পবিত্র কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি সমূহ!

0 1,640

যে ব্যক্তি মহান আল্লহ রাব্বুল আলামীনের একত্ববাদ ও রাসূল (সা.) এর রিসালাতে পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে বিশ্বাস স্থাপন করে তাঁর প্রতিটি হুকুম-আহকাম মেনে চলে তাকেই মুমিন বলে। অন্যভাবে বলা যায়, মহান আল্লাহ তায়ালা, তাঁর প্রেরিত সকল নবী, রাসূল, ফিরিশতা, আসমানী কিতাব, পরকাল ও তকদীরের ওপর পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে বিশ্বাস স্থাপন করে আর ঈমান গ্রহণের পর যে ব্যক্তি ঈমান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি তিনিই প্রকৃত মুমিন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম ও পবিত্র হাদীস শরীফে মুমিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। সংক্ষেপে মুমিন বান্দার কিছু গুণাবলী ও বৈশিষ্ট জেনে নিই।

১) প্রকৃত ঈমানদার তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান এনেছে এবং এ ব্যাপারে পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করেনি। তারপর প্রাণ ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে জিহাদ করেছে। তারাই সত্যবাদী। -(সূরা আল হুজুরাতঃ ১৫)

২) প্রকৃত ঈমানদার তো তারাই, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়া হয়, তাদের বিশ্বাস বেড়ে যায় এবং তারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে। তারা নামায কায়েম করে এবং যা কিছু আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে (আমার পথে) খরচ করে। এ ধরনের লোকেরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের রবের (আল্লাহর) কাছে রয়েছে বিরাট মর্যাদা, ভুল-ত্রুটির ক্ষমা ও উত্তম রিযিক। – (সূরা আল আনফালঃ ২-৪)

৩) মু’মিনদের কাজই হচ্ছে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রসূল তাদের মোকদ্দমার ফায়সালা করেন, তখন তারা বলেন, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। এ ধরনের লোকেরাই সফলকাম হবে। -(সূরা আন্ নূরঃ ৫১)

৪) তারাই এ ধরনের লোক যারা (এ নবীর দাওয়াত) গ্রহণ করেছে এবং আল্লাহর স্মরণে তাদের চিত্ত প্রশান্ত হয়। -(সূরা আর্ রাদঃ ২৮ )

৫) মু’মিনরা যেন ঈমানদারদের বাদ দিয়ে কখনো কাফেরদেরকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক, বন্ধু ও সহযোগী হিসেবে গ্রহণ না করে। যে এমনটি করবে, আল্লাহর সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ, তাদের জুলুম থেকে আত্মরক্ষার জন্য তোমরা যদি বাহ্যত এ নীতি অবলম্বন করো তাহলে তা মাফ করে দেয়া হবে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর নিজের সত্ত্বার ভয় দেখাচ্ছেন আর তোমাদের তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে। – (সূরা আলে-ইমরানঃ ২৮ )

৬) মু’মিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি মেহেরবানী করা হবে। -( সূরা আল-হুজুরাতঃ ১০ )

৭) মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, এরা সবাই পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। এরা ভাল কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে। এরা এমন লোক যাদের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হবেই। অবশ্যই আল্লাহ সবার ওপর পরাক্রমশালী এবং জ্ঞানী ও বিজ্ঞ। -(সূরা আতত তাওবাঃ ৭১)

৮) এ মুমিন পুরুষ ও নারীকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদেরকে তিনি এমন বাগান দান করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহমান হবে এবং তারা তার মধ্যে চিরকাল বাস করবে। এসব চির সবুজ বাগানে তাদের জন্য থাকবে বাসগৃহ এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।- (আত তাওবাঃ ৭২)

৯) সুসংবাদ দাও তাদেরকে যারা ঈমান এনেছে (তোমার প্রতি) যে, তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে বিরাট অনুগ্রহ। -(আল-আহযাবঃ ৪৭)

১০) আমি তোমার পূর্বে রসূলদেরকে তাদের সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাই এবং তারা তাদের কাছে আসে উজ্জ্বল নিদর্শনাবলী নিয়ে। তারপর যারা অপরাধ করে তাদের থেকে আমি প্রতিশোধ নিই আর মুমিনদেরকে সাহায্য করা ছিল আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। -(সূরা-আররূমঃ ৪৭)

১১) মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো। -(সূরা-আলে ইমরানঃ ১৩৯)

১২) হে ঈমান গ্রহণকারীগণ, তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করে দেবেন। (সূরা -মুহাম্মদঃ ৭)

১৩) যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী ও সহায়। তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর মধ্যে নিয়ে আসেন। আর যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করে তাদের সাহায্যকারী ও সহায় হচ্ছে তাগুত। সে তাদের আলোক থেকে অন্ধকারের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। এরা আগুনের অধিবাসী। সেখানে থাকবে এরা চিরকালের জন্য। -(সূরা আল-বাকারাহঃ ২৫৭)

