ইমাম আলী (আ.)-এর দৃষ্টিতে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য

0 375
আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করার পরে ইমাম আলী (আ.) বলেন : নিশ্চয় দুনিয়ায় মর্যাদার অধিকারীরাই হলো পরহেযগার (মোত্তাকীন)। তাদের কথাবার্তা সঠিক, তাদের পরিচ্ছদ মধ্যম। তাদের আচরণ বিনয়ী। তারা আল্লাহর নির্দেশের অধীন। মহামহিম আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন তা থেকে তারা চোখ ফিরিয়ে রাখে। জ্ঞানের প্রতি কান পেতে থাকে। বিপদ-আপদেও তারা সুখের অবস্থার মতোই আল্লাহর বিচারে সন্তুষ্ট থাকে। আল্লাহ যদি তাদের আয়ুস্কাল নির্ধারণ না করে রাখতেন তাহলে এক নিমেষের জন্যেও তাদের আত্মা তাদের দেহে আবদ্ধ থাকত না সওয়াবের প্রতি উচ্ছাস এবং শাস্তির ভয়ের কারণে।

সৃষ্টিকর্তা তাদের নিকটে মহান, আর অন্য সবকিছু তাদের চোখে তুচ্ছ। বেহেশতের প্রতি তারা এমন যেন তা দেখেছে এবং যেন তার নেয়ামতের মধ্যে বিরাজমান রয়েছে। আর দোযখের সাথে এমন যেন তা দেখেছে এবং তার শাস্তিকে ভালোমতো আস্বাদন করছে।

তাদের হৃদয় দুঃখভারাক্রান্ত, তারা অনিষ্ট করা থেকে দূরে। তাদের দেহ ক্ষীণকায় আর তাদের প্রয়োজন অল্প। তারা নিজেরা সৎ। আর ইসলামের প্রতি তাদের অবদান মহান। কয়েকটা দিন ধৈর্য ধারণ করেছে এবং তার পশ্চাতে দীর্ঘ ও লাভজনক আরাম লাভ করেছে। দয়ালু প্রতিপালক তাদের জন্যে এ ব্যবস্থা করেছেন।

দুনিয়া তাদেরকে চেয়েছে আর তারা দুনিয়াকে চায়নি। তাদের পেছনে ছুটেছে এবং তারা তাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। তবে রাত্রে তারা দণ্ডায়মান হয় এবং কোরআনকে ধীরক্রমে (প্রশান্ত চিত্তে) পাঠ করে আর তার দ্বারা নিজেদেরকে পরকালের দুঃখে দুঃখিত করে এবং নিজ বেদনার ঔষধকে তা থেকে গ্রহণ করে। এতে তাদের দুঃখ উথলে ওঠে এবং নিজ গোনাহ’র জন্য ক্রন্দন করে। যাতনাময় ও অন্তরভেদী হয়ে ওঠে। যখন উৎসাহজনক আয়াত পাঠ করে তখন তার প্রতি মনোনিবেশ করে লোভের বশে। তাদের মনসমূহ আগ্রহে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। আর মনে করে সে প্রতিশ্রুতি তাদের চোখের সামনেই উপস্থিত। আর যখন ভয়ের আয়াত পাঠ করে তখন মনোযোগ দিয়ে তা শোনে এবং মনে করে যে জাহান্নামের গর্জন ও দাউ দাউ শব্দ তাদের কর্ণ ভেদ করছে। তারা কোমর বেঁধে নিয়েছে এবং কপাল, হাতের তালু এবং আঙ্গুলের প্রান্তগুলো ভূমিতে বিছিয়ে দিয়েছে এবং মহান আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রার্থনা করছে।

কিন্তু দিনের বেলা তারা প্রজ্ঞাবান পণ্ডিত, সৎকর্মশীল পরহেযগার। আল্লাহর ভয় তাদেরকে তীরের শলাকার ন্যায় সরু করে দিয়েছে। কোন দর্শক তাদেরকে দেখলে ভাববে তারা রোগগ্রস্ত আর বলবে তারা তো উন্মাদ। অথচ মহান এক চিন্তা এ সম্প্রদায়কে এ অবস্থায় উপনীত করেছে।

আর তা হলো মহান আল্লাহর মহিমা ও তাঁর আধিপত্যের প্রচ-তা এবং মৃত্যু ও কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থার কথা স্মরণ। আর এটাই তাদের অন্তরসমূহকে উপড়ে ফেলেছে আর তাদের চিন্তাসমূহকে করেছে উদভ্রান্ত। আর তাদের বুদ্ধিসমূহকে হরণ করেছে। আর যেহেতু এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন, কাজেই তারা ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) দিকে ধাবমান। অল্পকর্মে সন্তুষ্ট থাকে না এবং নিজের অনেক বেশি কর্মকেও নগণ্য মনে করে।

