পবিত্র আশুরা ও মহররম-৩

0 410

আশুরা দর্শন, তৃতীয় বক্তব্য,  ওস্তাদ আয়াতুল্লাহ্  মিসবা তাকী ইয়াযদী

99

শহীদগণের নেতা হযরত আবা আবদিল্লাহ্ আল্-হোসাইন (ছালাওয়াতুল্লাহে ‘আলাইহে)-এর শোকাবহ স্মরণ দিবস সমূহের আগমনে ইমামে যামান হযরত ইমাম মাহ্দী (আঃ)-এর (তাঁর জন্য আমাদের রূহ সমূহ উৎসর্গিত হোক), মহান রাহ্বার, মহান মার্জা’এ তাক্বলীদগণ ও আহ্লে বাইতের আদর্শের প্রেমিক সকলের প্রতি শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং মহান আল্লাহ্র নিকট আবেদন করছি যে, এ দুনিয়ায় ও আখেরাতে ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর সাথে আমাদের সম্পর্ককে যেন কখনো দুর্বল হতে না দেন।
বিগত আলোচনায় আমরা কয়েকটি প্রশ্ন উপস্থাপন করেছিলাম। এর উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, এ ধরনের যে সব প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই তরুণদের মনে জাগ্রত হয় আমাদের সাধ্য অনুযায়ী এবং মোটামুটি সুস্পষ্ট, বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য বক্তব্যর মাধ্যমে সে সবের জবাব দেবো যাতে তার মাধ্যমে আশূরার সংস্কৃতির খেদমত করতে পারি। অবশ্য সাধারণভাবে এ সব প্রশ্নের জবাব আমাদের সকলের নিকটই অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তবে যদি এরপর আরো প্রশ্ন করা হয় তাহলে যাতে আমরা তার জবাব দিতে পারি সে লক্ষ্যে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ, বিষয়গুলো হয়তো আমাদের তরুণদের নিকট অতটা সুস্পষ্ট না-ও থাকতে পারে।
এ বিষয়টি সামনে রেখে আমরা প্রথমে এ প্রশ্ন উপস্থাপন করেছিলাম যে, কেন আমরা সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান করবো? এরপর এ প্রশ্ন উপস্থাপন করেছি যে, মা’ছূম ইমামগণ (আঃ)-এর মধ্যে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) এমন কী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন যে, তাঁর দিকেই বেশী মনোযোগ দেয়া হয়েছে এবং তাঁর জন্য এত সব শোকানুষ্ঠান করা হচ্ছে? আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি এবং এ সম্বন্ধে বিভিন্ন রেওয়াইয়াতে যে সব বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে তার ওপরেও আমরা আলোকপাত করেছি। আর এ বিষয়টি শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের সংস্কৃতিতে যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে সে সম্বন্ধেও বিগত আলোচনায় নিবেদন করেছি।
যখন অধিকতর গভীর প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয় তখন স্বভাবিকভাবেই এ প্রশ্নও উত্থাপিত হয় যে, আসলেই কেন এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো যে, হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ওফাতের পর খুব বেশীদিন না যেতেই তাঁর নাতি শহীদ হলেন, তা-ও এহেন নির্মমভাবে? এমন নির্মমভাবে তাঁকে শহীদ করা হলো যে, যদি না বলি যে, তা ইতিহাসে নযীর বিহীন, অন্ততঃ খুবই বিরল ঘটনা।


এ ঘটনার খুটিনাটি বিস্তারিত বিবরণ আমরা যা শুনতে পাই তা থেকে এটাই বুঝা যায় যে, এ সব কিছুই অন্য কোনো ক্ষেত্রেই একটি ঘটনার মধ্যে ঘটতে দেখা যায় নি। এরূপ ঘটনার বড় জোর একেকটি দিক কখনো কখনো একেক জায়গায় ঘটেছে বলে দৃষ্টান্ত পাওয়া যেতে পারে। মোদ্দা কথা, এ বিশেষ ঘটনা অন্য জায়গায় ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু এত সব বিপদ-মুছিবত মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এক জায়গায় ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে; অবশ্য আমরা বিশ্বের সকল দেশের সকল ইতিহাস অবগত নই, কিন্তু বিশ্বের ইতিহাস আমরা যতখানি শুনেছি এবং যতটা উদ্ধৃত হয়েছে তাতে এরূপ ঘটনা অন্য কোথাও ঘটেছে বলে জানা নেই।
মোদ্দা কথা, পরিস্থিতি ছিলো খুবই মর্মান্তিক। এমনকি হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর হত্যার বর্ণনা সম্বলিত গ্রন্থাবলীতে যে সব ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং মর্সিয়া গায়কগণ যা উদ্ধৃত করেছেন আমরা যদি সে সবের মধ্য থেকে অনেক বিষয়কেই খুব একটা নির্ভরযোগ্য বলে মনে না-ও করি এবং এগুলো যদি এমন অকাট্য দলীল না হয়ে থাকে যে ধরনের দলীলের ওপর মানুষ বিন্দুমাত্রও সন্দেহ পোষণ করতে পারে না, তা সত্ত্বেও নির্মমতার বিচারে এর মূল ঘটনার নযীর বিহীনতায় সন্দেহ করা চলে না। অবশ্য যারা ইতিহাসের সাথে এবং ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর হত্যার বর্ণনা সম্বলিত গ্রন্থাবলীর সাথে ভালোভাবে পরিচিত তাঁরা সম্ভবতঃ এ সবগুলো ঘটনারই সংঘটিত হওয়ার বিষয়টিকে অকাট্য বলে গণ্য করবেন।
এরূপ অকাট্যতার দৃষ্টিতে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, এ ক্ষেত্রে যে সব নির্মম ও পৈশাচিক আচরণ করা হয়েছে তাতে ন্যায়নীতি ও মানবতাবোধের লেশমাত্রও ছিলো না। এমনকি তা আরবদের রীতিনীতি ও অভ্যাসেরও বরখেলাফ ছিলো। কারণ, বিশ্বের জাতিগোষ্ঠী সমূহের মধ্যে আরবদের কতগুলো নিজস্ব বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো এবং সে জন্য তারা গৌরব বোধ করতো। আর আসলেই মোটামুটি এ রকমই ছিলো। তারা এগুলোকে অন্যদের তুলনায় তাদের শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্ট্য বলে গণ্য করতো। উদাহরণ স্বরূপ, আরবরা আতিথেয়তার বৈশিষ্ট্যের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিলো এবং সুপ্রাচীন কাল থেকেই তারা এ জন্য সুপরিচিত ছিলো। আর এখনো এমনই। এটা হচ্ছে একটি খুবই ভালো বৈশিষ্ট্য এবং এটা তাদের মধ্যকার একটি খুবই পসন্দনীয় বৈশিষ্ট্য। অবশ্য যারা গোত্র ভিত্তিক ও যাযাবর জীবন যাপন করে তাদের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে সম্ভবতঃ সুপ্রাচীন কাল থেকে এটা আরবদের সকলের মধ্যেই খুবই উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো।
কেউ যদি কোনো আরবের কাছে আসে, কিন্তু তার কাছ থেকে কিছু না খায় বা কিছু পান না করে তাহলে এটা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে পরিগণিত হয়। আরবরা মেহমানদারীকে এমনই অপরিহার্য গণ্য করতো যে, কেউ তাদের কাছে এলে অবশ্যই তাকে কিছু না কিছু খেতে হতো। তারা অবশ্যই তার আতিথেয়তা করবে। আরবরা সব সময়ই তাদের এ বৈশিষ্ট্যের জন্য গর্ব করতো যে, তারা অতিথিপরায়ণ।
কিন্তু একদল অতিথিকে _ যাদেরকে বারো হাজার পত্র লিখে তারা দাওয়াত করেছিলো, তাঁদেরকে, এমনকি তাঁদের মধ্যকার ছয় মাসের শিশুকে পর্যন্ত তারা এক অাঁজলা পানি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। মানব জাতির ইতিহাসে এরূপ নিষ্ঠুরতার ঘটনা আর কোথায় দেখানো যাবে?
প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিপদ-মুছিবতগুলো কেন সংঘটিত হলো? এ বিরাট ঘটনা, এ বর্ণনাতীত ঘটনা, এ অসহনীয় ঘটনা, যাকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না কী কারণে সংঘটিত হলো? খুব কম লোকের পক্ষেই বিশ্বাস করা সম্ভব যে, এ ধরনের ঘটনাবলী সংঘটিত হওয়া সম্ভব।
হ্যা, যে কারো কাছে, বিশেষ করে যে তরুণ ও যুবকরা সবেমাত্র এ বিষয়ের সাথে পরিচিত হয়েছে তাদের কাছে এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর প্রশ্ন। কেন এ রকম হলো? কতক কাফের দুশমন সীমান্তের ওপার থেকে এসে কি এসব ঘটনা ঘটালো? তারা কি কাফের ছিলো, নাকি মোশরেক ছিলো? নাকি তারা অন্য ধর্মের লোক, যেমন ঃ ইয়াহূদী বা খৃস্টান ছিলো এবং তারা এসে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর বংশধরদের সাথে এরূপ আচরণ করলো?
