পবিত্র আশুরা ও মহররম-৮

0 442

আশুরা উপলক্ষে ওস্তাদ আয়াতু্ল্লাহ মিসবাহ তাকী ইয়াযদীর অষ্টম বক্তব্য

55

(হোসাইনিয়ায়ে শুহাদা ঃ ২৯-০১-৭৯ ফার্সী সাল/ ১৮-০৪-২০০০ খৃস্টাব্দ)

بسم الله الرحمان الرحيم. الحمد لله رب العالمين و الصلوة و السلام علی سيد الانیياء و المرسلين حبيب الله العالمين ابی القاسم محمد و علی آله الطيبين و الطاهرين المعصومین. اللهم کن لوليک الحجة بن الحسن صلواتک عليه و علی آبائه فی هاذه الساعة و فی کل الساعة ولیاٌ و حافظاٌ و قاعداٌ و ناصراٌ و دليلاٌ و عيناٌ حتی تسکنه ارضک طوعاٌ و تمتعه فيها طويلاٌ

হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইন (আঃ), তাঁর পুত্র হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন সাজ্জাদ (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীসাথী কারবালার সকল শহীদের শাহাদাত উপলক্ষ্যে হযরত ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন), মহান রাহ্বার, মহান মার্জা’এ তাক্বলীদগণ ও আহ্লে বাইতের আদর্শের ভক্ত অনুসারীদের সকলের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আশা করি মহান আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর ওলীগণের ও আহ্লে বাইতের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনের তাওফীক দেবেন এবং এ দুনিয়ায় ও পরকালে তাঁদের সাথে আমাদের সম্পর্ককে কখনো দুর্বল হতে দেবেন না।
আপনারা যেমন জানেন বিগত কয়েকটি আলোচনায় আািম আশূরা সম্পর্কিত ও আশূরা কেন্দ্রিক এবং হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর অভু্যত্থান সংক্রান্ত যে সব প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয় এবং যা প্রধানতঃ তরুণ ও যুবকদের মাথায় জাগ্রত হয় ও তারা যার সুস্পষ্টতর জবাব সন্ধান করে তা নিয়ে আলোচনা করেছি। এ ক্ষেত্রে যে সব প্রশ্ন বেশী উপস্থাপন করা হয় তার মধ্য থেকে বিগত আলোচনায় একটি প্রশ্নের প্রতি আভাস দিয়েছি। তা হচ্ছে, আমরা সকলেই শুনেছি যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য অভু্যত্থান করেন। এটা হচ্ছে একটি সাধারণ তথ্য, কিন্তু আমাদের নিকট পুরোপুরি সুস্পষ্ট নয় যে, তিনি ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য কীভাবে অভু্যত্থান করেছিলেন এবং এ জন্য কী মাধ্যম বা উপায়-উপকরণ ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া তিনি যে লক্ষ্যে অভু্যত্থান করেছিলেন তিনি কি সে লক্ষ্যে উপনীত হতে পেরেছিলেন, নাকি পারেন নি?

হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর ভাই মুহাম্মাদ হানাফিয়্যাহ্র উদ্দেশে যে লিখিত অছিয়্যাত্ করেন তা আপনারা সকলেই জানেন। আমরা এ অছিয়্যতনামার অংশবিশেষ আপনাদের উদ্দেশে পাঠ করেছি এবং তা নিয়ে আলোচনা করেছি। এ ক্ষেত্রে আমরা انما خرجت لطلب الاصلاح فی امة جدی “অবশ্যই আমি আমার নানার উম্মাতের ইছ্লাহের সন্ধানে বহির্গত হয়েছি।” _ কথাটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছি। এরপর সম্মানিত রাহ্বারের (আল্লাহ্ তাঁর মর্যাদামণ্ডিত ছায়াকে আমাদের ওপর অব্যাহত রাখুন) উক্তি নিয়েও আলোচনা করেছি।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে انما خرجت لطلب الاصلاح فی امة جدی কথাটির পরে বলেন ঃ امر بالمعروف و نهی عن المنکر _ “ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ”। হ্যা, আপনারা এ-ও বহু বার শুনেছেন যে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”-এর লক্ষ্যে আশূরার অভু্যত্থান সংঘটিত হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্” নামক সংগঠন এ ব্যাপারে একটি চমৎকার উদ্ভাবনীর পরিচয় দিয়েছে। তা হচ্ছে আশূরার দিনগুলোকে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্-এর সপ্তাহ্ বা দশক (দশ দিন)” নামকরণ করেছে। কারণ, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) এ উদ্দেশ্যে অভু্যত্থান করেছিলেন।
