চিরনিদ্রার আগেই জাগ্রত হও

0 334

 চিরনিদ্রার আগেই জাগ্রত হও

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
আস্-সালামু ওয়া আছছালাতু ‘আলা সাইয়্যেদেল্ আম্বিয়া-এ ওয়াল্-র্মুসালীন্, হাবীবে ইলাহে নাব্ ও ত্বাবীবে নুফূসিনাআবীল্ ক্বাসেম্ মুহাম্মাদ। ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া ‘আলা আহলে বাইতিহিত্ব ত্বাইয়্যেবীনাত্ব ত্বাহেরীনাল্ মা‘ছূমীনাল্ মুর্কারামীন্। (সালাম ও দরূদ সকল নবী ও রাসূলের নেতা, সত্যিকারের ইলাহ্র বন্ধু এবং আমাদের নাফ্সের চিকিৎসক আবূল্ ক্বাসেম মুহাম্মাদের ওপর। আল্লাহ্ দরূদ করেন তাঁর ওপরে এবং তাঁর পূত-পবিত্র, নিষ্পাপ ও সম্মানিত আহলে বাইতের ওপর।)
হযরত আবূ ‘আবদুল্লাহ্ আল্-হোসেন্ সম্বন্ধে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেওয়াইয়াত্ বর্ণিত হয়েছে। ইতিপূর্বে আমি আরো অনেক রেওয়াইয়াত্ ও কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতের সাহায্যে এ রেওয়াইয়াতটির ব্যাখ্যা পেশ করেছিলাম; আজকেও আমি এ রেওয়াইয়াত্টি উল্লেখ করে তার ব্যাখ্যা পেশ করবো।

হযরত ইমাম হোসেনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো ঃ “আপনার দৃষ্টিতে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত মানুষ কারা?”
জবাবে হযরত দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিগূঢ় সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন ঃ “নারীই হোক বা পুরুষই হোক, তারাই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত মানুষদের অন্তর্ভুক্ত যারা নছীহতের বিষয়বস্তুতে পরিণত হওয়ার আগেই নছীহত গ্রহণ করে।”
অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত এ দুনিয়ায় আছে, যতক্ষণ তার আয়ুষ্কাল শেষ না হচ্ছে, অন্য দুনিয়ায় স্থানান্তরিত না হচ্ছে ততক্ষণ যত কিছু উপদেশ ও নছীহতের বিষয় আছে তা থেকে নছীহত গ্রহণ করতে হবে। কারণ, যখন কারো ‘আমলনামা বন্ধ হয়ে যায়, তাকে পরকালীন জগতের সফরে পাঠানো হয় তখন সেখানে নছীহত্ গ্রহণ করায় তার কোনোই ফায়দা নেই।
ধরুন, পরকালীন জগতে পৌঁছার পর কেউ বেহেশতবাসীদের বেহেশত লাভের পিছনে নিহিত রহস্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলো Ñ বেহেশতবাসীদের দেখে শিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলো। বেহেশতবাসীরা যে ধরনের ঈমানের অধিকারী ছিলেন, যে ধরনের চরিত্র ও আচরণের অধিকারী ছিলেন, যেরূপ পূত-পবিত্র ছিলেন, যেভাবে ‘ইবাদত-বন্দেগী করেছেন এবং যে সব খেদমত করেছেন এর সব কিছু থেকে যদি সে শিক্ষা গ্রহণ করে, এ শিক্ষা গ্রহণ থেকে সে কী ফায়দা লাভ করবে?
কোরআন মজীদে যেমন এরশাদ হয়েছে, সে জগত আমল করার জায়গা নয়। অন্যদিকে দুনিয়া হচ্ছে আমলের জায়গা, আমলনামা পর্যালোচনার জায়গা নয়। অন্যদিকে পরকালীন জগত হচ্ছে স্রেফ্ আমলনামা পর্যালোচনার জায়গা, তা আমল করার জায়গা নয়।
মানুষ সাধারণতঃ এ উদ্দেশ্যে ওয়ায-নছীহত শুনে থাকে যে, তদনুযায়ী আমল করবে; সাধারণতঃ এ উদ্দেশ্যে শিক্ষা গ্রহণ করে যে, তদনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু মানুষ যখন এমন এক পরিবেশে আসে যে জায়গায় কোনোদিনই আমল করা যাবে না সে জায়গায় এ নছীহত ও শিক্ষা তার কী কাজে লাগবে?
