মুসলিম সভ্যতা

0 1,432

বিশ্বের সমৃদ্ধতম সভ্যতাগুলোর একটি হচ্ছে মুসলিম সভ্যতা। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে যুক্তির উপর ভিত্তি করে। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশি আলোচনার লক্ষ্যে আমরা নতুন এই ধারাবাহিকের আয়োজন করেছি। এই ধারাবাহিকে মুসলিম সভ্যতার বিকাশ, চড়াই-উৎরাই এবং এ সভ্যতা বিকাশের পথ-পরিক্রমা সম্পর্কে আলোচনা স্থান পাবে।

 

প্রথম পর্ব

ইসলাম ধর্ম বিশ্বকে এমন এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে যা গোটা মানব জাতি বিশেষ করে মুসলমানদের চীর ঋণী করে রেখেছে। কিন্তু সমৃদ্ধ এই মুসলিম সভ্যতার অবদান সম্পর্কে বর্তমান তরুণ সমাজ খুব একটা অবহিত নয়। এ কারণে তরুণ সমাজসহ বিশ্বের জ্ঞান অন্বেষীদের জন্য মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে তুলে ধরার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। নিজের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাও প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নিজের পূর্বসুরীরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে কোন পর্যায়ে এবং কোন অবস্থানে ছিলেন, সে সম্পর্কে জানতে পারলে সামনের দিকে পথচলা আরও সহজতর হয়। এছাড়া, নিজের অতীত সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান নয়া প্রজন্মের মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপনিবেশবাদীরা গত দুই শতাব্দী ধরে সব সময় বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী বিশেষকরে মুসলমানদের মৌলিকত্ব, মর্যাদা ও কর্মক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। উপনিবেশবাদী পাশ্চাত্য, বিশ্ববাসীকে এটা বুঝানোর চেষ্টা করছে যে, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে ধারন করা ছাড়া অন্যদের আর কোন উপায় নেই।

প্রাচ্যের দেশগুলোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করার পেছনে পাশ্চাত্যের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, প্রাচ্যের দেশ ও জাতিগুলোর নানা অর্জনকে অস্বীকার করে তাদের সব উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্জনকে নিজেদের অর্জন হিসেবে তুলে ধরা। পাশাপাশি মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ঠেকানোও তাদের অশুভ উদ্দেশ্যের অংশ। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাফিয়ী সার্বেস্তানি মনে করেন, পশ্চিমারা বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে উন্নত প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখন তারা এই প্রযুক্তি ও শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্বে নিজেদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। পাশ্চাত্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে পাচ্যের উপর নিজেদের রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

পাশ্চাত্য নিজেদের ভূখণ্ডকে মানব সভ্যতার লালন ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরার পাশাপাশি অন্যদের উপর নিজেদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাদের এসব অপতৎপরতা মোকাবেলার জন্যে ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংঘাতের তত্ত্ব প্রদানকারী মার্কিন তাত্ত্বিক স্যামুয়েল হান্টিংটন এটা স্বীকার করেছেন যে, পাশ্চাত্য, বিশ্বকে নয়া সমাজ ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সভ্যতার মানুষকে পাশ্চাত্যপন্থী হিসেবে গড়ে তুলছে। তার মতে, এর ফলে তারা নিজেদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও অভ্যাস ত্যাগ করে পাশ্চাত্যকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করছে।

বর্তমানে পশ্চিমারা মুসলিম সভ্যতার উন্নতি ও উৎকর্ষ বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য সুসংহত করার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই পাশ্চাত্য বিশ্বের নেতৃত্ব পুরোপুরি করায়ত্ত করার নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে। কোন কোন দেশ ও জাতি এ ধরনের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার কৌশল বেছে নেয়। বিশেষকরে তারা মুসলিম দেশগুলোতে সুকৌশলে ও ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা এটা ভালো করেই জানে যে, সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকলে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হয়। মার্কিন গবেষক ও লেখক এডওয়ার্ড বার্মান বলেছেন, পশ্চিমারা, গণযোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়া এবং রকফেলার,কার্নেগি ও ফোর্ডের মতো বাহ্যত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উন্নয়নশীল সমাজে বিশেষ ধরনের চিন্তা-বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা এর মাধ্যমে বিশ্ব পরিস্থিতি ও জীবন সম্পর্কে মানুষের বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছে।