ইতিহাস বলে ঃ না, এ রকমটি ঘটে নি। আজ পর্যন্ত কেউই বলে নি যে, ইয়াহূদীরা এসে কারবালার ঘটনা ঘটিয়েছিলো। যদিও কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে ঃ “(হে রাসূল!) নিঃসন্দেহে আপনি মু’মিনদের সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে কঠোরতম দেখতে পাবেন ইয়াহূদীদেরকে।” কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ বলে নি যে, এ ঘটনা ইয়াহূদীরা ঘটিয়েছে এবং সাইয়েদুশ শুহাদা (আঃ)-এর ঘাতকরা ইয়াহূদী ছিলো। কেউই এমন কথা বলে নি। কেউ খৃস্টানদের কথাও বলে নি, যরথুস্ত্রীদের কথাও বলে নি, মোশরেকদের কথাও বলে নি। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কেমন করে সম্ভব হলো যে, মুসলমানরা নিজেরাই এ ধরনের একটি জঘন্য কাজ করলো? কীভাবে তারা এত বড় মহাপাপের কাজ, এত বড় ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ সংঘটিত করলো?
হ্যা, অবশ্যই এ প্রশ্নটি করার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তাই এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও বিস্তারিত জবাব দেয়াও অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু আমরা যদি এ প্রশ্নের সঠিক ও সন্তোষজনক জবাব দিতে চাই তাহলে আমাদেরকে অন্ততঃ ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুগে ফিরে যেতে হবে। অর্থাৎ আমাদেরকে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নবুওয়াতে অভিষিক্ত হওয়া ও নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর থেকে শুরু করে খলীফাদের শাসনামল পর্যন্তকার ইতিহাস অধ্যয়ন করতে হবে, আর উত্থাপিত প্রশ্নের সুস্পষ্ট ও সন্তোষজনক জবাব পেতে হলে এ ইতিহাসকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করতে হবে। কিন্তু এটা এমন একটি কাজ যে, না আমি এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, না এটা এক বৈঠকে করা সম্ভবপর। তাই এখানে এ ব্যাপারে মোটামুটিভাবে ও খুব সংক্ষেপে আভাস দেবো এবং বিস্তারিত তথ্যাদির জন্য শ্রোতাদেরকে ও আগ্রহী অন্য সকলকে নিজ উদ্যোগে অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে বলবো।
মোটামুটিভাবে বলা চলে যে, রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় ও এরপর তাঁর অবশিষ্ট জীবনকালে মুসলমানদের মধ্যে এমন বেশ কিছু লোক ছিলো যারা ইসলামকে মনেপ্রাণে কবুল করে নি, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা মুসলমানদের দলে শামিল হয়ে গিয়েছিলো এবং ইসলাম গ্রহণের কথা স্বীকার করেছিলো। এ প্রসঙ্গে কোরআন মজীদে বিভিন্ন আয়াত রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সূরাহ্ আল্-মুনাফিকুন্ নামে একটি সূরাহ্ও রয়েছে। এছাড়া ইসলামে বিভিন্ন প্রসঙ্গে মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এরা ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করে, এমনকি এ ব্যাপারে শপথ করে থাকে, কিন্তু তারা তাদের এ ঘোষণার ক্ষেত্রে মিথ্যা বলছে।
আল্লাহ্ তা’আলা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন ঃ “(হে রাসূল!) মুনাফিকরা যখন আপনার কাছে আসবে তখন তারা বলবে ঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, অবশ্যই আপনি আল্লাহ্র রাসূল। আর আল্লাহ্ তো জানেই যে, অবশ্যই আপনি তাঁর রাসূল। তবে আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।” এ পুরো সূরাহ্টিতে এবং আরো অনেক আয়াতে এ গোষ্ঠীটির অস্তিত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে ও আলোচনা করা হয়েছে। আর এরা হচ্ছে এমন সব গোষ্ঠী যারা মুসলমানদের সাথে মিশে গিয়েছিলো এবং নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করতো।
প্রকৃত পক্ষে এরা ঈমান আনে নি। আর যারা দুর্বল ঈমানের অধিকারী ছিলো এবং যাদের ঈমান ছিলো টলটলায়মান কোরআন মজীদ অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকেও মুনাফিক বলে গণ্য করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, এক জায়গায় মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে ঃ “আর তারা নামাযে আসে কেবল দায়সারাভাবে।” আরো এরশাদ হয়েছে ঃ “তারা খুব কমই আল্লাহ্কে স্মরণ করে।”
মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা অন্য লোকদের সাথে মসজিদে আসে এবং নামায আদায় করে, কিন্তু তা করে আলসেমির সাথে ও দায়সারাভাবে। কিন্তু তাদের অন্তর সাধারণতঃ আল্লাহ্র প্রতি মনোযোগী থাকে না। তারা কদাচিৎ আল্লাহ্কে স্মরণ করে। মোট কথা, তাদের কিছুটা মনোযোগ আছে, তবে তা খুবই কম। কোরআন মজীদে এ মর্মে বেশ কিছু আয়াত আছে যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কোরআন মজীদ দুর্বল ঈমানের অধিকারী লোকদেরকে _ যাদের ঈমান নূ্যনতম প্রয়োজনীয় মাত্রায় উপনীত হয় নি, তাদেরকে মুনাফিক হিসেবে গণ্য করেছে।
আমি বলতে চাই না যে, এই গোষ্ঠীটি কারা ছিলো। মুনাফিক সংক্রান্ত আয়াতগুলো কাদের সম্পর্কে প্রযোজ্য ছিলো আমি সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে চাই না। কারণ, তাদের প্রতি সুনির্দিষ্টভােেব অঙ্গুলি নির্দেশ না করার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর অন্যতম কারণ এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য যথষ্ট সময়ের প্রয়োজন।
এখান থেকে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে উল্লেখ করতে চাই যে, মুসলমানদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী ছিলো তারা যারা মক্কা বিজয়ের পরে মুসলমান হয়েছিলো। কিন্তু তাদের অনেক দুশমনী ও ঈর্ষা সত্ত্বেও হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাদের সাথে দয়াদর্্র আচরণ করেন এবং এদেরকে “তুলাক্বা” তথা ‘যুদ্ধবন্দিত্ব থেকে মুক্তকৃত’ নামকরণ করেন। বনী উমাইয়্যার অনেক লোকই ছিলো এ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এরা মুসলমানদের মধ্যে ছিলো, মুসলমানদের সাথে ওঠাবসা ও বিবাহ-শাদী করতো, কিন্তু এদের অনেকেই মনেপ্রাণে ঈমান আনে নি। তারা যে ঈমান আনে নি শুধু তা-ই নয়, বরং তারা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর প্রতি বিদ্বেষ ও হিংসা পোষণ করতো। আল্লাহ্ বলেন ঃ “আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহ থেকে লোকদেরকে যা দিয়েছেন তারা কি সে জন্য তাদেরকে হিংসা করে?”
