ভালোভাবে জীবনযাপনের পথে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে চিন্তা ও বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগানো। মনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
চিন্তার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টিজগত। আমাকে কে সৃষ্টি করেছেন? কেন সৃষ্টি করেছেন? আমি কি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছি নাকি মন যা চাইছে সেভাবে চলছি? এসব বিষয় মানুষের চিন্তার প্রধান খোরাক হওয়া উচিত। সর্বোপরি যেকোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। নিজের মন নিয়ে নিজেকেই কাজ করতে হবে। মানুষ যত বেশি চিন্তা ও বিবেককে কাজে লাগাবে ততবেশি তা শানিত হবে এবং উত্তম উপায়ে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। যাদের চিন্তা শক্তি ও বিবেক শানিত তারা তাদের মনের ওপর সহজেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এবং জীবনের সব পর্যায় সঠিক পন্থায় অতিক্রম করতে সক্ষম হন।
সময় ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলেক মেকেনযি’র মতে, ভালোভাবে চিন্তা না করেই কোনো কাজে হাত দেওয়ার কারণেই অনেক মানুষ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হন। মহানবী হজরত মোহাম্মাদ (স.)সহ সব নবী-রাসূল চিন্তা শক্তি এবং আক্ল বা বিবেককে কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়ে গেছেন। আক্ল বা বিবেক হচ্ছে সেই শক্তি যা দিয়ে মানুষ সত্য উপলব্ধি করতে পারে। এর বিপরীত শক্তি হচ্ছে নফস বা প্রবৃত্তি। অনেকে এটাকে অনিয়ন্ত্রিত মন হিসেবেও উল্লেখ করে থাকেন। নফস বা প্রবৃত্তি হচ্ছে লাগামহীন পশুর মতো। এই নফস মানুষকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে টেনে নিয়ে যায় এবং জীবনকে সংকটময় করে তোলে। এ কারণে নফসকে আক্ল ও বিবেকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। মহানবী হজরত মোহাম্মাদ (স.) আক্ল বা বিবেককে অজ্ঞতা থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, আক্ল বা বিবেক মানে হলো অজ্ঞতার পথ রূদ্ধ করা।
নফসে আম্মারা হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণ্য পশুর মতো। কাজেই তার পায়ে যদি বেড়ি পড়ানো না হয় তাহলে তা দিশেহারার মতো ঘুড়ে বেড়ায়। আর এই নফসে আম্মারা’র পায়ে বেড়ি হলো এই আক্ল বা বিবেক। বিবেকের মাধ্যমে নিজেকে নফসে আম্মারা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বলা হয়ে থাকে, একবার এক অজ্ঞ ব্যক্তি এরিস্টটলের কাছে গিয়ে সেখানে উপস্থিত একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির নানা সমালোচনা করলেন এবং তার সম্পর্কে মন্দ কথা বললেন। এ সময় বিজ্ঞ লোকটি চুপ না থেকে অজ্ঞ লোকটিকে আক্রমণ করে কথা বললেন। কিন্তু এরিস্টটল অজ্ঞ লোকটিকে কিছুই বললেন না। তিনি বিজ্ঞ লোকটিকে এ ধরণের আচরণের জন্য বকা দিলেন।
বিজ্ঞ লোকটি অবাক হয়ে এরিস্টটলকে বললেন, আপনি কেন আমাকে বকা দিচ্ছেন। খারাপ কথা বলাতো সে আগে শুরু করেছিল। এছাড়া ওই ব্যক্তি হলো অজ্ঞ-মুর্খ। কিন্তু আমি জ্ঞান অর্জন করেছি। এ সময় এরিস্টটল বলেন, আমি ঠিক একারণেই তোমাকে বকা দিয়েছি। কারণ তুমি জ্ঞানী লোক। একজন বিজ্ঞ লোক অজ্ঞ লোককে চেনে, তার অজ্ঞতা সম্পর্কে জানে। কারণ বিজ্ঞ লোক নিজেও এক সময় অজ্ঞ ছিল, পরে সে জ্ঞানী হয়েছে। কিন্তু একজন অজ্ঞ লোক জ্ঞানী লোককে বুঝতে পারে না। কারণ সে তখনও জ্ঞানী বা বিজ্ঞ হয়ে ওঠেনি।
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বলা হয়েছে, আক্ল বা বিবেক যদি কোনো কিছুকে সঠিক মনে না করে তাহলে সেটাকে সঠিক মনে করা বা বিশ্বাস করার কোনো অধিকার মানুষের নেই। বিবেক যেসব বৈশিষ্ট্যকে অপছন্দনীয় বলে মনে করে সেগুলোকে পছন্দনীয় হিসেবে তুলে ধরার এবং যেসব কাজকে মন্দ বলে মনে করে সেগুলো সম্পাদন করার অধিকার মানুষের নেই। ইসলাম মানুষকে বিবেকবান হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এ কারণে সূরা ইউনুসের ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা চিন্তা করে না আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর অপবিত্রতা আরোপ করেন। আক্ল ও বিবেকের মাধ্যমেই মানুষ তার জীবনকে আরও সুন্দর করে সাজাতে পারে। একজন মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের পার্থক্য হচ্ছে তার চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস। প্রতিটি মানুষই তার চিন্তা-বিশ্বাস অনুযায়ী তার জীবন পরিচালনা করে। তারাই সফল হয় যারা ইতিবাচক, উন্নত ও সৃজনশীল চিন্তা করে। আর যারা নেতিবাচক চিন্তা করে ও অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাকে তারা তার জীবনকেও অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়।
মানুষের জীবনটা কেমন হবে তার অনেকটাই নির্ভর করে তার নিজের ওপর। মানুষের জীবনে সমস্যা ও সংকট থাকবেই কিন্তু তারাই বুদ্ধিমান ও বিবেকবান যারা এই কঠিন সময়ে ও কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন। আসলে মানুষের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীর ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করে। যেমন ধরুন একজন বাবা তার সন্তানের অসুস্থতার কথা শোনার পর যদি হতবিহ্বল হয়ে বসে থাকে এবং চিকিৎসার কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে সে ব্যক্তিকে বুদ্ধিমান ও বিবেকবান বলা যাবে না। বরং সেই ব্যক্তিকেই সঠিক বুদ্ধির অধিকারী বলতে হবে যিনি সন্তানের অসুস্থতার কথা শোনার পর চিকিৎসার জন্য সবচেয়ে ভাল চিকিৎসক এর সন্ধান করতে থাকেন।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, একবার এক ব্যক্তি রাসূল (স.)র কাছে গিয়ে কিছু পরামর্শ চাইলেন, তখন রাসুলে খোদা তিন বার একই প্রশ্ন করলেন। মহানবী বললেন, আমি যে পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা দেবো সেটা কি আপনি পালন করবেন? এ প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যক্তি বলেন, জী রাসূলে খোদা আমি অবশ্যই পালন করব। রাসুলে খোদা (স.) বললেন, আপনার প্রতি আমার পরামর্শ হলো যখনই কোনো কাজ করতে চাইবেন তখনই এর পরিণতির বিষয়টি চিন্তা করবেন। যদি দেখন যে পরিণতি ভালো হবে তাহলে ওই কাজ করবেন। আর যদি মনে হয় কাজটির পরিণতি খারাপ হতে পারে তাহলে তা থেকে বিরত থাকবেন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে রাসূলে খোদা (স.) ভেবেচিন্তে কাজ করাকে কতটা গুরুত্ব দিতেন।#
পার্সটুডে