হযরত ইমাম হোসেন দ্বিতীয় নিগূঢ় সত্যটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন ঃ “এবং তাকে জাগ্রত করার আগে নিজেই জাগ্রত হয়।”
অর্থাৎ ‘আযাবের চাবূকের আঘাতে তাকে জাগ্রত করার আগেই সে জাগ্রত হয়।
আবূ হাম্যাহ্ ছূমালী-র দো‘আ হচ্ছে একটি অতুলনীয় দো‘আ; এ দো‘আর শুরুর দিকে আমরা যা পড়ি তাতে আমরা বলি ঃ “হে আল্লাহ্! আমাকে শাস্তির দ্বারা জাগ্রত করো না।” অর্থাৎ আমাকে ‘আযাবের শব্দে জাগ্রত করো না, আলমে বারযাখ্ ও ক্বিয়ামতের চাবূকের আঘাতের দ্বারা আমাকে জাগ্রত করো না।
এখানে আমি আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর একটি কথা উদ্ধৃত করতে চাই। অবশ্য তাঁর যে উক্তিটি উদ্ধৃত করতে যাচ্ছি তা মানব জাতির মধ্যকার সংখ্যাগুরু সম্পর্কে, সংখ্যলঘু সম্পর্কে নয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি যে, আপনারা, আমরা এবং আমাদের মতো আর যারা আছেন Ñ আমরা সকলে ঐ সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত যাদের সম্পর্কে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে এবং হাদীছেও এরশাদ হয়েছে। নাহ্জুল্ বালাগায় এরশাদ হয়েছে ঃ “তোমরা আল্লাহ্র পথে চলতে গিয়ে এ পথের পথিকদের সংখ্যাল্পতার কারণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ো না।”
বস্তুতঃ হযরত আদম (আঃ)-এর যামানা থেকেই তাদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম যারা আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পিত ছিলেন, সত্যের কর্মসূচী অনুযায়ী আমল করেছিলেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) খুবই মনঃকষ্টে ছিলেন, খুবই মানসিক অশান্তিতে ছিলেন, কারণ, তাঁর কথা ছিলো ঃ এই যে আমি এতো অকাট্য কথা বলছি, এতো অকাট্য সত্য তুলে ধরছি, এর বিনিময়ে তো আমি লোকদের কাছ থেকে কিছুই চাই না। আমি চাই যে, তারা মুক্তি লাভ করুক। তাহলে কেন তাদের মধ্য থেকে এতো কম লোক তা গ্রহণ করছে?
দশজনের মধ্য থেকে একজন কবুল করছে। যারা কবুল করছে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের মধ্য থেকেও অনেককে প্রত্যাখ্যান করবেন। কারণ, বুঝাই যাচ্ছে যে, তাদের কবুল করার বিষয়টি মূলবিহীন বৃক্ষের ন্যায়; এ ধরনের কবুলের পিছনে কোনো সত্যতা নেই।
এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন ঃولا تجد اکثرهم شاکرين.  “হে রাসূল! আপনি অধিকাংশ লোককেই (আল্লাহ্র প্রতি) কৃতজ্ঞ হিসেবে দেখতে পাবেন না।”
অর্থাৎ, আল্লাহ্ বলছেন, হে আমার বন্ধু! আপনি এমনটা আশা করবেন না যে, শতকরা একশ’ ভাগ লোক সত্যকে কবুল করে নেবে। বরং একশ’ জনের মধ্যে পঞ্চাশ জনেরও কম সংখ্যক লোক সত্যকে কবুল করবে। আল্লাহ্ তা‘আলা এদের সম্পর্কে বলেছেন ثلت من الاولين و قليل من الآخرين.  “প্রথম যুগের লোকদের থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এবং শেষ যুগের লোকদের থেকে স্বল্পসংখ্যক।”