এদের মধ্যে একাংশ ছিলো কুরাইশ বংশের লোক। আমি সরাসরি তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না, কিন্তু এ ব্যাপারে দলীল-প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে যে, আযানের মধ্যে যখন হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নাম ঘোষণা করা হতো তখন এরা অসন্তুষ্ট হতো। এদের মধ্যে কুরাইশদের দু’টি শাখাগোত্র অন্তর্ভুক্ত ছিলো যারা বংশীয় সম্পর্কের দিক থেকে আরব রীতি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)কে ‘চাচাতো ভাই’ বলতো। তারা বলতো ঃ “এই চাচাতো ভাইয়ের অবস্থাটা দেখো; সে ছিলো একজন ইয়াতিম এবং এক দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছে, কিন্তু এখন এমন এক জায়গায় পেঁৗছে গেছে যে, তার নাম আল্লাহ্র নামের পাশে উচ্চারণ করা হয়!” এভাবে তারা তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতো।
কিন্তু এই লোকদেরই অনেকে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ওফাতের পর প্রায় পঁচিশ বছর যাবত ইসলামী সমাজে বিভিন্ন পদমর্যাদার অধিকারী হয়। এরপর আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর শাসনের পালা এলো। আপনাদের যেমন জানা আছে, আমীরুল মু’মিনীন (আঃ) বাহ্যিকভাবে হুকুমাতের অধিকারী হওয়ার বেশ আগেই মু’আবিয়াহ্ দ্বিতীয় খলীফাহ্ কর্তৃক শামের প্রাদেশিক গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং সেখানে প্রাদেশিক হুকুমাত পরিচালনা করে আসছিলেন। এরপর তৃতীয় খলীফাহ্ও তাঁকে সে পদে বহাল রাখেন এবং তাঁর হাতকে অনেক বেশী সমপ্রসারিত করার সুযোগ দেন। কারণ, তিনি শুধু বনী উমাইয়্যার লোকই ছিলেন না, তৃতীয় খলীফার আত্মীয়ও ছিলেন।
মু’আবিয়াহ্ শামে নিজস্ব প্রশাসন গড়ে তোলেন। তাঁর সুবিধা ছিলো এই যে, শাম ছিলো মদীনা ও মদীনাবাসীদের থেকে অনেক দূরে। শামের লোকেরা ছিলো নও মুসলিম এবং শাম রোম সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হতো। রোমানদের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিলো এবং তাদের মধ্যকার অনেকেই রোমানদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতো। তারা ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভের জন্য যথেষ্ট সময় ও সুযোগ লাভ করে নি। একদিকে ভৌগোলিক বিচারে যেমন তারা ইসলামের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরে ছিলো, অন্যদিকে যিনি দুই দশকেরও বেশী কাল এদের ওপর হুকুমত করেছিলেন তিনি চাইতেন না যে, তারা ইসলামের যথার্থ শিক্ষা লাভ করুক। তিনি চাচ্ছিলেন তাদের ওপর কর্তৃত্ব করবেন, বাদশাহী করবেন। তাই তাদের ঈমান আছে কি নেই তাতে তাঁর কিছুই আসতো যেতো না।
এরপর আমীরুল মু’মনীন হযরত আলী (আঃ) যখন বাহ্যিক খেলাফতে অধিষ্ঠিত হলেন তখন তারা বিদ্রোহ করতে শুরু করলো। আর এজন্য ছুতা বের করা হলো এই যে, আলী ওসমানের হত্যাকারী। এর ভিত্তিতেই তারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
এখানে আমি ইতিহাসের এ যুগসন্ধিক্ষণের ঘটনাবলীর প্রতি কেবল ইশারা করবো।
তারা একটা সময় হযরত আলী (আঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটালো। তারা আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন, গোত্র ও সাবেক ইসলাম-পূর্ব যুগের বন্ধুবান্ধব ও মুরুব্বীদের সহযোগিতায় বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে সিফফীন্ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হলো। প্রকৃত পক্ষে এ যুদ্ধের সমাপ্তিতে আমীরুল মু’মিনীন (আঃ) ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং তা সম্ভব হয় খারেজীদের ভূমিকার কারণে। খারেজীরা হুকুমাত ও খেলাফত প্রশ্নে বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের অবতারণা করে। শেষ পর্যন্ত আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ) খারেজীদের হাতে শহীদ হলেন।
এরপর হযরত ইমাম হাসান (আঃ) ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর পালা এলো। হযরত আলী (আঃ) যে আন্দোলন ও সংগ্রামের সূচনা করে যান তাঁরা তা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কিছুদিন পরই মু’আবিয়াহ্ ক্ষমতা দখলের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন এবং তিনি এমন কাজ করেন যার ফলে হযরত ইমাম হাসান (আঃ) তাঁর সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হন।
এখানে আমরা মূল ঘটনার বেশ কাছাকাছি চলে আসি। এখান থেকে মু’আবিয়াহ্ খুবই দক্ষতার সাথে চক্রান্ত করেন। আমরা যদি সেই যুগের ও তার পূর্ববর্তী যুগ সমূহের কয়েক জন রাজনীতিকের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করতে চাই তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, এদের চিন্তাশক্তি খুব কাজ করতো এবং এরা ছিলো সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সর্বাধিক প্রভাবশালী লোক। শয়তানী রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা বিরাট প্রতিভার অধিকারী ছিলো। আর মু’আবিয়াহ্ ছিলেন এদেরই অন্যতম।
আমি এখানে মূল ঘটনার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে এসব উল্লেখ করছি। কিন্তু আমরা যদি বিস্তারিতভাবে এটা প্রমাণ করতে যাই তাহলে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এতদসংক্রান্ত কতক দলীল-দস্তাভেয নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করতে হবে।
সে যা-ই হোক, মু’আবিয়াহ্ এ উপসংহারে উপনীত হন যে, তাঁর অনুকূলে যে ক্ষেত্র তিনি পেয়েছেন তাকে স্বীয় হুকুমত শক্তিশালী ও সমপ্রসারিত করার জন্য কাজে লাগাবেন। তিনি নিজেকে খলীফাহ্ বলে দাবী করেন, কিন্তু তাঁর হুকুমাত ছিলো তৎকালীন রোম ও পারস্যের ন্যায় _ খসরু ও সীজারের রাজত্বের ন্যায় পুরোপুরি রাজতান্ত্রিক হুকুমাত। তিনি এ ধরনের রাজতান্ত্রিক হুকুমাত প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাই পোষণ করতেন।
সেখানে তখন যে ক্ষেত্রসমূহ বিদ্যমান ছিলো তাঁর পক্ষে স্বীয় লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তা কাজে লাগানো সম্ভব ছিলো। এসব ক্ষেত্রের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলো সেখানকার জনগণের নিম্ন স্তরের সংস্কৃতি।
যদিও এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইসলামের আবির্ভাব ও প্রসার লাভের পর বেশ কয়েক দশক অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সাংস্কৃতিক উন্নয়ন এমন কোনো ব্যাপার নয় যে, এত সহজেই তা মদীনা থেকে শামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে এবং জনগণের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করবে, সকলেই ইসলামী সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিবান হয়ে উঠবে ও তাদের জ্ঞানের স্তর সমু্ন্নত হবে। যেহেতু মু’আবিয়ার মতো ব্যক্তি আঞ্চলিক হুকুমাতের শীর্ষে অধিষ্ঠিত ছিলেন সেহেতু এটা সহজে হওয়া সম্ভব ছিলো না। মোট কথা, তিনি যে ক্ষেত্রটির ওপর গুরুত্ব দিতেন তা হচ্ছে সেখানকার জনগণের সাংস্কৃতিক নিম্ন মান। এই ক্ষেত্রটিই তাদের গোটা জীবনধারার চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতো। এই একই কারণে তাদের মধ্যে গোত্রপতির প্রাধান্য ছিলো; গোত্রপতি যখন কোনো কাজে অগ্রসর হতো তখন বা কোনো কাজ সম্পাদন করতো তখন খুব সহজেই গোত্রের সকলে, অন্ততঃ অধিকাংশ মানুষ তার অনুসরণ করতো। ভালো ও মন্দ উভয় ক্ষেত্রেই এর প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে।
কোনো গোত্রের প্রধান যখন হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করতো তখন সে গোত্রের সকল লোকই খুব সহজেই ইসলাম গ্রহণ করতো। আর কেউ যদি মুরতাদ হতো তথা ইসলাম ত্যাগ করতো _ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ওফাতের পরে যেমন এরূপ বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছিলো, সে ক্ষেত্রেও এমনই ঘটতো। কোনো গোত্রের নেতা যখন মুরতাদ হতো তখন সে গোত্রের লোকেরা তার অনুসরণে ইসলাম পরিত্যাগ করতো। এভাবে লোকেরা যে গোত্রপতিদের অনুসরণ করতো মু’আবিয়াহ্ এ বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং তাদের এ বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগাতেন।