হ্যা, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”-এর উদ্দেশ্যে অভু্যত্থান করেছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও বেশ দুর্বোধ্যতা থেকে যাচ্ছে। তা হচ্ছে, আমরা যে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”-এর কথা শুনে আসছি, পত্রপত্রিকায়ও যে ব্যাপারে লেখালেখি হচ্ছে, অন্যান্য প্রচার মাধ্যমেও বলা হচ্ছে এবং ওলামায়ে কেরাম যা নিয়ে আলোচনা করছেন, কতগুলো দিক সহকারে তার একটি বিশেষ অবস্থা আছে। কিন্তু আমরা এমন কোনো “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”-এর কথা শুনি নি যে, কোনো ব্যক্তি যার জন্য স্ত্রী ও সন্তানদের হাত ধরে পানি ও তৃণ বিহীন মরুভূমিতে চলে যান এবং সেখানে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেন। এটা কী ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”? অথচ আমরা দেখছি, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্” সম্বন্ধে যখন কথা বলা হয় তখন এ কাজের জন্য বিভিন্ন শর্তের উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”-এর দায়িত্ব পালনের জন্য শর্ত হচ্ছে এই যে, এতে যেন ব্যক্তির নিজের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে। অথচ হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে এ ক্ষেত্রে তাঁর নিজের ক্ষতি হবে জেনেশুনেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তাহলে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্” সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা ও হযরত ইমাম (আঃ)-এর আচরণের মধ্যে সমন্বয় কোথায়?
“আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”-এর যে আহ্কামের সাথে আমরা পরিচিত তাকে সঠিক মনে করলে তার ভিত্তিতে প্রশ্ন জাগে, এ ব্যাপারে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যা করলেন তা কি তাঁর ওপর আসমান থেকে নাযিলকৃত কোনো আলাদা বিশেষ হুকুম ছিলো যা কেবল তাঁরই জন্য প্রযোজ্য ছিলো?
অনেকে অবশ্য এমনটাই বলে থাকেন। তাঁরা বলেন, আহ্লে বাইতের মা’ছূম ইমামগণ (আঃ)-এর প্রত্যেকেরই একেকটি বিশেষ দায়িত্ব ছিলো যা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তাঁদের জন্য নির্ধারিত ছিলো। এর কোনো সাধারণ মানদণ্ড ছিলো না এবং একজনের জন্য নির্ধারিত দায়িত্ব অন্যদের জন্য প্রযোজ্য ছিলো না। আসলেই কি ব্যাপারটি এ রকম যে, এ ছিলো একটি বিশেষ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্” যা এভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) আদিষ্ট ছিলেন? নাকি এটা সম্ভব যে অন্য কতক লোকের জন্যও এমন একটা সময় আসতে পারে যখন তাদেরকে এভাবেই দায়িত্ব পালন করতে হবে?
এগুলো হচ্ছে এমন কতগুলো প্রশ্ন যে, শেষ পর্যন্ত হয়তো এগুলোর জবাব হবে নেতিবাচক। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব প্রশ্নকে গুরুত্ব প্রদান করা এবং এগুলোর সুস্পষ্ট জবাব দেয়া প্রয়োজন। তবে এ প্রশ্নগুলোর বিস্তারিত জবাব দেয়ার আগে কোরআন মজীদ, হাদীছ ও রেওয়াইয়াত এবং আহ্লে বাইতের বাণীর আলোকে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্”-এর গুরুত্বের ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আভাস দেয়া প্রয়োজন মনে করছি।
