত আলেম মাওলানা আশরাফ আলী থানভী এ গ্রন্থের উর্দু অনুবাদ করেছেন ।

শেখ ওয়াহাব ইবনে আহমাদ আবনে আলীর বক্তব্য : কিয়ামতের শর্তাবলী অন্যতম ইমাম মাহদী (আ.) এর পুনরাবির্ভাব ,দাজ্জালের আবির্ভাব ,আকস্মিক নতুন নতুন রোগের প্রদুর্ভাব ,পশ্চিম দিক হতে সূর্যোদয় ,কোরআন উধাও হয়ে যাওয়া ,ইয়াজুজ মাজুজের আবির্ভাব ও বিজয় । এরপর তিনি বলেন : এসব ঘটনা ঘটবে এবং ঐ সময় ঘটবে যখন ইমাম মাহদী (আ.) এর পুনরাবির্ভাবের প্রত্যাশা করা হবে যিনি হবেন ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর পুত্র এবং ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান জন্মগ্রহণ করেছেন । তিনি এখনো  জীবিত আছেন এবং ঈসা ইবনে মারিয়ামের সাথে তার সাক্ষাত হবে । (আল ইয়াওয়াকীত ওয়াল জাওয়াহির ফী আকাইদুল আকবার ,দ্বিতীয় সংস্করণ ,পৃ. ১২৭)

আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট মনীষী ইমাম হুসাইন দিয়ার বাকরীর বক্তব্য : ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আলী (আ.) হচ্ছেন দ্বাদশ ইমাম । আবুল কাসেম তার উপাধি এবং বারো ইমামী শিয়াদের আকীদা অনুসারে তার উপাধিসমূহের অন্যতম হচ্ছে আল কায়েম (বিপ্লবকারী) ,আল মাহদী , (সুপথপ্রাপ্ত) ,আল মুনতাযার (প্রতীক্ষিত) সাহেবুল আসর ওয়ায যামান (যুগের অধিপতি) । তাদের মতানুযায়ী তিনি দ্বাদশ ও সর্বশেষ ইমাম । তারা আরো বিশ্বাস করে যে ,তিনি সামাররায় তার মায়ের সামনে একটি কুয়ার ভেতরে প্রবেশ করেন এবং থেকে তিনি আর বের হননি । এ ঘটনা ২৬৫ বা ২৬৬ হিজরীতে ঘটেছিল । আর এ ঘটনা সত্য । তার মা ছিলেন উম্মে ওয়ালাদ ( ঐ দাসীকে উম্মে ওয়ালাদ বলা হয় যে তার নিজ মালিকের সন্তান গর্ভে ধারণ করে জন্ম দেয় )। তার বেশ কিছু নাম ,যেমন সাকীল ,সুসান ও নারজিস উল্লেখ করা হয়েছে । (তারিখুল খামিস ,২য় সংস্করণ ,পৃ. ২৮৮ ,বৈরুত থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত)

আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট মনীষী ইমাম ইবনে জওযী : মুহাম্মদ ইবনে হাসান বিন আলী বিন মুহাম্মদ বিন আলী বিন মূসা বিন জাফর বিন মুহাম্মদ বিন আলী বিন হুসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব (আ.)! আবুল কাসিম আপনার উপাধি এবং আপনি খলীফা ও সকল যুগের ইমাম । আপনার মায়ের নাম সাকীল। (তাযকিরাতুল খা্ওয়াস ,পৃ. ২০৪ ,মিশর থেকে প্রকাশিত)

শেখ ইবনে হাজার আল হাইসামী ইমাম হাসান আসকারী (আ.) প্রসঙ্গে লিখেছেন : কথিত আছে ,তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা কার হয়েছিল এবং আবুল কাসেম মুহাম্মদ ব্যতীত তার আর কোন পুত্র সন্তান ছিলনা । আবুল কাসেম মুহাম্মদ (আ.) এর বয়স যখন ৫ বছর তখন তার পিতা ইন্তেকাল করেন । কিন্তু মহান আল্লাহ তাকে (ঐ অল্প বয়সেই) জ্ঞান প্রদান করেন এবং তিনি প্রতীক্ষিত ত্রাণকর্তা হিসাবে প্রসিদ্ধ । তিনি আত্মগোপন করে আছেন এবং কেউ জানেনা তিনি কোথায় আছেন । (আস সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ ,পৃ. ২০৮ ,মূলতান ,পাকিস্তান থেকে মুদ্রিত)

গ্রান্ড মুফতিয়ে দিয়ার (দেশের প্রধান মুফতি) নামে খ্যাত আল হাযারমা আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ ইবনে হুসাইন ইবনে উমর আল মাশহুর আলাভীর বক্তব্য : শেখ ইরাকীর মতে ,ইমাম মাহদী (আ.) ২৫৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন । শেখ আলী আল খাওয়াসের জীবদ্দশায় অর্থাৎ ৯৫৮ হিজরীতে ইমাম মাহদী (আ.) সত্য (বাস্তবে বিদ্যমান) ;আর একই কথা ইমাম আবদুল ওয়াহাব শারানীও বলেছেন । (বাকিয়াতুল মুস্তারশিদীন ,পৃ. ২৯৪ ,বৈরুত থেকে প্রকাশিত)