তৃতীয় বিষয়টি ছিলো লোকেদের, বিশেষ করে শামের লোকদের ঈমানের দুর্বলতা। সেখানে লোকদেরকে ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়ার কেউ ছিলো না। এমনকি খোদ মদীনায় লোকেরা স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নিকট থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ওফাতের সাথে সাথেই লোকেরা গাদীরের ঘটনা ভুলে গেলো। অতএব, শামের ব্যাপারে তো প্রশ্নই ওঠে না যেখানকার লোকদের অজ্ঞতা সম্পর্কে ইতিহাসে অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা লিপিবদ্ধ রয়েছে।
তৎকালে শামের লোকদের এ অবস্থা ছিলো মু’আবিয়ার জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তিনি ভালোভাবেই যা কাজে লাগান। জনসাধারণের অজ্ঞতা, তার সংস্কৃতির নিম্ন মান এবং গোত্রীয় মানসিকতার প্রাধান্য তথা লোকদের অন্ধভাবে গোত্রপতির অনুসরণ এবং আরো কতক বিষয়কে তিনি কাজে লাগান ও এসব ক্ষেত্রের ওপরে কাজ করেন।
হ্যা, এ উপাদানগুলো কোনো নতুন বিষয় ছিলো না। কিন্তু মু’আবিয়া এগুলোর সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন এবং খুব ভালোভাবেই এগুলোকে কাজে লাগান। প্রাচীনতম কাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক নেতারাই সাধারণতঃ এ তিনটি উপাদান তথা হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়েছেন।
এ পর্যায়ের প্রথম উপাদান বা হাতিয়ার হচ্ছে প্রচার। তাঁরা প্রচারের মাধ্যমে জনমতকে পরিবর্তিত করে তাঁদের বাঞ্ছিত দিকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। এটা হচ্ছে একটি সাধারণ হাতিয়ার, তবে যেহেতু বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বিভিন্ন সমাজের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে সেহেতু প্রতিটি সমাজ ও সংস্কৃতিতে প্রচার-হাতিয়ারকে কাজে লাগানোর ধরনের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।
তৎকালে ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরে প্রচারের ক্ষেত্রে আজকের দিনের মতো মানবতাবাদ, বহুমত তত্ত্ব বা মানবাধিকারের বিষয়গুলো আলোচ্য বিষয় ছিলো না। তখন এসব বিষয়ে কেউ কথা বললে তা কেউ শুনতো না। কারণ, তখন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত ছিলো। লোকেরা আল্লাহ্ ও রাসূলে বিশ্বাসী ছিলো। তখন বিভিন্ন ধরনের কি্বরা’আত ও এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় নিয়ে বিতর্কের গুরুত্ব ছিলো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখন এমন অনেক উপাদান ছিলো যেগুলোকে প্রচারের কাজে ব্যবহার করা যেতো।
এসব উপাদানের মধ্যে অন্যতম ছিলো কবিতা ও সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা। আরবদের মধ্যে, বিশেষ করে তৎকালীন আরবদের মধ্যে কবিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের অধিকারী ছিলো। আপনাদের জানা আছে যে, মু’আবিয়াহ্ বিখ্যাত কবিদেরকে, শীর্ষস্থানীয় কবিদেরকে কাজে লাগাতেন। এ কবিরা মু’আবিয়ার প্রশংসা করে ও তাঁর বিরোধীদের নিন্দা করে কবিতা রচনা করেন এবং সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। সম্ভবতঃ এই সব শীর্ষস্থানীয় কবিদের মধ্যে একজন খৃস্টান কবি ছিলেন যিনি ছিলেন অত্যন্ত সুদক্ষ একজন কবি। তিনি তাঁর অনেক শিষ্যকে কবিতার প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি মু’আবিয়ার এ প্রচারাভিযানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর এই শিষ্যদের মধ্যে যাদের ইসলামের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিলো তাঁরা কোরআন ও হাদীছ নিয়ে চর্চা করতেন। তিনি এমন লোকদের শক্তিশালী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন যারা হাদীছ তৈরী করবেন।
এসব হাদীছ রচয়িতাদের মধ্যে আবু হোরায়রা সবিশেষ বিখ্যাত ছিলেন। স্বয়ং আহ্লে সুন্নাতের ওলামায়ে কেরাম তাঁর সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং লিখেছেন যে, তিনি মিথ্যা হাদীছ রচনা করতেন এবং তা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নামে চালিয়ে দিতেন। হ্যা, সরলমনা লোকেরা এসব মিথ্যা হাদীছকে খুব সহজেই বিশ্বাস করতো।
তেমনি সে যুগে যারা ক্বারী হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন তাঁরাও সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের অধিকারী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, কোরআন মজীদের তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে কি সুরকে প্রাধান্য দেয়া হবে নাকি তাজভীদকে প্রাধান্য দেয়া হবে এটা খুবই গুরুত্ব বহন করতো এবং ক্বারীগণ বিরাট মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তৎকালে ওলামায়ে দ্বীনের জন্য ক্বারী হওয়া ছিলো অপরিহার্য। তাঁরা কোরআন সম্বন্ধে ভালোভাবে জ্ঞান রাখতেন এবং কোরআনের তাফসীর করতেন। যারা কোরআনের তাৎপর্য লিপিবদ্ধ করতেন তাঁরা হাফেযে কোরআন ছিলেন। তাঁরা এ ধরনের মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
মু’আবিয়াহ্ এই তিন গোষ্ঠীকে অর্থাৎ ক্বারী, কবি ও হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে বিশেষভাবে কাজে লাগান। এভাবে তিনি সুসংগঠিত ও সর্বাত্মক প্রচারযন্ত্রকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগান।
হ্যা, এরা ছিলেন মুষ্টিমেয় সংখ্যক বিশিষ্ট লোক। সকলে তো আর কবি ছিলেন না, সবাই তো আর ক্বারী বা হাদীছ বর্ণনাকারী ছিলেন না। তাই তিনি তাঁদের পাশাপাশি গোত্রপতিদেরকে ব্যবহার করেন। তিনি গোত্রপতিদেরকে প্রলোভনের মাধ্যমে স্বপক্ষে নিয়ে আসেন। তিনি তাদেরকে বিভিন্ন পদ প্রদান করেন, উপহার দেন, পুরস্কার দেন। অনেককে ভারী এক থলি করে স্বর্ণ প্রদান করেন। আজকের দিনেও আমাদের কাছে একটি স্বর্ণমুদ্রা মূল্য বহন করে। সে ক্ষেত্রে হাজার দীনার স্বর্ণমুদ্রার থলি বা দশ লক্ষ দীনার স্বর্ণমুদ্রার কথা মুখে উচ্চারণ করা সহজ বটে, কিন্তু একজন গোত্রপতির জন্য যখন এমন পরিমাণের স্বর্ণমুদ্রা পাঠানো হয় তখন এমন কোনো গোত্রপতি কদাচিৎ পাওয়া যেতে পারে যে এর সামনে মাথা নত না করবে।
মু’আবিয়াহ্ এভাবেই গোত্রপতিদেরকে ক্রয় করে নেন এবং অন্যদেরকে ভীতি প্রদর্শন ও হুমকির মাধ্যমে অনুগত হতে বাধ্য করেন। যারা মু’আবিয়ার বিরোধিতা করতো তাদের সম্পর্কে কেউ এসে খারাপ রিপোর্ট দিলে সাথে সাথে তিনি তাকে ধরে আনাতেন, প্রহার করতেন, কারাগারে নিক্ষেপ করতেন, এমনকি হত্যা করতেন।
অর্থাৎ কবি, হাদীছ বর্ণনাকারী ও ক্বারীদের মাধ্যমে প্রচার, গোত্রপতি ও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে প্রলোভন প্রদান এবং অন্যান্য লোকদেরকে ভীতি প্রদর্শন _ মু’আবিয়াহ্ এই তিনটি পদ্ধতিকে কাজে লাগান।
হযরত ইমাম হাসান (আঃ)-এর নিকট থেকে খেলাফত নিয়ে নেয়ার পর প্রায় বিশ বছর মু’আবিয়াহ্ শামের সমাজকে উক্ত তিনটি উপদানের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি এ উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে তাঁর পসন্দের ক্ষেত্র তৈরী করেন ও শাসনকার্য পরিচালনা করেন _ যে সম্পর্কে একটু আগে আভাস দেয়া হলো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এর ফল কী দাঁড়ালো? মু’আবিয়ার অনুসৃত এ নীতির ফলে সেখানকার লোকদের অবস্থা কী দাঁড়ালো? এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার মতো এখানে অবকাশ নেই। তাছাড়া এর সকল দিক সম্পর্কে আমার বিস্তারিত জানাও নেই যে বলবো। এ ব্যাপারে যে বিস্তারিত অধ্যয়ন করে এসে আপনাদের সামনে পেশ করবো সে জন্যও হাতে যথেষ্ট সময় নেই।
আপনারা বহু বার শুনেছেন যে, আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর শাহাদাতের পর অর্থাৎ মোটামুটি হিজরী চলি্লশ থেকে ষাট সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বিশ বছরে মু’আবিয়াহ্ তাঁর মনের মতো করে সমাজকে তৈরী করে নেন। অবশ্য এর পূর্ববর্তী বিশ বছরে তথা দ্বিতীয় খলীফার সময় থেকে হযরত আলী (আঃ)-এর শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এজন্য ক্ষেত্র তৈরী করে রেখেছিলেন।
মু’আবিয়াহ্ অভিজ্ঞতার অধিকারী ছিলেন। তিনি লোক বাছাই করেন, তাদেরকে পরীক্ষা করেন এবং শেষ পর্যন্ত এ তিনটি উপাদান বা হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে তাঁর পরিকল্পনা কার্যকর করার পদক্ষেপ নেন।