অতএব, আমি হযরত আলী (আঃ)-এর যে কথাটি উদ্ধৃত করবো তা শুনে আপনারা মনঃকষ্টে ভুগবেন না। কারণ, আমিরুল মু’মিনীনের কথাটির লক্ষ্য আপনারা স্বল্পসংখ্যক নন।
তিনি বলেন ঃ الناس نيام اذا مات انتباهم  “লোকেরা ঘুমন্ত, যখন তারা মৃত্যুবরণ করে তখন জাগ্রত হয়।”
সেখানে যখন জাগ্রত হবে তখন তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, হক কী ছিলো, বাতিল কী ছিলো, আল্লাহ্ আছেন, নবুওয়াত্ সত্য, ইমামত সত্য, দায়িত্ব-কর্তব্য কী, ‘ইবাদত-বন্দেগী কী, খেদমত কী। কিন্তু কী করতে পারবে এখন? কারণ, আমলানামা লেখা শেষ হয়ে গেছে, ফিরে যাবার পথের দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে। কী করবে এখন? এ জাগ্রত হওয়ার ফায়দা কী? এ নির্ভুল দৃষ্টির ফায়দা কী?
বিস্ময়কর ব্যাপার; কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে, সেই চিরবিদায়ের মুহূর্তটি হবে অত্যন্ত কঠিন মুহূর্ত। তবে আবারও বলছি, এটা আপনাদের জন্য নয়।
হ্যাঁ, এ পথটা অত্যন্ত বিপদ সঙ্কুল পথ। মৃত্যুর পথ খুবই বিপদ সঙ্কুল। কিন্তু যে ব্যক্তি সত্যরূপ এক বিরাট গুপ্তধনের প্রেমিক তার জন্য তা কোনো বিপদই নয়। আপনাদের আমলনামায় কি স্তূপীকৃত বিপদ রয়েছে? আপনাদের আমলনামায় কি গুনাহের স্তূপ রয়েছে? আপনাদের আমলনামায় কি কবীরাহ্ গুনাহ্ আছে যে, ঐ মুহূর্তটি অত্যন্ত কঠিন ও ভয়াবহ মুহূর্ত হবে?
অবশ্য আমরা বলছি না যে, আমাদের আমলনামায় কোনোই গুনাহ্ নেই। আমাদেরও গুনাহ্ আছে, তবে তা স্তূপীকৃত নয়, কবীরাহ্ গুনাহ নয়, ভারী গুনাহ্ নয়। না আমরা পিতা-মাতার হক নষ্ট করেছি, না আমরা রেবা-র্খো, না অবৈধ যৌনসম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকারী, না লোকদের ওপর যুলুম করেছি, না লোকদের অধিকারকে পদদলিত করেছি, না লোকদের অন্তরকে অগ্নিদগ্ধ করেছি। অবশ্য আমাদের গুনাহ্ আছে, তবে আমাদের গুনাহ্ আমাদের ও আমাদের প্রিয়তমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাঁকে ভালোবাসতাম, কিন্তু কখনো কখনো গাফেল হয়েছিলাম। কখনো কখনো আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি, আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম। তবে আমরা একবার গুনাহ্ করেছি, কিন্তু কোরআন মজীদে তিনি শত বার বলেছেন ঃ “এসো, ক্ষমা করে দেবো।”
হ্যা, মৃত্যুর মুহূর্তে পর্দা পাশে গুটিয়ে রাখা হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন ঃ فکشفنا عنک غطائک فبصرک اليوم حديد. Ñ “অতঃপর তোমার (দৃষ্টিশক্তির সামনে) থেকে পর্দা উন্মোচন করে দেবো, সুতরাং এ দিন তোমার দৃষ্টিশক্তি হবে অত্যন্ত সুতীক্ষè।” তোমার দৃষ্টিশক্তি এমনই তীক্ষè হবে যে, তোমার বিগত সত্তর বছরের জীবনের সব কিছুই এক বারে ও একত্রে দেখতে পাবে। তোমার সব কিছুই তুমি ঐ মুহূর্তে দেখতে পাবে।
কিন্তু সকল সুযোগ যখন হাতছাড়া হয়ে যাবে তখন সেখানে সব কিছুই সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। তখন আর কিছুই করতে পারবেন না। আপনার জন্য তখন পথ অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু তখন আর কিছুই করতে পারবেন না। কারণ, মানুষের পথ চলার জন্য সময়ের প্রয়োজন।