হ্যা, এটা আমরা সবাই জানি যে, মক্তবে বা প্রাইমারী স্কুলে বা তারও আগে ঘরের মধ্যে পিতা-মাতাগণ যখন শিশুদেরকে দ্বীনের মৌলিক নীতিমালা ও দ্বীনের বিস্তারিত বিধিবিধান শিক্ষা দেন, তখন সপ্তম ও অষ্টম মূলনীতি হিসেবে শিক্ষা দেন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” তথা ভালো কাজে আদেশ দান ও “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্” অর্থাৎ মন্দ কাজ প্রতিরোধ। এর মানে হচ্ছে নমায যেমন ফরয, রোযা যেমন ফরয, তেমনি এ দু’টি কাজ ফরয হওয়ার বিষয়টি সকল মানুষের জন্যই সুস্পষ্ট। অর্থাৎ এ দু’টি কাজ দ্বীনের অপরিহার্য বিষয়াবলীর অন্যতম। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, কেউ এসে বলবে যে, আমার ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইসলামে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্” নেই। এ ধরনের কথা হতে পারে না। কারণ, কোরআন মজীদে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্্” সম্পর্কে প্রচুর ও বিভিন্ন ধরনের আয়াত রয়েছে যার ফলে এ ব্যাপারে সংশয়ের বা অস্পষ্টতার কোনো অবকাশই নেই।
এ ব্যাপারে অনেক রেওয়াইয়াতও রয়েছে। এখানে রেওয়াইয়াত হতে বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে আমি এসব রেওয়াইয়াতের মধ্য থেকে কয়েকটি উদ্ধৃত করবো যাতে আপনারা আহ্লে বাইত (আঃ)-এর সংলাপ ও আলোচনার ধরন এবং তৎকালে মুসলমানদের ও দ্বীনদার লোকদের মন-মস্তিষ্কে কী ধরনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত ছিলো তার সাথে পরিচিত হতে পারেন।
শেখ তূসী (রহ্ঃ) কর্তৃক সংকলিত হাদীছ গ্রন্থ “তাহ্যীব” হচ্ছে শিয়া মাযহাবের চারটি বিখ্যাত হাদীছ গ্রন্থের অন্যতম। এ গ্রন্থের একটি হাদীছ এখানে তুলে ধরছি। হাদীছটি জাবের কর্তৃক হযরত ইমাম বাকের (আঃ) থেকে বর্ণিত। দৃশ্যতঃ এখানে জাবের বলতে জাবের ইবনে ইয়াযীদ জায়েফী-কে বুঝানো হয়েছে। অবশ্য অনেকে মনে করেন যে, এ জাবের হচ্ছেন জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্। তিনি হযরত ইমাম বাকের (আঃ)-এর যুগে বেঁচে ছিলেন। আমি এর সনদের ব্যাপারে গবেষণা করার অবকাশ পাই নি। এ হাদীছের বর্ণনাকারীদের ধারাক্রম এটি জাবের ইবনে আক্বী ও জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্র সাথেও খাপ খায়, তবে তাঁর জাবের ইবনে ইয়াযীদ জায়েফী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী _ যিনি ছিলেন হযরত ইমাম বাকের (আঃ)-এর একান্ত সাথীদের অন্যতম _ যাদেরকে তিনি গোপন কথাও বলতেন।
তিনি হযরত ইমাম বাকের (আঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ইমাম (আঃ) এরশাদ করেন ঃ
آخر الزمان قوم يتبع فيه القوم المراعون، يتقرؤن و يتمسکون خلفاء الصحفاء، لا يجبون امر بالمعروف و لا نهي عن المنکر الا اذا عمل الضرر، يطلبون لانفسهم رخص المعاذير
আপনারা যাতে ক্লান্ত না হন এ কারণে এ রেওয়াইয়াতের পুরো আরবী পাঠ একবারে উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকলাম। অন্যদিকে এর বক্তব্যের আক্ষরিক অনুবাদও পুরোপুরি বোধগম্য হবে না, তাই অংশতঃ ব্যাখ্যা সহ অনুবাদের আশ্রয় নেবো।
মোদ্দা কথা, ইমাম (আঃ) এরশাদ করছেন ঃ শেষ যুগে এমন এক জনগোষ্ঠী হবে যারা তাদের মধ্যকার একটি ক্ষুদ্র বিশেষ গোষ্ঠীর অনুসরণ করবে এবং তাদের আচরণ ও কথার ওপর আস্থা স্থাপন করবে। স্বাভাবিকভাবেই এই জনগোষ্ঠী তাদের ওপর আস্থা স্থাপন করবে যাদেরকে তারা আলেম হিসেবে গণ্য করবে। জনগণ তাদেরকে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য লোক বলে মনে করবে এবং এ কারণে তাদের কথা মেনে চলবে।
এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীটির বৈশিষ্ট্য হবে এই যে, يتقرؤن و يتمسکون _ এখানে يتقرؤن ; কথাটির আক্ষরিক তাৎপর্য উদ্দেশ্য নয়। এ শব্দটি “কি্বরাআত্” (قرائت) বা “পাঠ করা” মূল থেকে উদ্ভূত। সে যুগে অর্থাৎ ইসলামের প্রাথমিক যুগে সব চেয়ে বড় আলেম হিসেবে তাঁদেরকে গণ্য করা হতো যারা কোরআন মজীদ সম্বন্ধে খুব ভালো জ্ঞান রাখতেন এবং অন্যদেরকে শিক্ষা দিতেন। তাঁরা কোরআন বিষয়ক বিভিন্ন জ্ঞানে সুদক্ষ ছিলেন। তখন এ লোকদেরকে বলা হতো “কুর্রা” (قراء) অর্থাৎ “ক্বারীগণ”। উদাহরণ স্বরূপ, যখন কোনো শহর বা দেশ বা নতুন ইসলাম গ্রহণকারী কোনো জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে দ্বীনপ্রচারক পাঠানোর অনুরোধ জানানো হতো তখন সেখানে এই “কুর্রা”র মধ্য থেকে কাউকে পাঠানো হতো। তাঁরা জনগণের উদ্দেশে কোরআন পাঠ করতেন এবং তার ব্যাখ্যা করতেন ও তাদেরকে শিক্ষা দিতেন। এভাবে তাঁরা তাদেরকে হেদায়াত করতেন।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আলেম হিসেবে “কুর্রা”র মর্যাদা ছিলো এমনই উঁচু এবং তাঁরা অত্যন্ত বিখ্যাত ছিলেন। এ কারণে কিছু লোক “কুর্রা”র বেশ ধারণ করতো। অর্থাৎ তাদের মধ্যে এ যোগ্যতা ছিলো না, কিন্তু তারা এ যোগ্যতার অধিকারী হবার ভান করতো। আজকের যুগের পরিভাষায় যদি বলি তাহলে এরা ছিলো আলেম-সাজা লোক বা ভণ্ড আলেম। হযরত ইমাম বাকের (আঃ) এরশাদ করেন যে, শেষ যুগের লোকেরা এ ধরনের আলেম-সাজা লোকদের বা ভণ্ড আলেমদের অনুসরণ করবে যারা “কুর্রা” হবার অর্থাৎ আলেম হবার ভান করবে। তেমনি يتمسکون  তারা ইবাদত করারও ভান করবে।
“নাসেক্” (ناسک) মানে ইবাদতকারী এবং يتمسکون মানে “তারা ইবাদতের ভান করে।” আসলে তারা ইবাদতকারী লোক নয়, কিন্তু জনগণের সামনে তারা নিজেদেরকে ইবাদতকারী হিসেবে তুলে ধরে যাতে লোকেরা মনে করে যে, তিনি অনেক বেশী ইবাদত করেন। خلفاء الصحفاء অর্থাৎ এই লোকেরা _ জনগণ যাদের অনুসরণ করে, এরা হচ্ছে একদল হাল্কা ও ভাসা ভাসা জ্ঞানের অধিকারী লোক যাদের মধ্যে জ্ঞানের গভীরতা নেই।
জনগণের দ্বারা অনুসৃত এই লোকেরা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব বলতে কিছু আছে বলে মনে করে না। لا يجبون امر بالمعروف و لا نهي عن المنکر الا اذا عمل الضرر _ তারা লোকদেরকে বলে যে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” ফরয নয় যদি না তা ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত হয়, যদি না এ ব্যাপারে কথা বলা ও না বলা কোনোটাতেই তোমাদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি না হয়। আর যদি অসুবিধার সৃষ্টি হয় তাহলে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” ফরয নয়; এমতাবস্থায় এ ব্যাপারে কথা না বলাই উচিৎ।
আর يطلبون لانفسهم رخص المعاذير _ এই লোকেরা আমল ও তাকওয়ার বাহ্যিক প্রদর্শনী করে মাত্র। কিন্তু আসলে তারা দায়িত্ব এড়াবার জন্য বাহানা খুঁজতে থাকে। কারণ, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” হচ্ছে এমন দায়িত্ব যা পালন করতে গেলে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক বিভিন্ন ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি হবেই; অসুবিধাই এর পরিণতি। কারণ, যাদেরকে মুন্কার্ বা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা হবে তারা কিছুতেই অন্তর থেকে নিষেধকারীর ওপর সন্তুষ্ট হবে না। ফলে তারা আর মানুষের কাছে প্রিয় থাকতে পারবে না। ফলে লোকেরা আর তাদেরকে পার্থিব দিক থেকে সাহায্য-সহায়তা করবে না এবং তাদেরকে সম্মান দেখাবে না। বরং লোকেরা তাদের চারদিক থেকে সরে যাবে।