মু’আবিয়াহ্ তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে উপনীত হলেন। তিনি চাচ্ছিলেন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন, শাসন ক্ষমতাকে তাঁর বংশধরদের জন্য স্থায়ী করে যাবেন। তাঁর মন চাচ্ছিলো ইয়াযীদকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যাবেন। কিন্তু তিনি জানতেন যে, ইয়াযীদের খেলাফতের দায়িত্ব পালনের মতো যোগ্যতা নেই। তাই এ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য তিনি সেই লোকদেরকে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেন যাদেরকে তিনি নিজের স্বার্থে কাজে লাগাবার জন্য গড়ে তুলেছিলেন।
মু’আবিয়াহ্ ইয়াযীদের উদ্দেশে অছিয়্যাত্ করেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর অছিয়্যাতে বলেন ঃ “আমি তোমার বাদশাহীর জন্য এমনভাবে ক্ষেত্র তৈরী করেছি যে, অন্য কারো পক্ষেই তাদের সন্তানদের রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য এমনটা করা সম্ভব ছিলো না। তোমার জন্য হুকুমত প্রস্তুত হয়ে আছে, তুমি তাতে অধিষ্ঠিত হবে, তবে কয়েকটি শর্ত আছে।” তিনি মদীনা ও হেজাযের জনগণের ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দেন এবং বলেন যে, তাদের সাথে এ ধরনের আচরণ করবে। আর ইরাকের জনগণের সাথে ভিন্ন এক ধরনের আচরণের জন্য নির্দেশ দেন। তিনি বলেন ঃ “ইরাকীরা চায়, প্রতিদিনই তাদের গভর্নর পরিবর্তন হোক। তারা যদি প্রতিদিন তাদের গভর্নর পরিবর্তন করতে বলে তাহলে তা-ই করবে। তোমার বিরুদ্ধে এক লক্ষ তরবারী কোষমুক্ত হবার চাইতে এটাই তোমার জন্য উত্তম।”
হেজাযের লোকদের সম্বন্ধে মু’আবিয়াহ্ তাঁর অছিয়্যাতে বলেন ঃ “হেজাযের লোকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো। তারা নিজেদেরকে ইসলামের প্রকৃত অভিভাবক মনে করে। তাদের মধ্য থেকে যারাই আসবে তাদেরকে সসম্ভ্রমে আপ্যায়ন করো। তারা যা জানতে চাইবে তার জবাব দেবে। তাদের সুখদুঃখের খোঁজখবর নেয়ার জন্য লোক পাঠাবে।”
ইয়াযীদকে এসব নছিহত করার পর মু’আবিয়্যাহ্ বলেন ঃ “কয়েক জন লোক আছে যারা সহজে তোমার বশ্যতা স্বীকার করবে না। এরা হলো ইবনে আবু বকর, ইবনে ওমর, ইবনে যুবায়ের ও ইবনে আলী। এদের মধ্যে তিনজন খলীফার পুত্র। আর একজন যুবায়েরের পুত্র, আর যুবায়ের ছিলেন রাসূলের সেই ছয়জন ছাহাবীর অন্যতম যাদের নাম খেলাফতের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিলো। এ চারজনের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করবে।” এরপর তিনি এক এক করে বলেন যে, কার সাথে কী ধরনের আচরণ করতে হবে।
তিনজন সম্পর্কে বলার পর হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর প্রসঙ্গ আসে। মু’আবিয়াহ্ বলেন ঃ “হোসাইনের সাথে বরোধ করতে যেয়ো না। সম্ভব হলে তার কাছ থেকে বাই’আত গ্রহণের চেষ্টা করো। আর সে যদি তোমার অনুকূলে বাই’আত না হয় এবং তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাহলে তুমি তার ওপরে বিজয়ী হবে। তবে এর পরে তার সাথে দয়াদর্্র আচরণ করো। হোসাইনের সাথে বিরোধে লিপ্ত হওয়া তোমার জন্য কল্যাণকর হবে না। এমনকি ঘটনা যদি যুদ্ধ পর্যন্তও গড়ায় এবং যুদ্ধে যদি তুমি বিজয়ী হও, তাহলেও হোসাইনের সাথে দুর্ব্যবহার করো না। কারণ, সে রাসূলের সন্তান (বংশধর)। সে জনগণের মধ্যে অত্যন্ত মজবুত অবস্থানের অধিকারী। তার ব্যক্তিত্ব ও অন্যদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।”
মু’আবিয়াহ্ ইয়াযীদকে এসব নছিহত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর নছিহত অনুযায়ী কাজ হয় নি। ইয়াযীদ খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর সাথে সাথে হুকুম দিলো ঃ “এই কয়েক জনের কাছ থেকে বাই’আত আদায় করো, আর তারা বাই’আত না হলে তাদের শিরচ্ছেদ করো।”
ইতিহাসে যেরূপ উদ্ধৃত হয়েছে, ইয়াযীদ হযকে ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিকট থেকে বাই’আত্ আদায়ের জন্য মদীনার গভর্নরের কাছে পত্র লিখে পাঠালো।
এখানে এ ব্যাপারে বিস্তারিত উল্লেখ করতে চাই না। এসব ঘটনা আপনারা বহু বার শুনেছেন। তরুণরা হয়তো খুব বেশী শোনে নি। তা সত্ত্বেও এখানে ইতিহাস বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে চাই না, বরং ঘটনার পর্যালোচনা করতে চাচ্ছি যে, এমন কী ঘটলো যে, এত অল্প সময়ের মধ্যে লোকেরা ইসলাম থেকে হাত গুটিয়ে নিলো এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নাতিকে হত্যা করলো? রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সেই প্রিয় নাতি যিনি ছিলেন সকলেরই প্রিয়। এমনকি যারা তাঁর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখতো তারাও তাঁকে ভালোবেসে ফেলতো। যারা তাঁর আচরণ দেখতো তারা তাঁর আচরণকে ভালোবেসে ফেলতো। কেউ যদি তাঁর কাছে কিছু চাইতো, বর্ণিত আছে যে, তিনি তাকে এমনভাবে তা দিতেন যে, সে বলতো, তাঁর সামনে পড়লে লজ্জিত হই। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নাতি এহেন ব্যক্তিকে কেন এমন পৈশাচিকভাবে, অমানুষিকভাবে তারা হত্যা করলো?
আমি যে এ কথাগুলো বললাম এর পিছনে আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা। আপনারা লক্ষ্য করুন, সে সমাজের সংস্কৃতি কী ধরনের সংস্কৃতি ছিলো? তখনকার জনগণ কী ধরনের মানুষ ছিলো? প্রকৃত ঈমানদারগণ _ ঈমান যাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে পেঁৗছে গিয়েছে এমন লোকের সংখ্যা শুধু ঐ যুগেই কম ছিলো না, সকল যুগেই কম ছিলো এবং সব সময়ই কম থাকবে।
জনগণের নেতার বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি সমাজের মধ্যম চৈন্তিক স্তরের লোকদের চিন্তা ও আকিদাহ্-বিশ্বাসকে উন্নততর করার চেষ্টা করেন। মধ্যম চৈন্তিক স্তরের লোকদেরকে তিনি উন্নততর চৈন্তিক স্তরে তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কার্যতঃ তা সম্ভব হয় না। তাই একজন যোগ্য নেতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তিনি সমাজের মধ্যম চৈন্তিক স্তরের লোকদের চিন্তা-চেতনাকে কল্যাণের দিকে পরিচালিত করেন। তিনি চেষ্টা করেন এরা যেন প্রতিদিন এক সেন্টিমিটার করে হলেও সত্যের অধিকতর কাছাকাছি হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও যে মু’মিনদেরকে কোনো পরিস্থিতিই পরিবর্তন করতে পারে না তাদের সংখ্যা খুবই কম; সে যুগেও তাঁদের সংখ্যা খুবই কম ছিলো।
মু’আবিয়াহ্ লোকদের এ দুর্বলতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দুর্বলতা, ঈমানের দুর্বলতা ও জ্ঞানের অগভীরতাকে কাজে লাগিয়ে এবং প্রচার, প্রলোভন ও হুমকি _ এই তিন হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে লোকদেরকে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। এহেন এক পরিস্থিতিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ), হযরত ইমাম হাসান (আঃ) বা অন্য কোনো ইমাম যদি মু’আবিয়ার সাথে বিরোধ বাধাতে যেতেন তাহলে সরকারীভাবে গুপ্ত ঘাতক লাগিয়ে তাঁদেরকে হত্যা করানো হতো, তাঁদের বিরুদ্ধে কতগুলো মিথ্যা দুর্নাম তৈরী করা হতো এবং সরকারী প্রচার ব্যবস্থার মাধ্যমে তা প্রচার করা হতো, তাঁদের বিরুদ্ধে কবিতা লেখা হতো, মিথ্যা হাদীছ রচনা করা হতো। এছাড়া কতক দরবারী ওয়ায়েয ছিলো, দরবারী আলেম ছিলো; তারা লোকদেরকে গোমরাহ্ করার কাজে নিয়োজিত ছিলো। বস্তুতঃ সর্বত্র ও সব সময়ই, বিশেষ করে একটি দ্বীনী সমাজে _ যেখানে সাধারণ মানুষ আলেমদের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেখানে লোকদেরকে গোমরাহ্ করার ব্যাপারে এই দরবারী আলেমদের ভূমিকা থাকে বিরাট।
কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে যে, যে কোনো ধর্মে যে সব অনৈতিকতা ও মতানৈক্য প্রবেশ করেছে তা এই ধরনের লোকদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে ঃ “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারা তাদের কাছে প্রকৃত জ্ঞান এসে যাওয়ার পরে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষবশতঃ ব্যতীত এ ব্যাপারে মতানৈক্যে লিপ্ত হয় নি।”