আমরা নতুন এই ধারাবাহিকে মূলত মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করবো। কাজেই এখানে সংক্ষেপে মুসলিম সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার কারণ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা দরকার। মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠার ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম সভ্যতা হচ্ছে জীবন্ত ও গতিময় এক সভ্যতা এবং এই সভ্যতা সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আর এ ধরনের গতিময় সভ্যতা যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। মুসলিম সভ্যতাও শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও এমনকি বারবার বিজাতীয় আগ্রাসনের শিকার হবার পরও কখনোই পাশ্চাত্যের কাছে নতিস্বীকার করেনি। তাছাড়া, ইরানি, মিশরীয় ও আরব সংস্কৃতির মতো বিভিন্ন স্থানীয় সংস্কৃতিকে টিকে থাকার সুযোগ দেবার কারণে মুসলিম সভ্যতা ক্রমেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে ধ্বংস করে সকল সংস্কৃতিকে একীভুত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে এটা সুস্পষ্ট যে, এখানে সকল সংস্কৃতিই গুরুত্ব পেয়েছে এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে। মুসলিম সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রেও এই বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্ট সভ্যতা ও সভ্য সমাজের সংজ্ঞা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন,” সভ্যতা হলো সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, যা সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনী শাসন ও তুলনামূলক জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভ করে। সভ্যতা হচ্ছে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সমুন্নিতর ফসল। আর যে সমাজ, সামাজিক শৃঙ্খলা সাধন করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা ভাবে, সেই সমাজই সভ্য সমাজ।”
এটা নিশ্চিত যে, মুসলিম সভ্যতার গতিময়তার একটি কারণ হলো বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে মেনে নেয়া বা স্বীকৃতি দেয়া। মুসলিম সভ্যতায় জাতিগত বৈষম্যের কোন স্থান নেই এবং এটি কোন বিশেষ জাতি-শ্রেনীর সাথে সম্পর্কিত নয়। ইসলাম হচ্ছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধর্ম এবং ইসলাম এটা প্রমাণ করেছে যে, এই ধর্ম মানুষকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে পারে।

মুসলিম সভ্যতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে দূরে থাকা। আরব বিশ্বে ইসলামের দাওয়াতী কাজ যখন শুরু হয় তখন সেখানকার মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ইসলাম ধর্ম; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ভিত্তিক যে শিক্ষা মানুষকে দিয়েছে,তা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শিকল ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করেছে। ইসলামী শিক্ষা, মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত করার পাশাপাশি প্রাথমিক যুগেই সমুজ্জল মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠার ও তা বিকশিত হবার ক্ষেত্র তৈরী করেছিল। উইল ডোরান্ট তার সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতার মতো এত বিস্ময়কর সভ্যতা আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসলাম যদি গতিময় না হতো এবং অন্যান্য সংস্কৃতিকে বিলীন করার চেষ্টা চালাতো তাহলে মুসলিম সভ্যতা আরব ভূখন্ডের গন্ডি পেরোতে সক্ষম হতোনা। এসব গুণাবলীর কারণেই ইসলাম এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে অন্যান্য সভ্যতাকে আকৃষ্ট করে বিশাল এক সভ্যতায় পরিণত হতে সক্ষম হয়েছিল।

পবিত্র চিন্তা-চেতনার উপর ভিত্তি করেই মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠেছে। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন ও ধর্মের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককেই গুরুত্ব দেয়। ধর্ম হচ্ছে মানুষের পূর্ণতা ও উন্নতি সাধনের মাধ্যম এবং জ্ঞান ও বিবেকের সাথেও এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম সমাজ-বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বিশ্বাস করতেন, মানুষের ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলোর সাথে তার মানবিক দিকগুলোর সংযোগের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী সভ্যতা গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, মুসলিম সভ্যতা অতীত সভ্যতাগুলোর নেতিবাচক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলোকে সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইতিবাচক দিকগুলোকে লালন করে পূর্ণতা লাভ করেছে এবং বিকশিত হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্ব

গত আসরে আমরা বলেছি, মানব সভ্যতায় ইসলাম ধর্মের অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিজাতীয়রা মুসলিম সভ্যতার অর্জনগুলোকে উপেক্ষা করে মুসলমানদের নানা আবিস্কার ও অর্জনকে নিজেদের বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। গত পর্বে আমরা মুসলিম সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবার মূল উপাদানগুলোর কোন কোনটি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, ইসলাম ধর্ম বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতির অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছে এবং গোঁড়ামি ও কুসংস্কারমুক্ত থাকার পাশাপাশি ধর্ম ও পার্থিব বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। এ পর্বে আমরা মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাইয়ের নানা কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।

মুসলিম সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা অন্যতম। লেবাননের খ্রীষ্টান লেখক জর্জি যেইদান বলেছেন, মদিনায় প্রবেশের পর রাসূল (সা.)র প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো, মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে সেখানে আগত মক্কী মুসলমানদের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই চুক্তিটিই ছিলো মুসলিম ঐক্যের প্রথম ভিত্তি,যা রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। জর্জি যেইদানের মতে, প্রথম থেকেই মুসলমানরা নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং এর ভিত্তিতে মুসলিম সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে। ধর্ম ও নৈতিকতার সঙ্গে সভ্যতা ও সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখতে এ দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমান যুগের বেশিরভাগ চিন্তাবিদ এ ব্যাপারে একমত যে, পশ্চিমা সভ্যতায় বিজ্ঞান ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও নীতি ও আদর্শ এবং চারিত্র্যিক ক্ষেত্রে সেরকম কোন উন্নতি বা উৎকর্ষ অর্জিত হয়নি। এমনকি দিনদিনই এ অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অনেক চিন্তাবিদের মতে, নৈতিক ও চারিত্যিঅবক দিকটি উপেক্ষিত হবার কারণে সৃষ্ট অবক্ষয়ের কারণেই পশ্চিমা সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতায় পরিণত হয়েছে।