অতএব, সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত মানুষ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যাকে জাগ্রত করার আগেই সে জাগ্রত হবে Ñ এই দুনিয়ার বুকে জাগ্রত হবে। আর মানুষকে যা জাগ্রত করবে তা খুবই নিষ্ঠুর।
আমি এ আলোচনা দীর্ঘায়িত করতে এবং মূল আলোচ্য বিষয় থেকে বিচ্যুত হতে চাই না। তবে এটা মূল আলোচ্য বিষয়ের সাথে নিঃসম্পর্ক নয়। কারণ, আমি হযরত ইমাম হোসেন (আঃ)কে কেন্দ্র করে জাগ্রত হওয়ার একটি ঘটনা তুলে ধরতে চাই।
‘আশূরার ঘটনার কয়েক দিন পরের কথা।
ইয়াযীদের বাহিনীর একটি ছোট্ট দল খুলী নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বে দামেশ্ক্বের দিকে যাচ্ছিলো। তারা আহ্লে বাইতের জীবিত সদস্যদেরকে বন্দী হিসেবে দামেশ্ক্বে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে পথটি বেছে নিয়েছিলো সেটি ছিলো এমন একটি পথ যেখানকার গ্রাম, মরুভূমি ও অন্যান্য এলাকার অধিবাসীরা আহ্লে বাইতের লোকদেরকে চিনতো না। তেমনি তারা বনী উমাইয়াহ্র লোকদেরকেও চিনতো না। এ পথের আশেপাশের অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিলো খৃস্টান ধর্মের অনুসারী।
আহ্লে বাইতের সদস্যদেরকে যদি কূফাহ্ থেকে সোজা পথে দামেশ্ক্বে নিয়ে যাওয়া হতো তাহলে সে পথে যেসব শহর ও জনপদ পড়তো সেসব শহর ও জনপদ ছিলো মুসলিম অধ্যুষিত। তাই তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এমন একটি পথ বেছে নেয়া হয় যা তুরস্কের পাশ দিয়ে মুছে¡ল্ ও বুছ্রাহ্ হয়ে দামেশ্ক্বে গিয়ে পৌঁছেছিলো। বর্তমানে ইরাক ও তুরস্কের যে সীমান্ত তার কাছাকাছি পথ দিয়ে তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এর উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, লোকেরা যাতে বন্দীদেরকে চিনতে না পারে। ফলে সৈন্যরা যদি আনন্দ করতে চায়, হৈহল্লা করতে চায় তাহলে যেন তা করতে পারে।
আসলে তারা বন্দীদেরকে প্রধান ও বহুল ব্যবহৃত পথ দিয়ে নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিলো।
তারা বিকাল বেলা এক জায়গায় পৌঁছে অবতরণ করলো এবং আহ্লে বাইতের সদস্যদেরকেও অবতরণ করালো।
ইব্নে শাহ্র্-অশূব্ লিখেছেন যে, তারা যেখানে আবতরণ করে সে জায়গাটি ছিলো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত একটি জায়গা এবং সেখানে খৃস্টান সন্ন্যাসীদের একটি মঠ ছিলো। সেখানে একজন খৃস্টান সন্ন্যাসী ছিলেন যিনি ছিলেন একজন মহান ব্যক্তি, অত্যন্ত ভদ্রনম্র লোক। তিনি সব সময় ‘ইবাদত-উপাসনায় রত থাকতেন।
যেখানে ইয়াযীদী বাহিনী অবতরণ করেছিলো সেদিকে উক্ত মঠের একটি জানালা ছিলো; জানালা দিয়ে তাদেরকে দেখা যাচ্ছিলো। তিনি রাতের প্রথম ভাগে মঠ থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে এলেন এবং সৈন্যদেরকে জিজ্ঞেস করলেন ঃ “তোমরা কা’রা? তোমাদের সাথে এ বন্দীরাই বা কারা? কোত্থেকে এসেছো এবং কোথায় যাবে?”