প্রকৃত পক্ষে পাপাচার, অনাচার, অনৈতিকতা, মতানৈক্য, বিশৃঙ্খলা, বিকৃতি ও ফিৎনাহ্ সেই সব লোকদের দ্বারা তৈরী হয়েছে যারা পথঘাট চিনতো; তারা ছিলো এমন চোর যারা বাতি হাতে নিয়ে চুরি করতে এসেছিলো। আর মু’আবিয়ার মতো শাসকগণ এদেরকে চিহ্নিত করেন এবং অর্থকড়ি দিয়ে তাদের খরিদ করে নেন, তাদেরকে প্রলুব্ধ করেন। আর কেউ যদি সাহসের পরিচয় দিতেন তিনি তাঁর বিরুদ্ধে হুমকি ও হত্যার আশ্রয় নিতেন, ঠিক যেভাবে হযরত আলী (আঃ)-এর সঙ্গীসাথীদেরকে একের পর এক হত্যা করা হয় বা কোনো না কোনো বাহানায় ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ‘আদী, মাইছাম্ বিন্ তাম্মার্ ও অন্য আরো যারা মজবুত ঈমানের অধিকারী ছিলেন তাঁদের মধ্য থেকে কারো ওপরেই ঐ তিনটি হাতিয়ারের কোনোটিই কাজ করে নি। শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে প্রকাশ্যে কোনো না কোনো বাহানায় এবং কাউকে কাউকে গোপনে গুপ্ত ঘাতকের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।
এ সবের ফল হলো এই যে, লোকেরা ইসলামের হুকুম-আহকাম থেকে বিচু্যত হয়ে পড়ে। এমনকি তারা তাদের দ্বীনী আবেগ-অনুভূতি সমূহ, এমনকি কওমী রীতিনীতি সমূহ, পূর্বপুরুষদের চরিত্র-অভ্যাস, উপজাতীয় ও গোত্রীয় রীতিনীতি সমূহ এবং আতিথেয়তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেললো। এ ক্ষেত্রে মু’আবিয়াহ্ ঐ তিনটি হাতিয়ারকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। আর আমরা দেখতে পাই যে, সকল যুগে এই তিনটি হাতিয়ারই ছিলো সমাজে পাপাচার, অনাচার, অনৈতিকতা, দুর্নীতি, ফিৎনাহ্ ও বিকৃতির মূল কারণ এবং এখনো তা-ই, আর ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে।
আমরা যদি কেউ আশূরা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে চাই তাহলে আমাদের এভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে; আমাদের স্মরণ করতে হবে, যারা হোসাইন (আঃ)কে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কাছে দেখেছেন তাঁরা দেখেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মিম্বারে বসা থাকা অবস্থায় হোসাইন যখন মিম্বারের ধাপ বেয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করেন তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) নিজে নীচে নেমে আসেন, তাঁকে কোলে তুলে নেন; তিনি হোসাইনের কান্না সহ্য করতে পারতেন না। তিনি হোসাইন সম্পর্কে লোকদেরকে অনেক নছিহত করেন এবং আরবদের মধ্যকার এই লোকেরা তখনো বেঁচে ছিলো, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা হোসাইনের সাথে এ ধরনের আচরণ করলো।
আজকের দিনেও কেউ যদি ইসলামী সমাজকে পথভ্রষ্ট করতে চায় তাহলে প্রচার, প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন এই তিনটি হাতিয়ার ব্যবহার করা ছাড়া তার সামনে অন্য কোনো পথ আছে কি? তারা কি অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করবে? আপনারা মনে করবেন না যে, কেউ যদি ইসলামী বিপ্লবের রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে চায় তাহলে নিশ্চয়ই দুনিয়ার অন্য কোনো প্রান্ত থেকে এখান ছুটে আসবে। না, বরং এখানেই, দেশের ভিতরেই মুনাফিকরা রয়েছে এবং তারা ঠিক সে কাজই করবে ইসলামের প্রথম যুগের মুনাফিকরা হযরত ইমাম হোসাইনের (আঃ) সাথে যা করেছিলো।
ঐ সময়ও এর কোনো প্রয়োজনই ছিলো না যে, রোম ও পারস্য থেকে এসে, চীন ও অন্য কোনো জায়গা থেকে এসে এ কাজ করবে। বরং হোসাইনের সেই ‘চাচাতো ভাইয়েরা’, তাঁর ঘনিষ্ঠ ‘চাচাতো ভাইয়েরা’ অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে, তাঁর বংশের লোকেরা, কুরাইশ বংশের লোকেরাই এজন্য যথেষ্ট ছিলো। তাঁর ‘চাচাতো ভাইয়েরা’ ছিলো বনী উমাইয়্যাহ্ ও বনী হাশেমের লোক। অন্য কোথাও থেকে আসার প্রয়োজন ছিলো না। তবে আজকে আমাদের বিপদের সাথে যা যোগ হয়েছে তা হলো এই যে, আজকের এদের সাথে বৈদেশিক সাহায্যও যুক্ত হয়েছে। তবে আসল ভূমিকা পালন করে তাদের অভ্যন্তরীণ এজেন্টরা। আপনারা মনে করবেন না যে, ইরানের বিপ্লবী হুকুমাতকে পথভ্রষ্ট করতে চাইলে অবশ্যই আমেরিকা সরাসরি পদক্ষেপ নেবে। বরং আমেরিকা অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোকে খুঁজে বের করবে ও তাদেরকে শক্তিশালী করবে। প্রচারের মাধ্যমে, আর্থিক সাহায্য দিয়ে এবং ক্ষেত্রবিশেষে অন্য ধরনের খাবার সরবরাহ করে তাদেরকে শক্তিশালী করবে। তারা ফিৎনাহ্ সৃষ্টি করবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, সন্ত্রাস ও গুপ্তহত্যার আশ্রয় নেবে।
সন্দেহ নেই যে, এই গুপ্তহত্যাগুলোর অনেকগুলোই মুনাফিকদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এই মুনাফিকরা কোত্থেকে এসেছে? এ মুনাফিকরা তো আর আমেরিকান নয়। এরা এই ইরানী সমাজ থেকেই উত্থিত হয়েছে। আর এদের অনেকেই ইসলাম সমর্থক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
যে নাস্তিকরা আজ ইসলামের বিরুদ্ধে ও হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর বিরুদ্ধে কথা বলে এবং বিদেশে গিয়ে সাক্ষাৎকার দেয়, তারা ইসলামী সমাজের অভ্যন্তর থেকেই আত্মপ্রকাশ করেছে এবং হয়তো এক সময় তারা ইমামের রক্ষক হিসেবে কাজ করে থাকবে। যারা ইমামকে অস্বীকার করে, যারা বলে যে, তিনি ঐতিহাসিক জাদুঘরে স্থানলাভ করবেন, এটা অপরিহার্য নয় যে, এ ধরনের লোকেরা আমেরিকা থেকে আসবে। তবে এর মানে এ নয় যে, আমেরিকা তাদেরকে স্বীকৃতি দেয় না।
এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে যে, আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী বা অন্যান্য ব্যক্তিত্ব, তাদের নিজেদের ভাষায়, ইরানে গণতন্ত্র প্রবর্তিত হলে ও সংবাদপত্র স্বাধীন হলে বা অন্য অনেক বিষয়ে খুশী হওয়ার কথা বলে? এর কারণ, তারা আশা করছে যে, একদিন আবার তারা ইরানে ফিরে আসতে পারবে, তারা আবার এখানে তাদের শয়তানী আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এর কারণ হচ্ছে কেবল সেই বিকৃতি ও পথভ্রষ্টতা যা এ দেশের আনাচে কানাচে এই ধরনের লোকদের মধ্যে তৈরী হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক এই যে, এ ধরনের লোক সরকারী প্রশাসন যন্ত্রেও অনুপ্রবেশ করেছ।
হোসাইন যে সত্যের প্রদীপ সে হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় খেদমত এই যে, তিনি লোকদের হৃদয়ে হেদায়াতের আলো প্রদান করছেন, তাদের জন্য পথকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছেন। আজকের যুগে হোসাইনের জ্যোতিকে এভাবেই কাজে লাগাতে হবে।
ইসলামের দুশমনরা যে পথে চলেছে ও হোসাইনকে হত্যা করেছে আজকের দিনেও তারা যুগের হোসাইনের বিরুদ্ধে সেই একই পথ অবলম্বন করতে চায়। যে পথ অনুসরণে তারা ইসলামকে পরিবর্তন করতে, বিকৃত করতে ও তার স্বকীয় পথ থেকে বিচু্যত করতে সক্ষম হয়েছিলো আজকেও তারা সেই একই পথ কাজে লাগাতে চায়। সাধারণ পথ এটাই। প্রচার, প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন _ অধম যতই চিন্তা করেছি এর বাইরে তাদের অনুসৃত চতুর্থ কোনো পথই খুঁজে পাই নি। অবশ্য এর বাইরেও বিভিন্ন ক্ষেত্র আছে এবং তারা এসব ক্ষেত্র ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে তারা যে হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করে থাকে তা এ তিনটিই।
আপনারা ভালো করে লক্ষ্য করুন, আজকের দুনিয়ায় ইসলামের দুশমনরা ইসলামের বিরুদ্ধে কী কাজ করে চলেছে? তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কোন্ প্রচারটা কমিয়ে দিয়েছে? কোন্ মিথ্যা দোষারোপ ও অপবাদ দেয়া সম্ভব হওয়া সত্ত্বেও তারা দিচ্ছে না? এই পত্রিকাগুলো _ যাদের বাজেটের অনেকাংশই বাইতুল মাল থেকে পূরণ করা হয় তারা এইসব দোষারোপ ও অপবাদ ছেপে বিপুল সংখ্যক কপি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের অনেক তরুণ-যুবকই অজ্ঞতার কারণে এদের প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। আপনারা কি মনে করছেন যে, এদের পাপের পরিমাণ সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর হত্যাকারীদের পাপের চেয়ে কম? এরা তাদের থেকে কোন্ দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে যে, এদের পাপ মু’আবিয়াহ্, তাঁর সহযোগীগণ ও তাঁর অনুসারীদের তুলনায় কম হবে? আজকের দিনে ধর্মের নামে যারা এদেরকে সাহায্য-সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে তাদের পাপের পরিমাণ কি আবু হোরায়রা ও তার মতো অন্য লোকদের পাপের চেয়ে কম?