পশ্চিমা সংস্কৃতির পতনের কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের নানা মত ব্যক্ত করেছেন। পাশ্চাত্যে রেনেসাঁর পর যেসব চিন্তাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম-এই তিনটি মতবাদের উপর ভিত্তিশীল। হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদে মানুষ স্বাধীন এক অস্তিত্ব। এ মতবাদ অনুযায়ী, ঐশী দিক নির্দেশনার কোন প্রয়োজন মানুষের নেই। এছাড়াও পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি লিবারেলিজম বা উদার নৈতিকতাবাদের ওপর বিশ্বাসের কারণে এবং ব্যক্তি স্বার্থকে সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান দেয়ায়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতাকে প্রত্যাখ্যান করছে। নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতা প্রত্যাখ্যান করার কারণে পশ্চিমা সমাজে বিশৃংখলা ও উচ্ছৃংখলতা বেড়ে চলেছে। পশ্চিমা সভ্যতার অপর ভিত্তিটি হলো, সেকুলারিজম বা ইহলৌকিকতাবাদ ও ধর্মহীনতা। এই মতবাদ রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্বকে অস্বীকার করে।

বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর সমাজে হিউম্যানিজম, সেক্যুলারিজম ও লিবারেলিজমের প্রভাব সুস্পষ্ট। মার্কিন লেখক বুকানান জে.পেট্রিক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কারণে পশ্চিমা সভ্যতায় ধর্মপরায়ন ও সম্মানিত ব্যক্তিদের উপর চরম দুর্দশা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আর এ কারণেই এই সভ্যতা অগ্রহণযোগ্য ও ঘৃণ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার পেছনে যে আইডিওলোজি বা জ্ঞান-তত্ত্ব কাজ করছে তা মানব প্রকৃতির সাথেও সাংঘর্ষিক। পাশ্চাত্যে নৈতিক অবক্ষয় ও মানব জীবন থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করাও পাশ্চাত্য সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু হবার একটা অন্যতম কারণ। মি. বুকানানা তার বইয়ে লিখেছেন, ১৯৮৩ সালে হোয়াইট হাউস যখন চিকিৎসা সংকট নিয়ে আলোচনায় মশগুল ছিলো, ঠিক সে সময় এইডস রোগে ছশ জন মার্কিনী মারা গেছে। সমকামীরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং প্রকৃতিও মানুষকে চরম শাস্তি দিচ্ছে। বর্তমানে লাখ লাখ মানুষ এইডস বা এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে।

মার্কিন এ লেখকের মতে, পশ্চিমা সমাজে গর্ভপাত,তালাক ও আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সন্তান লাভে তাদের আগ্রহ নেই। মাদকসেবীর সংখ্যাও দিনদিনই বাড়ছে। নারী ও বয়স্কদের সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। এছাড়া অবাধ যৌনাচার বেড়ে গেছে। আর এ সবই প্রমাণ করে পশ্চিমা সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু।
মার্কিন এই লেখক পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবকে হেরোইনের ভয়াবহ প্রভাবের সাথে তুলনা করেছেন। হেরোইন যেমন প্রথমে মানুষকে দৃশ্যত প্রশান্তি দিলেও ক্রমেই মানবদেহকে বিকল করে দিয়ে মাদকসেবীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তেমনি পশ্চিমা সভ্যতাও বাহ্যত আকর্ষনীয় হলেও এর চূড়ান্ত ফল বিষময়। আরেক বিখ্যাত মার্কিন লেখক কেনেথ মিনং তার নিউ স্ট্যান্ডার্ড শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, পশ্চিমা সভ্যতা নীতি-নৈতিকতা থেকে অনেক খানি দূরে সরে গেছে, কাজেই পশ্চিমা সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠতর বলা যাবে না।

যে সমাজের মানুষ নীতি-নৈতিকতা মেনে চলে এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরাগী সে সমাজের স্থায়ীত্ব ও গতিময়তাও থাকে বেশী। ইরানের বিখ্যাত লেখক ড: বেলায়াতি তাঁর এক বইয়ে লিখেছেন, কোন সমাজ যদি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় সভ্য হবার পরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, তাহলে ওই সভ্যতা ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ে। চূড়ান্ত পর্যায়ে তা বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার পথে ধাবিত হয় এবং ওই সমাজের সভ্যতার ভিত্তি ধসে পড়ে। ফলে সভ্যতা তার গতি হারিয়ে ফেলে। কারণ লক্ষ্যহীন সভ্যতার কারণে লাগামহীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়িয়ে পড়ে। তবে মুসলিম সভ্যতা সব সময় নীতি-নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, ঐক্য এবং আইন মেনে চলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
সমাজের অন্য অনেক কিছুর মতো সভ্যতার ক্ষেত্রেও চড়াই-উৎরাই থাকে। কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন,প্রত্যেক সভ্যতাকেই বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়েই সভ্যতা এগিয়ে চলে।

নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে দারুনভাবে সহায়তা করতে পারে। কোন সমাজ সভ্য ও সংস্কৃতিবান হবার পরও যদি ধর্মীয় ও নৈতিক দিককে উপেক্ষা করে তাহলে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হলো, আন্দালুস বা বর্তমান স্পেনে মুসলমানদের ভয়াবহ পরিণতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামী নীতি-আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়াসহ আরও কিছু কারণে স্পেনে মুসলমানদের পতন ঘটেছিল। এ কারণেই ইসলাম ধর্ম আধ্যাত্মিকতা ও নীতি-নৈতিকতার উপর সব সময় গুরুত্ব আরোপ করেছে। মুসলিম ইতিহাসে এসেছে, মক্কা থেকে মদীনায় রাসূলের হিজরতের একটা কারণ ছিলো, মক্কার বিরূপ পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে নতুন পরিবেশে নীতি-নৈতিকতা লালন করা ও তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।

