পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য/আলামত ও ভয়ংকর পরিণাম!

0 2,788

মুনাফিক একটি ভয়ঙ্কর শব্দ। মুনাফিক শব্দটি শুনলেই শরীর শিউরে ওঠে। মানব সমাজের সবচেয়ে ক্ষতিকর দোষ হচ্ছে মুনাফিকী।
মুনাফিক আরবি শব্দ। এর মানে দু’মুখো ব্যক্তি। যে ব্যক্তি দু’মুখো নীতি অবলম্বন করে, যে কুফুরি গোপন করে নিজেকে মুমিন বলে প্রকাশ করে তাকে ‘মুনাফিক’ বলে। এরূপ ব্যক্তি কাফিরও নয়, মুমিনও নয়; বরং এর মাঝামাঝি। এরা ইসলাম, মুসলমান তথা গোটা মানব সমাজের জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

সজারু তার গর্তের মধ্যে থেকে বের হওয়ার জন্য কয়েকটি মুখ রাখে। একটি মুখ নরম মাটি দিয়ে বন্ধ করা থাকে। রাস্তাটি দেখতে বন্ধ মনে হলেও আসলে বন্ধ নয়। কোনো দুশমন দ্বারা আক্রান্ত হলেই সে গোপন নরম মাটির মুখ দিয়ে বের হয়ে যায়। এ গোপন রাস্তাটি দিয়ে বের হওয়ার নাম ‘নাফিকা’। মানুষের মধ্যে এরূপ যে করে সেই মনুাফিক। মুনাফিক মানুষের চরিত্রও তাই। সে সুবিধাভোগী। সুযোগ পেলেই সে তার মত পাল্টায়। এমনকি নিজ ধর্ম ত্যাগ করতেও বাধ্য হয়। বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক রয়েছে। আক্বীদা, বিশ্বাসে ও কাজে। যার মধ্যে যতটুকু মুনাফিকের আলামত আছে সে সে হারে ততটুকুই মুনাফিক। তবে আক্বীদাগত মুনাফিক অত্যন্ত মারাত্মক ক্ষতিকর।

আরো মারাত্মক যে গোপনে ইসলামী কাফেলায় প্রবেশ করে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করে। মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কাফির মুশরিকদের চেয়েও ক্ষতিকর। কাফির-মুশরিকরা তো মুসলমানদের চিরশত্রু এটা তাদের জানা। তাই মুসলমানরা কাফির-মুশরিকদের থেকে সর্বদা সতর্ক থাকে। কিন্তু মুনাফিকরা মুসলমানদের রূপ ধরে মুসলমানদের মধ্যে অবস্থান করে গোপনে গোপনে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদেরকে তিলে তিলে ধ্বংস করে। মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র সব সময় আঁচ করা যায় না। এজন্য মুনাফিকরা ইসলাম, মুসলমান ও গোটা মানব সমাজের জন্যই মারাত্মক হুমকি। মুনাফিকদের পরিচয় করা অতি কঠিন এজন্য যে, তারা মুসলমানদের মতো নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, ভালো ভালো কথা বলে এমনকি এতো বেশি বেশি ইবাদত করে যা দেখে মুমিন-মুসলমানরা অবাক হয়ে যায়- মুসলমানরা তাদের ইবাদতকে অতি তুচ্ছ মনে করে। ইরশাদ হচ্ছে- “তুমি যখন তাদের (মুনাফিকদের) দিকে তাকাও তাদের দেহাকৃতি তোমার নিকট প্রীতিকর মনে হয়!” (সূরা মুনাফিকুন, আয়াত: ৪)

মুনাফিকদের প্রতারণা সম্পর্কে অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, “মুনাফিকগণ আল্লাহকে প্রতারিত করতে চায় বস্তুত তিনিই তাদেরকে প্রতারিত করেন এবং যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায় কেবল লোক দেখানোর জন্য!” (সূরা : নিসা, আয়াত-১৪২)।