আজকের দিনে বিশ্বে যেমন ইসলামের কথা আগের চেয়ে অনেক বেশী আলোচিত হচ্ছে, তেমনি এদের পাপের পরিমাণও আগের চেয়ে বেশী। আজ যারা ইসলামের খেদমত করছে আল্লাহ্র কাছে তাদের পারিশ্রমিক অনেক বেশী, তেমনি যারা খেয়ানত করছে তাদের পাপের মাত্রাও আগের চেয়ে বেশী। এর কারণ হচ্ছে কাজের আওতার ক্ষেত্রের ব্যাপকতা।
মু’আবিয়াহ্ যখন কর্তৃত্বের অধিকারী হন তখন এমন ধরনের অল্প সংখ্যক লোকের ওপর কর্তৃত্বের অধিকারী হন যারা পুরুষ উট আর মাদী উটকেও আলাদা করে চিনতে পারতো না। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, বুধবারে জুম’আর নামায পড়েছে। উমাইয়্যাহ্ বংশের মারওয়ানী ধারার একজন খলীফাহ্ মাতাল অবস্থায় নামায পড়ায়; সে ফজরের ফরয নামায চার রাক’আত পড়ায়। পরে যখন তাকে বলা হলো, ফজরের নামায দুই রাক’আত, তখন সে বললো ঃ “আজকে আমি বেশ আনন্দে আছি; তোমরা যদি চাও তাহলে আরো বেশী পড়বো।” সে ছিলো মাতাল। তৎকালে এ ধরনের লোকেরা হুকুমাত পরিচালনা করতো।
তবে যে তরুণ ও যুবকরা ইসলামী বিপ্লবের পরিবেশে গড়ে উঠেছে তাদেরকে প্রতারণা করা অতটা সহজ নয়। কিন্তু এ যুগের ইসলাম বিরোধীদের প্রতারণার কৌশল আরো অনেক বেশী জটিল। এখানে একটা বিষয় আপনাদের খেদমতে আরয করছি। আপনারা বিষয়টি জাহেলিয়্যাত যুগের ইতিহাসে খুঁজে দেখুন। অবশ্য আমি ইসলাম-পূর্ব যুগের ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্ত পাই নি, তবু দাবী করবো না যে, এ রকম ছিলো না। যেহেতু আমাদের জ্ঞান, বিশেষ করে ইতিহাসের জ্ঞান সীমিত। আপনারা কি আরবদের মধ্যে এমন কারো কথা জানেন যে নিষ্ঠুরতার দিক থেকে হার্মালার সমতুল্য? ছয় মাস বয়সী যে শিশুটি পিপাসার কারণে এমনিতেই তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছিলো সে এই শিশুটির গলায় তিন কাঁটাওয়ালা বিষ মাখা তীর নিক্ষেপ করলো। এর চেয়ে জঘন্য কোনো নরপিশাচ কি আপনারা খুঁজে পাবেন? আমার মনে হয় না যে, ইসলাম-পূর্ব যুগে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় না যে, ইসলাম-পূর্ব যুগে যত হিংস্র জীব যিন্দেগী যাপন করেছে তাদের মধ্যে এতখানি নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার অধিকারী আর কেউ ছিলো।
আমার মনে হয়, ইসলামের আবির্ভাব না ঘটলে এ ধরনের নিষ্ঠুর শয়তানদের _ ইয়াযীদের মতো, শীমারের মতো, হার্মালার মতো শয়তানদের আবির্ভাব ঘটতো না। এটা বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার। কোরআন যখন নাযিল হয় তখন তা মু’মিনদেরকে পথ প্রদর্শন করে, কিন্তু যালেমদের বেলা তাদের পাপাচার, অনাচার, বিকৃতি ও কুফ্র্ বৃদ্ধি পায়। তাদের ক্ষেত্রে তাদের পাপাচার আর কুফ্র্ ব্যতীত আর কিছু বৃদ্ধি পায় না। বৃষ্টি বর্ষিত হলে যেখানে ফুল জন্মে সেখানে ফুলগুলো অনেক বেশী সতেজ হয়ে ওঠে, তাদের খুশবুও বৃদ্ধি পায়, কিন্তু যেখানে বিষাক্ত উদ্ভিদ জন্মগ্রহণ করে সেখানে সেগুলো সতেজতর হয় এবং সেগুলোর বিষের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
একইভাবে ইসলামী সমাজে সালমানগণ, আবু যারগণ, ‘আম্মারগণ, মাইছাম বিন্ তাম্মারগণ গড়ে ওঠেন, সাঈদ বিন্ যুবাইরগণ গড়ে ওঠেন, এমন লোক গড়ে ওঠেন যারা আশূরার রাতে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)কে বলেন ঃ “যদি সত্তর বার নিহত ও জীবিত ও নিহত হই তারপরও আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি যে, আবারো আপনার রেকাবে থেকে শাহাদাত বরণ করি।” এই হলো এক দিক। আরেক দিকে সেই নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতা বিকাশলাভ করে। যারা এ খোদায়ী হেদায়াতকে পদদলিত করে, আল্লাহ্র এ রহমত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের নিষ্ঠুরতা, তাদের পৈশাচিকতা, তাদের প্রকৃত দুর্ভাগ্য বৃদ্ধি পায়।
ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হয়েছে, একদিকে তা এমন সব কুসুমকে লালন করেছে ইসলামের পুরো ইতিহাসে যার নযীর যদি না বলি যে, নেই, অন্ততঃ খুব কম আছে।
অধম স্বয়ং আরয করতে চাই যে, আমি যখন দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলাম এবং এরপর ইসলামের ইতিহাসের সাথে কিছুটা পরিচিত হলাম, তখন ইতিহাসের অন্যতম যে অধ্যায়টি আমাকে খুবই প্রভাবিত করে এবং আমাকে বিস্মিত করে তা হচ্ছে ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে হানযালাহ্কে গোসল দেয়ার ঘটনা। হানযালাহ্ নামক একজন যুবক বিবাহ করেছিলেন। বিবাহের রাত শেষ হলো, সকাল বেলা তিনি এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন, কিন্তু তিনি ফরয গোসল করার সময় পান নি। এ অবস্থায় তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন এবং শহীদ হয়ে গেলেন। হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) বললেন ঃ “আমি দেখতে পাচ্ছি, ফেরেশতারা আসমান থেকে পানি নিয়ে এসেছে এবং হানযালাহ্কে গত রাতের জানাবাতের জন্য গোসল করাচ্ছে।” এ কারণে তাঁর নামকরণ করা হয় ‘হানযালাহ্ গ্বাসীলুল্ মালায়েকাহ্’ অর্থাৎ ‘ফেরেশতাগণ কর্তৃক গোসল করানো হানযালাহ্’।
এ ঘটনাটি আমার কাছে খুবই বিস্ময়কর মনে হচ্ছিলো। এটা কী করে সম্ভব যে, একজন যুবক তার বিবাহের প্রথম রাত শেষ হতেই তার কুসুম শয্যা থেকে উঠে যায় এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, আর সেখানেই সে শাহাদাত বরণ করে! কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে এ ধরনের ‘হানযালাহ্ গ্বাসীলুল্ মালায়েকাহ্’র সংখ্যা শত শত, হাজার হাজার হয়ে দাঁড়ায়। এসব ‘হানযালাহ্ গ্বাসীলুল্ মালায়েকাহ্’র পদচুম্বন করার জন্য অসংখ্য কুসুম প্রস্ফূটিত হয়। আমাদের জাতির মধ্যে এমন কতই না শহীদ ছিলেন যারা আল্লাহ্র কাছে শাহাদাত কামনা করেছিলেন এবং দো’আ করেছিলেন যে, তাঁদের লাশ যেন খুঁজে পাওয়া না যায়।
আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে একজন দ্বীনী মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন যিনি বেশ কয়েক বছর রণাঙ্গনে থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর তিনি কমান্ডার পর্যায়ে উন্নীত হন, কিন্তু তখনো তিনি বিয়ে করেন নি। তিনি বলতেন যে, আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা এই যে, একটি সাইয়েদ বংশীয়া মেয়েকে বিয়ে করবো যাতে হযরত ফাতেমা যাহ্রা (আঃ)-এর সাথে মাহ্রাম হতে পারি। শেষ পর্যন্ত সাইয়েদ বংশীয়া একটি মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে ঠিক হলো; তিনি রণাঙ্গন থেকে এলেন এবং দশ হাজার তুমান ধার করে খুবই ছোটখাট অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিবাহ করলেন। বিবাহের পর তৃতীয় দিনে তিনি রণাঙ্গন ফিরে গেলেন এবং শহীদ হলেন। তিনি আল্লাহ্র কাছে দো’আ করেছিলেন যে, তাঁর লাশ যেন খুঁজে পাওয়া না যায় এবং এমনকি যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছর পরেও তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নি।