অজ্ঞতা, স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির কারণেও একটি সভ্যতায় ধস নামে। মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্টের মতে, জ্ঞান ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের দৃষ্টিতেও স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার ও দূর্নীতি সভ্যতার পতনের কারণ। অন্য যেসব বিষয় সভ্যতার পতন নিশ্চিত করে তাহলো সমাজে অনৈক্য ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়া। ইরানের বিশিষ্ট লেখক ও ঐতিহাসিক আব্দুল হোসেন যার্রিনকুব বলেছেন, সভ্যতার টিকে থাকার জন্য ঐক্য ও সংহতি জরুরি। তিনি মনে করেন, অনারবদের উপর আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে উমাইয়ারা যে চুক্তি করেছিল, তা মদীনায় রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার উন্নত ভিত্তিকে ক্রমেই নড়বড়ে করে ফেলে। মুসলিম সভ্যতার ভিত্তি সে সময় থেকেই দূর্বল হতে থাকে বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, মুসলিম সভ্যতা দূর্বল হবার পেছনে দূর্নীতি ও বিলাসিতাও একটি বড় কারণ। যার্রিনকুব বলেছেন, তৎকালীন শাম বা বর্তমান সিরিয়ায় বনী উমাইয়াদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই মুসলিম সভ্যতা দূর্বল হতে থাকে।

বিজাতীয় শত্রুদের আক্রমনও সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে দুর্বল করার ক্ষেত্র তৈরী করতে পারে। শত্রুরা অতীতেও বহুবার মুসলিম দেশগুলোতে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে মোংগলীয় ও ক্রুসেডারদের হামলা অন্যতম। কিন্তু সুখের কথা হলো, মুসলমানরা এসব যুদ্ধে হেরে যায়নি এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। সব মিলিয়ে, আমরা যদি মুসলিম দেশগুলোর চড়াই-উৎরাইয়ের ইতিহাস সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো, মুসলমানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। স্বয়ং রাসূল (সা.) এ ধারার সূচনা করে গেছেন।

তৃতীয় পর্ব

গত আসরে আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্যতার পতনের নানা কারণ এবং বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতার অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এছাড়া, মুসলিম সভ্যতা নানা প্রতিকূলতার মাঝেও কীভাবে টিকে থাকলো সে বিষয়টিও আমরা তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতা হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম এই তিন মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এবং এসব মতবাদে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়না। যাইহোক, আজকের আসরে আমরা মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলদের ভূমিকা বিশেষকরে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)র ভূমিকা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করবো।

মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। নবী-রাসূলগণ যুগে যুগে মানব জাতিকে সৎ পথের দিকে আহ্বানের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহতায়ালা সূরা নাহ্‌লের ৩৬ নম্বর আয়াতে সমাজে নবী-রাসূল পাঠানোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো এবং শয়তানকে বর্জন করো।”
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)র আগেও আল্লাহতায়ালা পবিত্র মক্কা শহরে কয়েক জন নবী পাঠিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ:) তাদের মধ্যে অন্যতম। ইব্রাহিম (আ:)র আর্বিভাবের পর আরবদের কেউ কেউ একত্ববাদের ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ইব্রাহিম (আ:)র ইন্তেকালের পর অধিকাংশ আরব এই একত্ববাদী ধর্মের সাথে মূর্তিপূজার কুসংস্কার ও বিশ্বাসের মিশ্রন ঘটায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, ইব্রাহিম (আ:)র সময় থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্মের আর্বিভাবের আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ আরবই ইব্রাহিম (আ:) ধর্মের কিছু রীতি নীতি মেনে চলার পাশাপাশি মূর্তি পুজাও করতো।
তবে আরবদের মধ্যে এমন কিছু মানুষও ছিলেন যারা মূর্তিপুজা করতেন না এবং মানুষকে মূর্তি পুজা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতেন। যারা মূর্তিপুজা না করে ইব্রাহিম (আ:)র ধর্মের প্রতি অটল ছিলেন,তাদের মধ্যে আব্দুল মোত্তালেব অন্যতম।

বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার জন্য আরব ভূখন্ডের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। ঐতিহাসিকরা আরব ইতিহাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করে থাকেন। প্রথমত: জাহিলিয়াতপূর্ব প্রাচীন যুগ, দ্বিতীয়ত: জাহিলিয়াত যুগ এবং জাহিলিয়াত পরবর্তী যুগ। ইসলাম আর্বিভাবের পর জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় ইসলামি যুগ এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আরবরাও ইসলামপূর্ব যুগে কবিতা ও সাহিত্যের মতো কোন কোন ক্ষেত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলো। শুধু বিশেষ মহলেই নয় কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি সাধারণ মানুষজনেরও ব্যাপক ঝোঁক ছিলো। বেদুঈন আরবরা নতুন নতুন কবিতা শুনতে কবিদের কাছে আসতেন এবং একসঙ্গে বসে কবিতা আবৃত্তি শুনতেন।