তারা নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং স্বীয় কর্মের জন্য উৎকণ্ঠায় থাকে। যখনই কেউ তাদের কারো প্রশংসা করে তখন তার সম্পর্কে যা বলা হয় তা নিয়ে ভয়ে থাকে এবং বলে আমি অন্যের চেয়ে নিজের সম্পর্কে বেশি অবগত আর আমার প্রতিপালক আমার সম্পর্কে আমার চেয়েও বেশি অবগত। হে প্রতিপালক! তারা আমার সম্পর্কে যা বলে তা ধরো না। আর যা ধারণা করে তার চেয়ে আমাকে উত্তম করো আর যা জানে না সেটা ক্ষমা করে দাও। কারণ, তুমিই হলে অদৃশ্যের জ্ঞানের মালিক।

তাদের প্রত্যেকের চিহ্ন হলো এই যে, তাকে ধার্মিকতায় দেখবে শক্তিমান এবং চারিত্রিক কোমলতা সত্ত্বেও (আল্লাহর ভয়ে) ভীত, নিশ্চিত বিশ্বাসে বিশ্বাসী, জ্ঞানের প্রতি লোভী, বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে চতুর, ভীতির সাথে দান করে, দীনের ব্যাপারে ব্যুৎপত্তির অধিকারী, জ্ঞানকে সহিষ্ণুতার সাথে ধারণ করেছে, বিত্তশালীতার মধ্যেও মিতচারী, ইবাদাতে বিনয়ী, রিক্ততার মধ্যেও আড়ম্বর, বিপদে ধৈর্যশীল, শ্রমিকের প্রতি অনুগ্রহশীল, অধিকার প্রদান করে, শ্রম ও উপার্জনকে স্বীয় সঙ্গী জ্ঞান করে এবং হালাল রুজি অন্বেষণ করে। সত্যের পথে বিচক্ষণ, লোভ থেকে আত্মসংবরণ করে, অবিচল সৎকর্মপরায়ণ, কাম প্রবৃত্তির সময় আত্মসংযমী, অজ্ঞের প্রশংসা তাকে প্রতারিত করে না, নিজের কাজের হিসাব করে, নিজের জন্যে দুনিয়ার কাজে তাড়াহুড়া করে না।

উপযুক্ত কাজই করে, তারপরও ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। আর তার সন্ধ্যা (দিন অতিবাহিত) হয় এমনভাবে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের চেষ্টায় রত থাকে। আর তার সকাল (রাত অতিবাহিত) হয় এমনভাবে যে, তার সমগ্র চেষ্টা থাকে আল্লাহর যিকর (স্মরণ) করার। রাত্রি যাপন করে সাবধানে আর সকাল হয় আনন্দে। যে উদাসীনতা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা থেকে বিরত থাকে। আর আল্লাহ প্রদত্ত করুণা ও অনুগ্রহে খুশী থাকে। যদি অবাধ্য প্রবৃত্তি তাকে কু কর্মে আহ্বান জানায় সে তাতে সাড়া দেয় না। যা পরিহার করা উচিত তা পরিহার করে সে খুশী। আর অক্ষয় নেয়ামতেই তার চোখের জ্যোতিবৃদ্ধি। আর যা কিছু ধ্বংসশীল তাতে অনাগ্রহী। সহিষ্ণুতাকে জ্ঞানের সাথে এবং জ্ঞানকে আমলের সাথে মিশ্রিত করে। তাকে দেখবে যে আলসেমি তার মধ্যে নেই। আর তার কর্মউদ্দীপনা বিরামহীন। তার প্রত্যাশা কম আর তার বিচ্যুতি স্বল্প। তার অন্তর বিনত। তার আত্মা পরিতুষ্ট, অজ্ঞতা গোপন, কাজ সহজ, দীন রক্ষিত ও প্রবৃত্তি মৃত, ক্রোধ সংবরিত।