জবাবে তারা বললো ঃ “একটা গোষ্ঠী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলো। আর সরকার সে বিদ্রোহকে দমন করেছে। এরা হচ্ছে তাদের স্ত্রী ও কন্যা; আমরা এদেরকে দামেশ্ক্বে নিয়ে যাচ্ছি।”
তিনি বললেন ঃ “তোমাদের এ বাক্সে যা আছে তা আজ রাতের মতো আমার কাছে আমানত রেখে দাও।”
হ্যা, আসলে ওরা তো ছিলো অন্ধ, আর নিদ্রিত। কিন্তু উক্ত সন্ন্যাসী সেই রাতের প্রথম ভাগেই তাঁর কক্ষের ভিতর থেকে অন্ধকারে মধ্যে দেখেছিলেন, ঐ ছোট্ট বাক্সটির মধ্য থেকে আকাশের দিকে জ্যোতি উৎক্ষিপ্ত/ উৎচ্ছরিত হচ্ছে।
আল্লাহ্ যেমন, বলেছেন فکشفنا عنک غطائک  “অতঃপর তোমার থেকে পর্দা সরিয়ে দেবো”; হ্যা, পর্দাকে যখন পাশে সরিয়ে রাখা হয় তখন মানুষ বেশ ভালোভাবেই দেখতে পায়। সুতরাং কতোই না ভালো হয় যদি মানুষ মৃত্যুর আগেই পর্দাকে সরিয়ে রাখে যাতে সে হক ও বাতিলকে দেখতে পায়, বেহেশত ও দোযখ দেখতে পায়, আল্লাহ্কে ও দেবমূর্তিকে দেখতে পায় এবং সঠিক নির্বাচন করতে পারে।
এ ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না; বিভিন্ন গ্রন্থে তা পাওয়া যাবে। মোট কথা, তাঁর এ প্রস্তাব শুনে সৈন্যরা বললো ঃ “এ ব্যাপারে আমাদের যিনি প্রধান তাঁর সাথে কথা বলুন।”
“তোমাদের প্রধান কে?
 “খুলী।”
তিনি তাদের প্রধানের কাছে এলেন।
বস্তুতঃ যারা বস্তুবাদী তারা যেখানেই যাক বস্তুবাদী, অর্থপূজারীরা সবত্রই বস্তুবাদী। অর্থপূজারীদেরকে যেখানেই বসানো হোক তারা অর্থপূজারীই থাকে। আইনজীবী হয়, অর্থপূজারী; আলেম হয়, অর্থপূজারী; মন্ত্রী হয়, অর্থপূজারী; প্রাদেশিক প্রশাসক হয়, অর্থপূজারী। অর্থাৎ অর্থপূজারী অর্থপূজারীই থাকে। এমন লোক সবখানেই আছে যারা অর্থকে নিজের জন্য খোদা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
খুলী বললো ঃ “টাকা-পয়সা আছে; দিতে পারবে? তাহলে এ মাথাটাকে আজ রাতের মতো তোমাকে দেবো।” অর্থাৎ ‘আমরা অর্থ চাই, তাই অর্থ পেলে এ কাটা মাথাটা আমাদের কাছে না রেখে তোমার কাছে রাখতে কোনোই আপত্তি নেই।”
খৃস্টান সন্ন্যাসী বললেন ঃ “আমি আমার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু টাকা-পয়সা পেয়েছিলাম; তা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলাম। তা-ই তোমাদেরকে দেবো।”
তিনি মাথাটা নিয়ে তাঁর মঠের ভিতরে এলেন এবং তাঁর জায়নামাযের ওপর রাখলেন। তারপর বললেন ঃ “না, ওরা যা বললো তা নয়; আপনি তেমন লোক নন। ওরা মিথ্যা বলেছে। কারণ, আপনার ভিতরে বিরাটত্বের নিদর্শন রয়েছে। আপনার চোখ, আপনার চেহারা, গোটা মাথার অবস্থা Ñ সব কিছুতেই বিরাটত্বের মহানত্বের ছাপ রয়েছে। তাই আপনি তা নন যা ওরা বলেছে আপনার মহিমাময় নিদর্শন থেকে তা সুস্পষ্ট।”
জাগ্রত হও, তোমাদেরকে জাগ্রত করার আগেই। মানুষের জন্য এটাই উচিৎ যে, সে এখানে এই দুনিয়ায় জাগ্রত হবে।
না, আপনাদেরকে বলছি না। কারণ, আমাদেরকে জাগ্রত করেছেন।
সন্ন্যাসী বললেন ঃ “আমি আপনার চেহারায় যা দেখতে পাচ্ছি তা থেকে আমি নিশ্চিত যে, আপনি নিজেই নিজের পরিচয় দিতে সক্ষম। আমি ঐ মিথ্যাবাদীদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো না; ওরা মিথ্যা বলে। হ্যা, বলুন, আপনি কে? কে আপনি?”