আরবের বাজারগুলোতেই কবি ও শ্রোতাদের বেশি সমাগম ঘটতো। সে সময় যে গোত্রে শক্তিমান ও সৃষ্টিশীল কবির জন্ম হতো সে গোত্রের মানুষ ওই কবিকে নিয়ে গর্ব করতো এবং তার জন্য সম্মানসূচক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। জাহেলি যুগে একজন কবি ইচ্ছে করলেই একজন সাধারণ মানুষকেও প্রশংসার মাধ্যমে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করতে পারতেন এবং একজন সম্মানী ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করে অথবা তার বিষয়ে দূর্নাম রটিয়ে তাকে অপমান করতে পারতেন। কবির ইশারায় একজন সম্মানী ব্যক্তিও সমাজে তুচ্ছ ব্যক্তিতে পরিণত হতেন। জাহেলি পরিবেশ কবিদের ওপরও প্রভাব ফেলেছিল। সে সময়কার বেশিরভাগ আরব কবিতায় তৎকালীন সমাজের মানুষের জীবনপ্রণালীর চিত্র অংকিত হয়েছে। কবিতাগুলোতে আরব মরুপ্রান্তর, তাবু, তলোয়ার, নানা ধরনের খেলা, মানুষের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ চিত্রায়িত হয়েছে।

ইসলামপূর্ব যুগকে জাহেলি যুগ বলা হয়, কারণ সে সময় সমাজে অজ্ঞতা ও বর্বরতা প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো। আরব উপদ্বীপে কোন আইন-কানুন ও রীতি-নীতি ছিলো না। এছাড়া, আরবে তখন কোন নবী-রাসূলও ছিলেন না যারা আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারেন। কারণ বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)র আবির্ভাবের আগে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত আরবে কোন নবী-রাসূল আসেননি। এছাড়া, আরব উপদ্বীপের উত্তরের বেশিরভাগ অঞ্চল বিশেষকরে হিজায অঞ্চলটি ছিলো শুষ্ক ও রুক্ষ এবং ইসলামপূর্ব যুগে বেশিরভাগ আরবের বাস ছিলো মরু এলাকায়। মরু অঞ্চলের মানুষজন পানির সন্ধানে একেক সময় একেক দিকে ছুটে যেতেন। এ অবস্থা তাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছিলো। কঠিন ও রুক্ষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অনেকেই তাদের মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভুলে গিয়েছিল।

এ কারণে সে সময়ের ইতিহাস যুদ্ধের নানা ঘটনায় ভরপুর। বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে পশু ও চারণভূমির আধিপত্য নিয়ে যুদ্ধ হতো এবং একে অপরের এলাকায় লুটতরাজ চালাতো। গোত্রপ্রীতি ও কুসংস্কার ছিলো সে সময়ের আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা সামান্য কারণে বড় বড় যুদ্ধের জন্ম দিতো,যা কখনো কখনো বছরের পর বছর ধরে চলতো। জাহেলি যুগের আরবরা নারীদের কোন গুরুত্বই দিতো না। নারীরা মানুষ হিসেবেই গণ্য হতো না। তারা কন্যা সন্তানকে অপমানের বোঝা বলে মনে করতো। কখনো কখনো এই অপমান থেকে রক্ষা পেতে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দিতো। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারকে তারা অস্বীকার করতো। এমনকি স্বয়ং নারীদেরকেই উত্তরাধিকার সম্পত্তি ও পণ্য বলে গণ্য করতো।

পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে সে সময়কার নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ওদের কাউকে যখন কন্যা-সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে,তার কারণে সে নিজ গোত্র অথবা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আত্মগোপন করে এবং সে এটা ভাবতে থাকে যে, এই অপমানের পর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে না কি নিজেকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে? বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন,যখন আরবের মানুষ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে পুরোপুরি নিমজ্জিত। তিনি এ ধরনের একটি সমাজ থেকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কল্যাণের বার্তা পৌছেঁ দেয়ার দায়িত্ব পান। এখানে উল্লেখ্য, সে সময়কার বিশ্ব রাজনীতিতে আরবদের কোন গুরুত্বই ছিলো না, কোন অবস্থানই ছিলোনা। কিন্তু বিশ্বনবী, তাঁর মিশন এবং তার শিক্ষা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আরব ভূখন্ডে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেন।

নবীজীর পথনির্দেশনায় মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাসূল (সা.) নব্যুওয়ত লাভের পর ১৩ বছর মক্কায় ইসলামের মূল নীতি ও শিক্ষা প্রচার করেন। কিন্তু রাসূল(সা.) মক্কায় অবস্থানকালে নানা কারণে ইসলামি রাষ্ট্র ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পরিবেশ তৈরী করা সম্ভব হয়নি। হয়তো এর বড় কারণ ছিলো, মক্কার গোত্র ও গোষ্ঠি ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গোত্রভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে ব্যাপক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বনবী (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পদমর্যাদা ও সম্মান কখনোই যোগ্যতা ও সাহসিকতার ভিত্তিতে ছিল না বরং কে কোন গোত্রের ও কোন বংশের তার ভিত্তিতেই ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারিত হতো। এছাড়া, মক্কার ভৌগলিক অবস্থানও বিশ্বে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী ছিলো না। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর রাসূল (সা.) সেই উপযুক্ত পরিবেশ পান।