একদিকে যেমন এ ধরনের অসংখ্য কুসুম প্রস্ফূটিত হয়েছে, তরুণ ও যুবকরা একশ’ বছরের পথ এক রাতে অতিক্রম করেছে, অন্যদিকে এদের পাশাপাশি মুনাফিকরা ও নাস্তিকরা গড়ে উঠেছে শয়তানী ও নেফাকের ক্ষেত্রে যাদের সমতুল্য লোক ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই যে, বর্তমানে এরা সমাজে সসম্মানে জীবন যাপন করছে। কী করে এটা সম্ভব হলো? কারণ, প্রথম থেকেই তারা একটি প্রচার ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তারা কৌশল হিসেবে সহিংসতার নিন্দা করে এবং উদাসীনতার প্রচলন ঘটায়। তারা মানুষকে শিক্ষাগ্রহণ থেকে দূরে ঠেলে দেয় যাতে ইসলামের ভিত্তির ওপর হামলা হলে কেউ যেন তার বিরুদ্ধে টু শব্দটি না করে। কারণ, তাহলে তারা সহিংসতার সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবে, আর সহিংসতার তাত্তি্বকদেরকে ফাঁসি দিতে হবে।
এ হচ্ছে প্রচারযুদ্ধের প্রথম পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এখনো পূর্ণ মাত্রায় অব্যাহত রয়েছে। এ হচ্ছে সেই ভূমিকা মু’আবিয়াহ্ যা পালন করেছিলেন। আর বিশ্বের সকল শয়তানই _ যারা রাজনীতির খেলা খেলে থাকে তারা এ কাজই করে থাকে।
এরপর আসে প্রলাভনের কথা। অর্থ প্রেরণ, উপহার পাঠানো, এমন জায়গায় পাঠানো যা বলার মতো নয় এবং নিজের দলের ও নিজের জোটের লোকদেরকে বিভিন্ন পদে বসানো ইত্যাদির আশ্রয় নেয়া হয়।
আর হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন। তারা যদিও মুখে সহিংসতার, যত রকমের সহিংসতা আছে তার সবগুলোরই নিন্দা করে, কিন্তু তারা তাদের বিরোধীদের হুমকি দিতে, ভীতি প্রদর্শন করতে মোটেই দ্বিধা করে না। তারা টেলিফোনে হুমকি দেয়া থেকে শুরু করে পত্রপত্রিকায় লিখে ও আরো বিভিন্ন পদ্ধতিতে হুমকি দেয়। এটা হুবহু মু’আবিয়ার অনুসৃত নীতি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সবের মোকাবিলার পথ কী? এ সবের মোকাবিলার একমাত্র পথ হচ্ছে তা-ই যা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) দেখিয়ে গেছেন। এ পথ অনুসরণের প্রথম শর্ত হচ্ছে এই যে, আমরা দুনিয়াকে ভালোবাসবো না। হোসাইন (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে, তাঁর বন্ধুদেরকে, তাঁর অনুসারীদেরকে এমনভাবে তৈরী করেছিলেন যে, তেরো বছরের কিশোর জানতে চাচ্ছিলেন যে, তিনি শহীদ হবেন কিনা। তা জানতে চাইলে হোসাইন (আঃ) সে কিশোরকে জিজ্ঞেস করলেন ঃ “তোমার কাছে মৃতু্যর স্বাদ কেমন?” তখন কিশোর বললেন ঃ “মধুর চেয়েও সুমিষ্টতর।” এটা কোনো শ্লোগান ছিলো না। হযরত ইমাম হাসান (আঃ)-এর পুত্র কাসেম তাঁর চাচা ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর সামনে শ্লোগান দেন নি। বরং তিনি তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলের কথাটিই তাঁর চাচাকে বলেছিলেন।
চিন্তা করে দেখুন, মৃতু্য তাঁর নিকট মধুর চেয়েও অধিকতর সুমিষ্ট। এর মানে কি? তেরো বছরের এক কিশোর এ কথা বলছেন! অবশ্য যে কোনো মৃতু্য সম্পর্কে তিনি এ কথা বলেন নি; আল্লাহ্র পথে, দায়িত্ব পালনের পথে, ইসলামের খেদমতের পথে জীবনদানের কথা বলেছেন। নচেৎ মৃতু্য তো কখনোই মধুর ব্যাপার নয়। যেহেতু প্রসঙ্গ ছিলো শাহাদাতের, এ কারণেই তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো ঃ “তোমার কাছে মৃতু্যর স্বাদ কেমন?”
আমরা যদি হোসাইনী পথে চলতে চাই, তাহলে আমাদেরকে এই জটিল শয়তানী ষড়যন্ত্র সমূহকে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য প্রথমে আমাদেরকে সেই চেতনার অধিকারী হতে হবে। “(হে রাসূল!) বলুন, তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবেসে থাকো তাহলে তোমরা আমার অনুসরণ করো, তখন আল্লাহ্ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।” “তোমরা যদি মনে করো যে, …. তোমরা আল্লাহর বন্ধু, তাহলে তোমরা মৃতু্যকে কামনা করো।”
এটা কি সম্ভব যে, কেউ তার প্রিয়তমের সাক্ষাত কামনা করবে না? আমাদের অবশ্যই কামনা করতে হবে। আমাদের এটা শিখতে হবে, আমাদের নিজেদেরকে এর তালক্বীন দিতে হবে _ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমাদেরকে এ পথেই চলতে হবে। আমরা যেন পার্থিব আশা-আকাঙ্ক্ষাকে হৃদয়ে স্থান না দেই। আমরা যেন এসব স্বর্ণ-রৌপ্যের ধোঁকায় না পড়ি। আমরা যেন আল্লাহ্র রাস্তায় মৃতু্যকে, আল্লাহ্র রাস্তায় শাহাদাতকে গৌরবজনক বলে মনে করি। কেবল তাহলেই আমরা আমাদের পথের হেফাযত করতে পারবো।
আবা আবদিল্লাহ্ হোসাইন (আঃ) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন কীভাবে আমরা হোসাইনী হবো। আমরা যখন এ শিক্ষা মোটেই আত্মস্থ করি নি তখন কীভাবে আমরা তাঁকে ভালোবাসবো? আমাদের প্রিয় কিশোরদের মধ্যে এমন কিশোরের সংখ্যা অগুণতি যারা কাসেম বিন্ হাসানের পর্যায়ভুক্ত হতে পারেন।
এক শহরে বক্তৃতা করছিলাম, যার মেহমান হয়েছিলাম রাতের বেলা তাঁর বাড়ীতে এলাম। বারো-তেরো বছর বয়সী এক কিশোর বললো ঃ “আপনার সাথে আমার একটা ব্যক্তিগত কথা আছে।” সে তার পিতা-মাতার সামনে বললো ঃ “আপনার সাথে একাকী কথা বলতে চাই।” যখন বেরোতে যাচ্ছিলাম তখন সে বললো ঃ “আমি কিন্তু আপনার কাছে আমার একান্ত কথাটি বলতে পারি নি।” তখন আমি তাকে নিয়ে এক কোণে গেলাম এবং বললাম ঃ “এবার তোমার কথাটি বলো।” সে বললো ঃ “আপনি আমার জন্য দো’আ করুন আল্লাহ্ যাতে আমাকে শাহাদাত-নসীব করেন।”
এ ধরনের কিশোররা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর আদর্শে গড়ে ওঠে। এরা কাসেম বিন্ হাসানের সঙ্গী ও তাঁর সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। আমাদের পুরুষেরা, বৃদ্ধ লোকেরাও হাবীব ইবনে মাযাহের-এর বন্ধু হয়ে যান। আমরা যেন এ কাফেলা থেকে দূরে পড়ে না থাকি। আমাদের বিজয়ের রহস্য এখানেই যে, আল্লাহ্র রাস্তায় মৃতু্য আমাদের কাছে সম্মানের ব্যাপার, গৌরবের ব্যাপার। যুদ্ধ উপস্থিত হলে আমরা শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবো, ঠিক যেভাবে আমাদের শহীদগণ শাহাদাতকে গৌরবজনক বলে মনে করতেন। কত যে যুবক ছিলো যারা হরত ইমামের কাছে যেতো এবং তাঁর কাছে দো’আর জন্য আবেদন জানাতো, বলতো ঃ “দো’আ করুন, আমরা যেন শহীদ হতে পারি।” কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যুদ্ধের পর কয়েক বছর গত হলে এ সংস্কৃতি, এ মূল্যবোধকে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নামের বরকতে এ দিনগুলোতে এ মূল্যবোধগুলো নতুন করে পুনর্জীবিত হয়ে উঠুক।
হে পরোয়ারদেগার, হোসাইন বিন্ আলী (আঃ)-এর মর্যাদার উসিলায় তোমার কাছে আবেদন করছি ঃ
আমাদেরকে হোসাইনী পথে দৃঢ়তা দান করো।
আমাদের সকলের জন্য মৃতু্যকে বরকতময় করে দাও।
আাদের অন্তরে শাহাদাত ও তোমার দীদারের মহব্বত বৃদ্ধি করে দাও।
আমাদের সকলকে দায়িত্ব পালনের তাওফীক দাও।
হযরত ইমামের রূহ্কে সাইয়েদুশ শুহাদার সাথে হাশর করো।
আমাদের শিরোপরি মহান রাহ্বারের ছায়া স্থায়ী করে দাও।
আমাদের সকলের পরিণতিকে শুভ পরিণতিতে পরিণত করে দাও।

Leave A Reply

Your email address will not be published.