তিনি নিজের পরিচয় দিলেন; কত চমৎকারভাবেই না নিজের পরিচয় দিলেন!
এ সংক্রান্ত বর্ণনার প্রথমাংশ খুবই প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে, তাঁর দুই ঠোঁট নড়ে উঠলো।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কাটা মাথা কি কথা বলতে পারে? হ্যা, পারে। কাটা মাথা যদি কথা বলতে না পারে তাহলে সূরাহ্ ফুচ্ছেলাত্ -এ এ আয়াতটি কেন শামিল করা হয়েছে? قالوا انتقنا الذی انتق کل شيء. Ñ “আমাদেরকে তিনিই কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন যিনি প্রতিটি জিনিসকেই কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছেন।”
আল্লাহ্ তা‘আলা হচ্ছেন সেই সত্তা যিনি যে কোনো জিনিসকেই কথা বলার ক্ষমতা দিতে পারেন। এখানে যে کل شيء অর্থাৎ ‘প্রতিটি জিনিস’ বলা হয়েছে, হযরতের কাটা মাথা কি এর মধ্যে শামিল নেই?
সন্ন্যাসী দেখলেন তাঁর ঠোঁট নড়ছে, খুব আস্তে Ñ তিনি এ দুনিয়ায় বেঁচে থাকাকালে যেভাবে ধীরে ও নীচু স্বরে কথা বলতেন ঠিক সেভাবে, ভদ্রনম্রতার সাথে, মহিমাময় কণ্ঠে, ভালোবাসা ও েহ-মমতা সহকারে, মর্যাদামণ্ডিত স্বরে কথা বলছেন। সন্ন্যাসী তাঁর কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারলেন আমরা যেভাবে কারো কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারি যে, কারো কণ্ঠস্বর ক্রুদ্ধ কিনা, তিক্ত কিনা, মন্দ, নাকি ভালো।
আমরা অনেক সময় বলি ঃ “তোমাকে ভালোবাসি”; যাকে বলি তার অন্তরে দোলা লাগে। আবার অনেক সময় বলি ঃ “হ্যাঁ, তোমাকে ভালোবাসি।” কিন্তু আসলে কিছুই না। কথা বলার ভঙ্গিরও অর্থ আছে, তাকানোর ধরনেরও অর্থ আছে।
হ্যাঁ, সন্ন্যাসী তাঁর কথা শোনার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছেন। হযরতের ঠোঁট দু’টো নড়ে উঠলো; তিনি বললেন ঃ انا ال…  “আমি …।”
সন্ন্যাসী বললেন ঃ “আমি বুঝতে পারি নি।”
হ্যাঁ, انا ال… থেকে তো কারো পরিচয় বুঝা যায় না। সন্ন্যাসী বললেন ঃ “জনাব! আরেকটু পরিষ্কার ভাষায় নিজের পরিচয় দিন।”
আসলে তখন সন্ন্যাসীর অবস্থা যে কী হয়েছিলো তা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই জানেন। হযরত বললেন ঃ انا المظلوم. “আমি যুলুমের শিকার।”
সন্ন্যাসী বললেন ঃ “এখনো চিনতে পারলাম না; আরো ভালোভাবে, আরো সুস্পষ্টভাবে আপনার পরিচয় দিন।”
তিনি বললেন ঃ انا ابن خديجة الکبری. “আমি খাদীজাতুল কুব্রার বংশধর।”