পবিত্র চরিত্রের। যে গোপন কথা তার কাছে সোপর্দ করেছে তা সে বন্ধুদেরকেও বলে না। সত্য সাক্ষ্যকে শত্রুর পক্ষে হলেও গোপন করে না। আত্ম প্রদর্শনার্থে কাজ করে না এবং লজ্জাবশতও তা পরিত্যাগ করে না। তার থেকে কল্যাণের আশা আছে আর তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ। যদি আত্মভোলাদের সঙ্গেও থাকে তাকে যাকেরদের (আল্লাহর স্মরণকারী) অন্তর্ভুক্ত হিসাবে লেখা হয়। কেউ তার প্রতি জুলুম করলে ক্ষমা করে। আর কেউ তাকে বঞ্চিত করলেও সে তাকে দান করে। যদি কেউ তার সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করে সে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তার সহিষ্ণুতায় ভাটা পড়ে না।

যা কিছু তাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে সে তা অর্জনে অক্ষম হয় না। গালমন্দ করে না। তার কথা কোমল। ধোকাবাজি করে না। সৎকর্ম অনেক। কল্যাণের অভিমুখী আর অকল্যাণের প্রতি পশ্চাৎমুখী। অস্থিতিশীলতার মধ্যে অবিচল। আর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ধৈর্যশীল। প্রাচুর্যের মধ্যে কৃতজ্ঞ। শত্রুর প্রতিও সত্যের পরিপন্থী কিছু করে না। বন্ধুর জন্যে গোনাহগার হয় না। যা তার প্রাপ্য নয় তার দাবী করে না। আর তার ওপর যে অধিকার রয়েছে তা অস্বীকার করে না। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দাঁড় করানোর পূর্বেই সত্যের স্বীকার করা। যা কিছুর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে সে আছে তা বিনষ্ট করে না। আর কাউকে মন্দ নামে আখ্যায়িত করে না।

সীমালঙ্ঘন করে না এবং এর চেষ্টাও করে না। প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। কাউকে বিপদের কারণে ভর্ৎসনা করে না। সত্যের প্রতি ধাবমান। আমানতকে পৌছে দেয়। নোংরামি থেকে দূরে থাকে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে।
মূর্খতাবশত দুনিয়ায় (অপ্রয়োজনীয় কর্মে) নিয়োজিত হয় না। আর সত্যকে অতিক্রম করে না। যদি নিশ্চুপ থাকে তাহলে সেজন্যে দুঃখিত হয় না। আর যদি হাসে তাহলে শব্দ করে না। যা কিছু আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকে। ক্রোধ তাকে উম্মত্ত করে না। কুপ্রবৃত্তি তার ওপর জয়ী হয় না। কৃপণতা তাকে পরাস্ত করে না। আর যা তার নয় সেজন্যে লোভ করে না। মানুষের সাথে মেশে যাতে জানতে পারে। আর নিশ্চুপ থাকে যাতে নিরাপদ থাকতে পারে। আর প্রশ্ন করে যাতে বুঝতে পারে। ভালোকে পাশ কাটিয়ে যায় না এবং তার বিপরীতে নিশ্চুপ থাকে না যে বিফল হবে। আর কথায় অন্যের প্রতি একরোখা হয় না। যদি তার প্রতি কেউ সীমালঙ্ঘন ও জুলুম করে তাহলে ধৈর্য ধারণ করে, যাতে মহামহিম আল্লাহ তার পক্ষে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন।

নিজেকে সে কষ্টে রাখে আর লোকেরা তার প্রতি আাশান্বিত থাকে। নিজেকে পরকালের জন্যে কষ্টে নিক্ষেপ করে। আর লোকদেরকে নিজের থেকে শান্তিতে রাখে। যার থেকেই (তার অন্যায় কর্মের কারণে) দূরে সরে যায়, সেটা ঘৃণা ও নিজেকে পবিত্র রাখার জন্যেই করে। আর যার প্রতিই নিকটবর্তী হয় সেটা নমনীয়তা ও দয়ার জন্যে। তার দূরে সরে যাওয়া অহঙ্কার ও বড়ত্ব প্রদর্শনের জন্য নয়। আর তার ঘনিষ্ঠ হওয়াও ধোকাবাজি ও কৃত্রিমতার জন্যে নয়। বরং তার পূর্বের যে কোন কল্যাণপন্থীর অনুসরণ মাত্র। আর নিজের পরে সৎকর্মশীলদের জন্য সে হয় নেতা। ( সূত্র: “তুহাফুল উকুল আন আলের রাসূল (সা.)”,”আলে রাসূল (সা.) থেকে বুদ্ধিমানদের জন্য উপহার”। মূল: শেখ আবি মুহাম্মাদ আল হাসান ইবনে আলী ইবনেল হুসাইন ইবনে শুবাত আল-হাররানি (রহ.), হিজরী চতুর্থ শতকের প্রখ্যাত পণ্ডিত।)

Leave A Reply

Your email address will not be published.