মুনাফিক ইসলাম, মুসলমান ও গোটা মানবতার শত্রু। মুনাফিক সহজে চেনা যায় না। তবে আলামত ও গুণাগুণ বিচারে এবং নির্ভরযোগ্য লোকের সাক্ষ্যের মাধ্যমে মুনাফিক চেনা যায়। কুরআন-হাদিসে মুনাফিকের প্রচুর আলামত বর্ণিত হয়েছে। এগুলোর মধ্য থেকে নিয়ে কয়েকটি উপস্থাপন করা হলোঃ

(১) কথা ও কাজে মিল নেই।
(২) বার বার একই পাপে লিপ্ত হয়।
(৩) কঠিন মুহূর্তে কাপুরুষতা দেখায়।
(৪) আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করাকে বেহুদা মনে করা। (৫) কাজ ছাড়াই প্রশংসা চায়।
(৬) ধনসম্পদ না দিলেই নাখোশ হয়।
(৭) কঠিন সময়ে দা’ঈদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। (৮) ইসলামের শত্রুদের নিকট থেকে সম্মান কামনা করে।
(৯) লোক দেখানো কাজে আগ্রহ বেশি।
(১০) ওয়াদা ভঙ্গ করে।
(১১) মিথ্যা কথা বলে।
(১২) আমানতের খেয়ানত করে।
(১৩) নসীহত মানে না।
(১৪) পাপ করে গর্ববোধ করে।
(১৫) জিহাদ পরিত্যাগ করতে বলে।
(১৬) মিথ্যা গুজব ছড়ায়।
(১৭) মিষ্টি কথা বলে এবং বেশি বেশি ওজর পেশ করে।
(১৮) জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করে।
(১৯) বিপদ চলে গেলে বড় গলায় কথা বলে এবং লভ্যাংশ চায়।
(২০) দ্রুত পাপ কাজে লিপ্ত হয়।
(২১) ঘুষ-দুর্নীতি করলে আত্মতৃপ্তি পায়।
(২২) মুসলমানদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।
(২৩) মুসলমানদের গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়।
(২৪) রাসূল (সা.) এর প্রশংসা শুনতে চায় না।
(২৫) আল্লাহর ইবাদত করতে অলসতা দেখায়।
(২৬) মুমিনদের মধ্য থেকে সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়। (২৭) প্রকৃত মুসলমানদেরকে বোকা বলে বেড়ায়।
(২৮) মানুষকে ধোঁকা দেয়।
(২৯) মানুষের দোষচর্চায় ব্যস্ত থাকে।
(৩০) অন্যকে পথভ্রষ্ট করতে চায়।
(৩১) ইসলামী মূল্যবোধের পরিবর্তন চায়।
(৩২) মুসলিম ও অমুসলিম উভয় শক্তির সাথে একই সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে চলে, যাতে কোনো পক্ষ থেকেই ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে।
(৩৩) প্রচন্ড ঝগড়াটে।
(৩৪) নামাজ রোজাসহ দ্বীনের মূল বিষয় নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে।
(৩৫) সত্যপন্থিদের বেশি বেশি ভুল ধরে ও তাদের প্রতি রাগান্বিত হয়।
(৩৬) সৎকাজে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে।
(৩৭) ইসলামী হুকুমতের বিরোধীতা করে।
(৩৮) কারো সাথে ঝগড়া বাধলে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করে।
(৩৯) অন্যকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে।
(৪০) নবী-রাসূল ও আউলিয়ায়ে কেরামের মানহানিমূলক অপকর্মে ব্যস্ত থাকে।

পাপ তো পাপই। কিন্তু মুনাফিকী অত্যন্ত ভয়ঙ্কর পাপ। এই পাপের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে। “নিশ্চয়ই মুনাফিকগণ জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনও কোনো সহায় পাবে না!” (সূরা: নিসা, আয়াত : ১৪৫)।
অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছেঃ “মুনাফিক নর-নারী ও কাফিরদেরকে আল্লাহপাক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জাহান্নামের অগ্নির, যেথায় তারা স্থায়ী হবে, ইহাই তাদের জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহপাক তাদের উপর লানত করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি!” (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৬৮)।

আল্লাহতালা আমাদের মুনাফেকি ও মুনাফেক থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.