১৪) পুরুষ বা নারী যে-ই সৎকাজ করবে, সে যদি মু’মিন হয়, তাহলে তাকে আমি দুনিয়ায় পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জীবন দান করবো এবং (আখেরাতে) তাদের প্রতিদান দেবো তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুসারে।-(সূরা আন্ন নহলঃ ৯৭)

১৫) আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যাকে আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা শুধু আমার বন্দেগী করুক এবং আমার সাথে কাউকে যেন শরীক না করে। আর যারা এরপর কুফরী করবে তারাই ফাসেক। (সূরা আন্ নূরঃ ৫৫)

১৬) নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে শীঘ্রই রহমান তাদের জন্য অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন। (সূরা মারয়ামঃ ৯৬)

১৭) ঈমানদারদেরকে আল্লাহ একটি শাশ্বত বাণীর ভিত্তিতে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে প্রতিষ্ঠা দান করেন। আর জালেমদেরকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ যা চান তাই করেন।-(সূরা ইবরাহীমঃ ২৭)

১৮) তবে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য রয়েছে নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত, যেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এ হচ্ছে আল্লাহর অকাট্য প্রতিশ্রুতি এবং তিনি পরাক্রমশালী ও জ্ঞানময়।-(সূরা-লোকমানঃ৮-9)

২০) লোকেরা বললোঃ তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনা সমাবেশ ঘটেছে। তাদেরকে ভয় করো, তা শুনে তাদের ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা জবাবে বলেছেঃ আমাদের জন্য আল্লাহ যথেষ্ট এবং তিনি সবচেয়ে ভালো কার্য উদ্ধারকারী। -(আলে ইমরানঃ ১৭৩)

হাদীসের আলোকে মুমিনের পরিচয়ঃ
রাসূলের (সাঃ) হাদীসে মুমিনের বিভিন্ন পরিচয় বর্তমান। যেমন- রাসূল (সাঃ) ফরমান:

১) আকমালুল মুমিনীনা ইমানান আহসানুহুম আখলাকা (আবু দাউদ)- অর্থাৎ যাদের চরিত্র উত্তম, তারাই পূর্ণ ঈমানদার

২) আলমুমেনু র্গেরুন কারীমুন ওয়াল ফাজেরু খাব্বুন লাইমুন- মুমি লোকেরা ঈষৎ অন্যমনষ্ক ও উদার হয়ে থাকে, আর পাপীরা হয় ধূর্ত, বদমাশ ও কৃপণ প্রকৃতির। (তিরমিযি, আবু দাউদ)

৩) ইন্নাল মুমিনা লিইউদ্রিকা বি হুস্নে খুলকিহী দারাজাতান কায়েমেল লাইলে ওয়া ছায়েমেন নাহারে।- পূর্ণ মুমিন বিশ্বাসীরা তাদের উত্তম চরিত্রের দ্বারা রাতের ইবাদতকারী এবং দিনের বেলায় রোজা পালনকারীর মর্যাদা লাভ করে। (আবু দাউদ)

৪) সব মুমিন এক অবিভাজ্য অখ- ব্যক্তির মতো; যদি কোনো ব্যক্তির চক্ষু ব্যথা হয় তার সর্বাঙ্গই তখন বেদনার্ত হয়Ñ যদি তার মস্তকে ব্যথা হয়, তার গোটা শরীরে সেই ব্যথা অনুভূত হয়। (মুসলিম)

৫) লা ইউমেনু আবদুন হাত্তা ইউহেব্বু লে আখিহে মা ইউহেব্বু লে নাফসিহে।- কোনো বান্দা ততক্ষণ পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের কোনো মুসলমান ভাইয়ের জন্য সেই জিনিস পছন্দ করবে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। (বোখারী, মুসলিম)

৬) লাইসাল মু’মিনু বিল্লাজি ইয়াশবায়ু ওয়া জারুহু জায়েয়ুন ইলা জানবিহী- সে ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে। (বায়হাকী)

৭) লা ইউলদাগুল মু’মিনু মিন জুহরেওঁ ওয়াহিদিন র্মা রাতাইন। এক গর্ত হতে মুমিনকে দুইবার র্দশন করা যায় না। (বোখারী, মুসলিম)

৮) লা ইউমেনু আহাদুকুম হাত্তা ইয়াকুনা হাওয়াহু তাবয়ান লিমা জেয়’তু বিহী- তোমাদের মধ্যে কেউ কাক্সিক্ষত মানের মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের প্রবৃত্তিকে আমার আনীত বিধানের অধীন না করে। (মিশকাত)

৯) লা ইউমেনু আহাদুকুম হাত্তা আহাব্বা ইলাইহে মিনওঁ ওয়লিদিহী ওয়া ওয়ালাদিহী ওয়ান নাসে আজমাইন- তোমাদের মধ্যে কেউই মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার পিতা-মাতা, ছেলেমেয়ে এবং অন্য সব মানুষের চেয়ে অধিকতর প্রিয় না হবো। (বুখারী, মুসলিম)

আমরা যারা নিজদের মুমিন বলে মনে করে থাকি তাদের উচিত কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিজদের গড়ে তোলা।

Leave A Reply

Your email address will not be published.