চতুর্থ পর্ব

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বশেষ ঐশী ধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৩ বছর ধরে মক্কা অঞ্চলে ইসলামের বাণী জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ ছাড়াও শত্রু দের ব্যাপক বিদ্বেষী আচরণের কারণে তিনি সেখানে অনুকূল পরিবেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সুযোগ পাননি। ফলে (সাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় মুসলমানদের হিজরত বা অভিবাসন শুরু হয়।

মদীনা বা ইয়াসরিব ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নিরাপদ স্থান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরত করতে বলেন। নবী হিসেবে দায়িত্ব লাভের ১৪তম বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার অথবা এর সামান্য কিছু আগে বা পরে রাসূল (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন। মক্কা থেকে মদীনার উপকণ্ঠে ক্বুবা নামক স্থানে আসতে তাঁর সময় লেগেছিল নয় দিন। ক্বুবায় তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অবস্থান করেন। এ সময় সেখানে নির্মিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ। কয়েকদিন পর মক্কা থেকে মহানবী (সাঃ)র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলীও রাসূল (সাঃ)র সাথে মিলিত হন। এরপর তাঁরা একইসাথে মদীনায় প্রবেশ করেন।

ইয়াসরেব বা মদীনা ছিল দুটি বড় ইহুদি গোত্রের সম্মিলন-স্থল। এ ছাড়াও কয়েকটি মোহাজির গোত্র এ অঞ্চলে বসবাস করত। আওস ও খাজরাজ ছিল এসব মোহাজির গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোত্র। এসব গোত্রের আবাসস্থল হবার কারণে মদীনার লোকজনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে এক ধরনের নির্লিপ্ত ভাব বা নিস্ক্রিয়তা দেখা যেত। ফলে এখানে নতুন ধর্ম বিকশিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এ জন্যই মক্কার তুলনায় মদীনা বা ইয়াসরেব শহরে ইসলাম ধর্ম বিকশিত হবার পথ বেশী উন্মোচিত হয়েছিল। এখানকার অ-ইহুদি আরব গোত্রগুলো ইহুদিদের কাছ থেকে আল্লাহ, ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ, বিচার বা পুনরুত্থান দিবস, বেহশত ও দোযখ প্রভৃতি বিষয়ে ধারণা পেয়েছিল। এ ছাড়াও পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত আওস ও খাজরাজ গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে নতুন মিত্র শক্তির বলে পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সূবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। তাই দেখা যায় এ দুটি গোত্র কেবল একে-অপরের আগে নয়, এমনকি ইহুদিদেরও আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে।

মদীনায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রবেশের দিনটি ছিল শুক্রবার। তাঁর ইমামতিতে সেদিনই প্রথম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জুমার নামাজের খোতবায় মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনের পর তিনি জনগণকে খোদাভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন, সৎ কর্ম ও আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানান। জুমার নামাজ আদায়ের পর তিনি শহরের ভেতরে প্রবেশ করেন। মদীনার জনগণ তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়। এ সময় থেকে রাসূল (সাঃ) সাহাবায়ে কেরাম মুহাজির ও আনসার হিসেবে পরিচিত হন। যারা মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়াসরেবে আসেন তাদের বলা হত মুহাজির। আর মদীনার স্থানীয় সাহাবীদের বলা হত আনসার বা সাহায্যকারী। ইয়াসরেবে মহানবী (সাঃ)র আগমনের সুবাদে এই শহরের নাম রাখা হয় মদীনাতুননবী বা রাসূলের শহর ।

এভাবে দেখা যায়, ইসলাম ধর্ম মক্কায় যাত্রা শুরু করলেও মদীনা হয়ে পড়ে এ ধর্ম বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র। মদীনায় জনগণ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সংখ্যা দর্শনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বনবী (সাঃ) একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তিনটি ভিত্তি ছিল। মসজিদ নির্মাণ, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর।

এভাবে মহানবী (সাঃ) আরবদের মধ্যে শত শত বছর ধরে প্রচলিত জাহেলী যুগের গোত্রীয় বিদ্বেষের অবসান ঘটান। ইসলামী সমাজ বা উম্মাহ গঠনে তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ধর্মই মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও বন্ধন বা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। গোত্রীয় বন্ধনের যে ধারা আরবদের মধ্যে জাহেলিয়াত বা কুসংস্কার ও গোত্রীয় নানা কূ-প্রথা সৃষ্টি করেছিল তা ইসলামী সমাজ গঠনের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে জাহেলী চিন্তা-চেতনার অবসান ঘটায় মদীনার মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের জন্য প্রস্তুত হয়।

বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে বলা যায়, হিজরতের প্রথম দিন থেকেই সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষণগুলো ইসলামে স্পষ্ট হয়ে উঠে। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠে। এভাবে মহানবী (সাঃ)র ওয়াদা বাস্তবে রূপ নেয়। মদীনায় মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর ছিল তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। এই সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের সামাজিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এমনকি এতে ইহুদিদের নাগরিক ও সামজিক অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই সংবিধান অনুযায়ী মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা লাভ করে। এভাবে হিজরতের সুবাদে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও জনমত বা জন সমর্থনের আলোকে একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং ইসলামী চিন্তাধারা বাস্তবায়নের পথ সূচিত হয়। মক্কায় বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিক, কিন্তু মদীনায় তিনিই হন প্রথম ইসলামী সরকারের প্রধান দায়িত্বশীল।

মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ছিল ভৌগোলিক সীমানা ও অঞ্চল বা ভূখণ্ড, জনগণ, সার্বভৌমত্ব বা স্বাধীনতা ও প্রশাসন। এ ছাড়াও ছিল আইনের শাসন। অন্য কথায় সে রাষ্ট্রে আইনের দৃষ্টিতে ছিল সবাই সমান। কারো ব্যাপারে কোনো বৈষম্য ছিল না। সে যুগে এমন ব্যবস্থা ছিল নজিরবিহীন। তাই তা সব যুগের জন্য আদর্শে পরিণত হয়। দেখা গেছে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মুসলিম জাহানের খলিফা আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) আদালতে তাঁর অধিকার ত্যাগ করেছেন। বিবাদী ইহুদি খলিফার মনোনীত কাজীর এ ধরনের অবিশ্বাস্য রায়ে ও রায়ের প্রতি খলিফার শ্রদ্ধায় বিমুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।

মদীনা সনদ প্রণয়ন ছিল বিশ্বনবী (সাঃ) ইসলামী রাষ্ট্রের আরেক মহান কীর্তি। এতে নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরই আলোকে সব কিছু ত্যাগ করে কেবল ঈমান নিয়ে আসা মুহাজিরদের নিরাপত্তা বিধান ও সহায়-সম্পদের ক্ষেত্রে আনসারদের সহযোগীতা ছিল অকল্পনীয়। মদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে দেয়া ছিল মহানবী (সাঃ)র এক বড় সাফল্য। এর আগে সম্পর্কের মাপকাঠি ছিল গোত্রীয় পরিচয়। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুমিনদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সীসা ঢালা প্রাচীরের মত দৃঢ় ঐক্য।

পঞ্চম পর্ব

ইসলামের নবী (সা) এর মৌলিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল মসজিদ নির্মাণ করা। ইসলামী হুকুমাতের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে মসিজদ প্রতিষ্ঠা করতেন তিনি। আসলে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়েছিল যা একদিকে হবে মুসলমানদের ইবাদাতের স্থান, অপরদিকে হবে রাজনৈতিক, বিচার, প্রশিক্ষণ এমনকি সামরিক দিকসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র। যাই হোক মসজিদের গুরুত্ব এবং এর ভূমিকা নিয়ে আজকের আসরে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।

প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে মসজিদ ছিল নামায পড়া, জ্ঞানার্জন, বিচারকার্য পরিচালনা এবং হুকুমাতের কেন্দ্র। এছাড়াও মসজিদে বায়তুল মাল, যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের মালামাল ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হতো। এমনকি যুদ্ধবন্দী এবং কারাবন্দীদেরকেও মসজিদে রাখা হতো। অর্থাৎ সামাজিক এবং রাজনৈতিক সকল কার্য পরিচালনার কেন্দ্র ছিল মসজিদ। এদিক থেকে বিচার করলে বলতেই হবে যে মদিনায় নয়া ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে মসজিদের ভূমিকা ছিল মৌলিক এবং অপরিসীম। মসজিদের ভূমিকা এবং কর্মকাণ্ড সম্পের্ক সম্ভবত বলা যায় সে সময় ইমান এবং জ্ঞানের মধ্যকার গভীরতম যে বন্ধনগুলো গড়ে উঠেছিল তা মসজিদ থেকেই গড়ে উঠেছে। ইসলামের হুকুম-আহকাম, ইসলাম পরিচিতিমূলক বক্তব্য মসজিদে দেওয়া হতো, ইসলামী শিক্ষা এমনকি লেখা এবং পড়ার মতো বিষয়গুলোও মসজিদেই শিক্ষা দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে যখন ইসলামী হুকুমাত এবং আদালত বা বিচার বিভাগকে মসজিদ থেকে পৃথক করা হলো তখনো সেগুলো ছিলো মসজিদের প্রতিবেশীসুলভ অর্থাৎ মসজিদ সংলগ্ন রেখেই সেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো। সাম্প্রতিক শতাব্দিগুলোতেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের জামে মসজিদের পাশেই গড়ে তোলার প্রচলন ছিলো।

নবী আকরাম (সা) এর অন্যতম মৌলিক একটি দায়িত্ব ছিলো দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার-প্রসার। সন্দেহাতীতভাবে তার জন্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক ও বিচার বিভাগীয় কাঠামোর প্রয়োজন ছিলো। এই কাজগুলো বা গুরুদায়িত্বগুলো সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে নবীজী সুযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদের অনেকেই যাকাত এবং সদকা সঞ্চয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, অনেকেই আবার সামজিক দায়িত্বগুলো পালন করতেন। মদিনার সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ ছিল খুবই সাদামাটা তবে সামগ্রিক এবং পূর্ণাঙ্গ। অনেকেই আবার ভিন্ন ভিন্ন আরো কিছু দায়িত্বে নিয়েঅজিত ছিলেন, যেমনঃ চুক্তিপত্র সম্পাদনের কাজ, সম্মতি পত্র লেখালেখি এবং সংরক্ষণের কাজ, আয়কর হিসাব এবং আদায়ের কাজ, যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের হিসাব নিকাশের কাজ এমনকি কেউ কেউ কোরআনের আয়াত লেখালেখির কাজেও নিয়োজিত ছিলেন।