ইমাম কিরমানী নামে প্রসিদ্ধ আহমাদ ইবনে ইউসুফ ওয়া মুশকীর বক্তব্য : পিতার মৃত্যুর সময় ইমাম আবুল কাসেম মুহাম্মদ ইবনে হাসান আসকারীর বয়স ছিল ৫ বছর । মহান আল্লাহ যেমন নবী হযরত ইয়াহইয়াকে ঐ বয়সে জ্ঞান দিয়েছিলেন যখন তিনি ছিলেন অল্প বয়স্ক শিশু ,তেমনি তিনি তাকে ঐ অল্প বয়সেই ঐশী ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়েছিলেন । তিনি সুন্দর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এবং তার পবিত্র বদন মণ্ডলী ছিল আলোকিত (নূরানী) । (তারিখে আখবারুদ দুওয়াল ফী আছারিল আউয়াল ,পৃ ১১৮ ,বাগদাদ ,ইরাক থেকে প্রকাশিত)। এসব বৈশিষ্ট্য ইমাম মাহদীর বিবরণ প্রদানকালে হাদীসের গ্রন্থাবলীতেও উল্লিখিত হয়েছে ।

আহলে সুন্নাতের আরেক মনীষী ইমাম আল্লামা শেখ আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ বিন আমীর আশ শিবরাভীর বক্তব্য : প্রতীক্ষিত ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদী ইবনে হাসান আল খালিস (আ.) ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান সামাররায় জন্মগ্রহণ করেন । আব্বাসী শাসনকর্তার অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে ইমাম হাসান আসকারী মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে ইমাম মাহদী (আ.) এর জন্মগ্রহণের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন । ইমাম মুহাম্মদের উপাধিগুলো হচ্ছে মাহদী (হেদায়েতপ্রাপ্ত) ,কায়েম (বিপ্লকারী) ,মুনতাযার(প্রতীক্ষিত) ,খালাফে সালেহ(পূণ্যবান উত্তরাধিকারী) এবং সাহেবুয যামান ;এসব উপাধির মধ্যে আল মাহদী সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। (ইলা তাহাফি বেহুবিল আশরাফ ,পৃ. ১৭৯-১৮০ ,মিশর থেকে প্রকাশিত)

আহলে সুন্নাতের আরেক মনীষী ইমাম আল্লামা হাফেয মুহাম্মদ বিন মুতামাদ খান আল বাদাখশানী । নিশ্চয় আপনার শশ্রু হবে নির্বংশ -এ আয়াতের আবতার শব্দের ব্যাখ্যা করে বলেন : আবতার ঐ ব্যক্তি যার ভবিষ্যতে কোন আশা-আকাঙ্ক্ষা বা ভবিষ্যৎ বংশধারা নেই । অতঃপর তিনি বলেন : ইমাম হুসাইনের পুত্র আবুল হাসান আলী বিন হুসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) ,তার পুত্র আবু জাফর মুহাম্মদ আল বাকের (আ.) ,তার সন্তান আবু আবদিল্লাহ জাফর আস সাদিক (আ.) ,তার সন্তান আবু ইসমাইল মূসা আল কাযেম (আ.) ,তার সন্তান ছিলেন আলী আর রেযা (আ.) এবং তার সন্তান ছিলেন আবু মুহাম্মদ আয যাকী (আ.) ,আর তার সন্তান হচ্ছেন আল মুনতাযার আবুল কাসেম মুহাম্মদ আল মাহদী (আ.) । (নাযালুল আবরার ,পৃ. ১৭৪-১৭৫ ;ইরাক থেকে মুদ্রিত)

আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট মনীষী ইমাম শেখ মুমিন বিন হাসান মুমিন আশ শাবলানজীর বক্তব্য : মুহাম্মদ বিন হাসান হচ্ছেন দ্বাদশ (ইমাম) । তিনি আবুল কাসেম মুহাম্মদ বিন হাসান বিন আলী আল হাদী বিন মুহাম্মদ আল জাওয়াদ বিন আলী আর রেযা বিন মূসা কাযেম বিন জাফর আস সাদিক বিন মুহাম্মদ আল বাকের বিন আলী যায়নুল আবেদীন বিন আল হুসাইন বিন আলী বিন আবী তালিব (আ.) । তার মায়ের নাম ছিল নারজিস এবং কেউ কেউ তাকে সুসান ও সাকীল বলেও উল্লেখ করেছেন । আবুল কাসেম তার কুনিয়াহ এবং তার উপাধি হচ্ছে আল হুজ্জাত (খোদায়ী প্রমাণ) ,মাহদী ,খালাফে সালেহ ,আল কায়েম ,আল মুনতাযার এবং সাহেবুয যামান । আল ফুসূলুল মুহিম্মাহ র বিবরণ অনুসারে তিনিই বারো ইমামী শিয়াদের দ্বাদশ ইমাম । ইবনুল ওয়ার্দীর ইতিহাস অনুযায়ী তিনি ২৫৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেছেন । (নুরুল আবসার)

আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট মনীষী আল্লামা কামালুদ্দীন মুহাম্মদ বিন তালহা শাফিয়ীর বক্তব্য : আবুল কাসেম মুহাম্মদ বিন আল হাসান খালিস বিন আলী আল মুতাওয়াক্কিল বিন মুহাম্মদ আল কামিয়াহ বিন আলী আর রেযা বিন মূসা আল কাযেম বিন জাফর আস সাদিক বিন মুহাম্মদ আল বাকের বিন আলী যায়নুল আবেদীন বিন হুসাইন আয যাকী বিন আলী বিন আবী তালিব (আ.) ;তিনি প্রতীক্ষিত ত্রাণকর্তা । তার মায়ের নাম ছিল সাকীলাহ এবং তিনি হাকীমাহ নামেও পরিচিতা ছিলেন । তার নাম মুহাম্মদ ;তার কুনিয়াত আবুল কাসেম ;তার উপাধিসমূহের মধ্যে আল হুজ্জাত ,খালাফে সালেহ ও আল মুনতাযার প্রসিদ্ধ । (মাতালিবুস সুউল ফী মানাকিবে আলে রাসূল ,পৃ. ৮৯ ;মিশর থেকে প্রকাশিত) তিনি উক্ত গ্রন্থে আরো লিখেছেন যে ,ইমাম মাহদী ইমাম আবু মুহাম্মদ আল হাসান আল আসকারীর পুত্র । কিনি সামাররায় জন্মগ্রহণ করেন । তিনি তার আদ দুরারুল মুনাযযাম গ্রন্থেও একই কথা উল্লেখ করেছেন ।

আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত আলেম শেখ আসলাহুদ্দীন তার শারহে দারিয়াহ গ্রন্থে লিখেছেন : হযরত মাহদী (আ.) আহলে বাইতের ইমামদের মধ্যে দ্বাদশ ইমাম । ইমাম আলী ছিলেন প্রথম ইমাম এবং ইমাম মাহদী হচ্ছেন সর্বশেষ ইমাম ।

আহলে সুন্নাতের প্রখ্যাত আলেম শেখ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম আল হামুয়ানী আশ শাফিয়ী ফারায়িদুস সিমতাইন গ্রন্থে আবাল খাযাঈ থেকে লিখেছেন যে ,তিনি বর্ণনা করেছেন : ইমাম আলী আর রেযা বিন মূসা (আ.) বলেছেন : আমার পরে আমার পুত্র জাওয়াদ তাকী ইমাম হবে ;তারপরে তার পুত্র আলী আল হাদী আন নাকী ইমাম হবে । তার পরবর্তী ইমাম হবে তার পুত্র আল হাসান আল আসকারী ;আর তার পরে ইমাম হবে তার পুত্র মুহাম্মদ আল মাহদী । তার অবর্তমানে অর্থাৎ অন্তর্ধানকালে জনগণ তার পুনরাবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে ।তার পুনরাবির্ভাবের পর যারা তার আনুগত্য করবে তারাই হবে মুমিন ।

আহলে সুন্নাতের অন্তত পয়ত্রিশ জন বিখ্যাত আলেম ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে ৪৬টি গ্রন্থ রচনা করেছেন । এর মধ্যে উল্লোখযোগ্য হচ্ছে :

১. কিতাবুল মাহদী : আবু দাউদ ।

২. আলামাতুল মাহদী : জালালুদ্দীন সুয়ূতী।

৩. আল কাওলুল মুখতাসার ফী আলামাতিল মাহদী আল মুনতাযার : ইবনে হাজার ।

৪. আল বায়ান ফী আখবারি সাহিবিয যামান : আল্লামা আবু আবদিল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইউসুফ আদ দাশেকী ।

৫. মাহদী আলে রাসূল : আলী ইবনে সুলতান মুহাম্মদ আল হিরাভী আল হানাফী ।

৬. মানাকেবুর মাহদী : আল হাফেয আবু নাঈম আল ইসফাহানী ।

৭. আল বুরহান ফী আলামাতিল মাহদী আখিরায যামান : মুত্তাকী হিন্দী ।

৮. আরবাউনা হাদীসান ফীল মাহদী : আবদুল আলা আল হামাদানী ।

৯. আখবারুল মাহদী : আল হাফেয আবু নুআইস ।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.