“খাদীজাহ্ কে? এমন কারো কথা বলুন যাকে আমার চেনার সম্ভাবনা আছে, যার কথা আমার জানা থাকার সম্ভাবনা আছে।”
“বেশ তো راهب، انا ابن محمد بن المصطفی. Ñ সন্ন্যাসী, শোনো, আমি মুহাম্মাদ মুস্তাফার বংশধর। راهب، انا ابن علی ابن ابی طالب. সন্ন্যাসী, আমি আলী ইব্নে আবী ত্বালিবের পুত্র।
ততক্ষণে সন্ন্যাসীর কাছে তাঁর পরিচয় পরিষ্কার হয়ে গেছে। এরপরও তিনি বললেন ঃ راهب، انا ابن فاطمة الزهراء. সন্ন্যাসী, আমি ফাতেমাহ্ যাহরার পুত্র।”
“এর মানে কী? তাহলে কেন আপনাকে হত্যা করলো? আশ্চর্য! আপনি তাহলে হোসেন ইব্নে আলী? আমি আমার এ সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না যে, আপনি আমার মেহমান, প্রিয় হোসেন! শাহী তাঁবূ থেকে এই দরবেশের আস্তানায়!”
সন্ন্যাসী! হোসেন মাত্র এক রাতের জন্য তোমার মেহমান ছিলেন। আর আমরা যখন মাতৃগর্ভে ছিলাম তখন থেকেই হোসেন আমাদের মেহমান। অনেক দিন থেকে তিনি আমাদের মেহমান।
সন্ন্যাসী বললেন ঃ “প্রিয় হোসেন! আমাকে শুধু একটি কথা দিন, তা হচ্ছে, ক্বিয়ামতের দিনে আমার জন্য শাফা‘আত্ করবেন।”
হযরত বললেন ঃ “তুমি এখন মুসলমান হও; আমরা যে কোনো মু’মিনের জন্য শাফা‘আত্ করবো।”
এরই নাম জাগ্রত হওয়া। হায়! জাগ্রত হওয়ার মূল্য কতই না বেশী!
এদিকে মরুভূমির খবর কী?
তাঁর বাচ্চারা কোথায়? তাঁর ফুফু কোথায়?
মরুভূমিতে; মরুভূমিতে তছনছ হয়ে গেছে; সব কিছু মরুভূমিতে তছনছ হয়ে গেছে।
তিরিশ হাজার লোক মাত্র তিরিশ-চল্লিশটা তাঁবূর ওপর হামলা করেছিলো। তারা নারীদের ওপর, বড় মেয়েদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিলো। ছোট ছোট শিশুরা এ হামলা দেখে দিশাহারা হয়ে পড়ে। আব্বাস্! কোথায় তুমি? আকবর! কোথায় তুমি?
মুসলিম ইবনে ‘আক্বীলের একজন নাতি ছিলো; তাঁর পুত্রের সন্তান, নাকি কন্যার সন্তান উল্লেখ নেই। সে যখন শোরগোল শুনতে পেলো, যখন দেখলো যে, তাঁবূগুলোর ওপর হামলা করছে, সব কিছু ছুঁড়ে মারছে, আগুন লাগাচ্ছে, নারীরা পালিয়ে গেলেন, মেয়েরা পালিয়ে গেলো। চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা। নয় বছর বয়সী এ বাচ্চাটা দিশাহারা ও আতঙ্কিত অবস্থায় তাঁবূ থেকে বেরিয়ে এলো। সাথে সাথে দশ জন লোক এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। একজন তলোয়ারের আঘাতে তাকে দুই টুকরা করে ফেললো।

Leave A Reply

Your email address will not be published.