পানির উৎসগুলো এবং ভূমিগুলো যা বিভিন্ন ব্যক্তি এবং গোত্রকে দেওয়া হতো সেগুলোর তালিকা তৈরি করা এবং তাদের জন্যে ভূমির মালিকানা স্বত্ত বা দলিল লেখার দায়িত্বও কারো কারো ওপর দিয়েছিলেন।
আরবদের মাঝে এটা ছিলো একেবারেই নতুন একটি রীতি। কেননা আরবদের মাঝে আবহমান মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের অন্যতম একটি কারণ ছিলো ভূমি, পুকুর এবং জলাশয়ের মালিকানা নিয়ে। নবীজী সেইসব প্রাচীন দ্বন্দ্ব সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন তা ছিলো এক কথায় ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপ।
পয়গাম্বর (সা) ইহুদি খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন গোত্রের সাথে চুক্তি বা সন্ধিপত্র করেছিলেন। এইসব চুক্তিপত্রের কথা স্থান কাল পাত্রভেদে এবং মুসলমানদের শক্তিমত্তার অবস্থাভেদে বিভিন্ন রকম ছিলো। কখনো কখনো চুক্তিপত্রের অবস্থা বা পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।উদাহরণস্বরূপ হুদাইবিয়ার সন্ধির কথা বলা যায়। হুদাইবিয়ার সন্ধিটি হয়েছিলো মক্কার মুশরিকদের সাথে। ঐ চুক্তিতে মুশরিকদের দেওয়া শর্তগুলো মেনে নেওয়ায় মুসলমানদের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, এমনকি কেউ কেউ বিরক্তও হয়েছিলেন। সে কারণে মুসলমানদের কেউ কেউ ঐ চুক্তির ব্যাপারে আপত্তি পর্যন্ত করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে নবীজীর জীবনকালে কূটনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার অন্যতম প্রধান ও সফল একটি উদাহরণ ছিলো এই হুদাইবিয়ার সন্ধি। এই চুক্তির ফলে মদিনার নয়া সরকার যেমন দৃঢ়তা ও মজবুতি পেয়েছিলো সেইসাথে নবীজীর লক্ষ্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নও সহজতর হয়েছিলো।


রাষ্ট্রীয় এইসব কাজের পাশাপাশি রাসূলে খোদা (সা) বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ, প্রতিবেশী সরকারসহ বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদেরকে চিঠি লিখেছিলেন। তখনকার দিনে ইরানের বাদশাহ, রোমান সম্রাট, মিশরের সুলতান, ইয়েমেনের শাসক, ইথিওপিয়ার বাদশাসহ আরো অনেক বাদশাকেই চিঠি লিখেছিলেন রাসূলে খোদা (সা)। এইসব চিঠির মূল বিষয় ছিলো পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করা এবং এক আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেওয়া তথা তৌহিদের দাওয়াত প্রদান। ইতিহাসবিদ এবং লেখকদের অনেকেরই মতে এইসব চিঠি ছিলো নবীজীর পররাষ্ট্রনীতিরই অংশ। নবীজী এই দাওয়াতকে এবং কূটনীতিকে যুদ্ধ এবং সহিংসতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর সাহাবিরা যদি কাউকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার আগে আটক করতেন তাহলে নবীজী তাদেরকে মুক্ত করে দিতেন।

নবীজীর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিলো ইসলামের পরিধি বিস্তার করা এবং মুসলমানদের সীমান্তে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আরব্য উপদ্বীপের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত পৌছেঁ গিয়েছিলো। মার্কিন ইতিহাসবিদ বিল ডুরান্ট ইসলামী শাসন ব্যবস্থার সাংগঠনিক কাঠামোয় নবীজীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী ভূমিকার কথা স্বীকার করে বলেছেন, সই সময় নবীজী কেবল মুসলমানদেরই নেতা ছিলেন না বরং মদীনা শহরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঐ শহরের বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
ইরানের বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক আব্দুল হাসান যাররিন কুব বলেছেনঃ বিশেষ করে মদিনায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশেষত কেবলা পরিবর্তনের পর থেকে রমযান মাসের রোযা পালন, নামায এবং যাকাতে ফেতরার মতো বিধানগুলোর ব্যাপারে কোরআনের আয়াত নাযিল হয়। এইভাবে এই বিধানগুলো বিধিবদ্ধ হয়।

যাররিন কুবের মতে, ইসলামের আরো কিছু বিধান আরবদের জীবন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো এবং তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো। এসব বিধানের মধ্যে রয়েছেঃ কেসাস, দিয়া বা রক্তমূল্য, জেহাদ, গনিমত বণ্টন, উত্তরাধিকারের বিধান, মদ হারামের ঘোষণা, হজ্জ্বের বিধান ইত্যাদি। তবে সবকিছুর দায়িত্ব নবীজীর ওপর থাকলেও তিনি তাঁর সাহাবিদের সাথে সবসময় পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর ব্যাপারে তিনি কৌশল নির্ধারণের জন্যে একটি সামরিক পরিষদ গঠন করতেন এবং সবার মতামত চাইতেন। ওহুদের যুদ্ধে তিনি ভিন্ন মত পোষণ করা সত্ত্বেও সাহাবিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকেই গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেব বিভিন্ন দেশ জয় করার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। ইসলামের সাথে যেসব সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক ছিল না,সেগুলোকে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। 

Leave A Reply

Your email address will not be published.