আপনি যখন কাউকে বলবেন, অমুক কাজটি কেন করছো? তুমি যে অমুক লেনদেনটি করেছো তা ছহীহ্ হয় নি। বিয়ের অনুষ্ঠান এ ধরনের করেছো কেন? ঐখানে গান-বাজনার অনুষ্ঠান করেছো কেন? ঐখানে নাচের অনুষ্ঠান করলে কেন? ঐখানে পাপাচার হচ্ছে কেন? এভাবে মদপান ও অন্যান্য বিষয়ের কথা আসবে। তারা তো আপনার এসব কথা পসন্দ করবে না, অতএব, তারা আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বললেও এমনটাই ঘটবে।
হ্যা, ঐ লোকেরা জনগণের মধ্যে নিজেদের সামাজিক অবস্থান নষ্ট না করার জন্য এ জাতীয় বিষয়ে কথা না বলার চেষ্টা করে। দায়িত্ব এড়াবার জন্য তারা বাহানা বের করার তালে থাকে যাতে লোকদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। তারা লোকদের সাথে মিলেমিশে চলে। হ্যা, এরা হচ্ছে আলেম-সাজা লোক। প্রকৃত পক্ষে এরা লোকদের পথপ্রদর্শন ও নেতৃত্ব দানের যোগ্যতা রাখে না। তারা নিজেদের জন্য একটি সুবিধাজনক অবস্থান তৈরী করে নিয়েছে। তারা তাদের সে অবস্থান রক্ষা করার লক্ষ্যে প্রকৃত আলেমদেরকে কোণঠাসা করার ও ময়দান থেকে বের করে দেয়ার এবং জনগণের দৃষ্টি তাঁদের দিক থেকে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তারা প্রকৃত আলেমদের দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, তাঁদের দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়। সব চেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে, তাঁদের কথা ও কাজের মধ্যে কোনো ভুলত্রুটি খুঁজে বের করা। তারপর তারা সে ভুলত্রুটিকে অণুবীক্ষণের নীচে রেখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পর্যালোচনা করে।
আর প্রকৃত আলেমগণও তো মা’ছূম নন; কোনো না কোনো সময় তাঁরা কোনো ভুল করতেই পারেন। যেমন ঃ তাঁরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বক্তৃতা করেন; একশ’টা বক্তৃতা করলে একটা বাক্য ভুল হতেই পারে। তাঁদের কেউ হয়তো তাঁর বক্তৃতায় কোনো সংখ্যা বা পরিসংখ্যান উল্লেখ করলেন, ধরুন তাতে সংখ্যাটি ভুল উল্লেখ করলেন; কোরআন মজীদের আয়াত উদ্ধৃত করলেন, তাতে এক জায়গায় ভুল করলেন। তখন শ্রোতাদের মধ্যে অবস্থানকারী ঐ লোকেরা যখন তাঁর ভুলটি ধরতে পারে তখন তারা বলে, এ লোকটা ভুল বলছে, সে কোরআন তেলাওয়াত করতেই জানে না, সে অমুক পরিসংখ্যানটা ভুল বলেছে।
বস্তুতঃ কেউ যদি দশ মিনিট কোথাও বক্তৃতা করে তখন তার পক্ষে বোঝা সম্ভব যে, বক্তৃতা করার ক্ষেত্রে কী ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মোদ্দা কথা, এই লোকেরা প্রকৃত আলেমদের দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়। তারপর তারা সে দুর্বলতাকে অণুবীক্ষণ দিয়ে পর্যালোচনা করে। যেমন, তারা বলে যে, অমুক ব্যক্তি অমুক শব্দটি ভুল বলেছে, অমুক বিষয়টি ভুল বলেছে। তাছাড়া তাকওয়ার অধিকারী যে কোনো আলেমও কোনো না কোনো ক্ষেত্রে আচরণে দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে বসতে পারেন। আর নূ্যনতম ব্যাপার এই যে, বক্তব্যে ভুল করতে পারেন। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি খুবই তাকওয়ার অধিকারী হন, এমনকি যদি মা’ছূমের কাছাকাছিও হন, মা’ছূমের তো ভুল নেই, কিন্তু এরূপ ব্যক্তির ভুল হতেই পারে। তেমনি তিনি কোনো অনুচিৎ কাজও করে বসতে পারেন। এমনকি তিনি নিজের জন্য কোনো কাজকে ফরয গণ্য করতে পারেন, কিন্তু পরে বুঝতে পারেন যে, তিনি ভুল করেছেন। মোট কথা, শ্রেষ্ঠতম আলেমগণের ও শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্যেও কোনো দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু ঐ সব ভণ্ড আলেম প্রকৃত আলেমদের মধ্যে দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়, তারপর তাকে কয়েক গুণ বড় করে প্রচার করে। তারা তিলকে তাল করে তোলে, খড়ের গাদাকে পাহাড় বানিয়ে ছাড়ে এবং ঐ প্রকৃত আলেমদেরকে জনচক্ষে দুর্বল ও খাটো করার চেষ্টা করে। আজকের যুগের পরিভাষায় বলা চলে যে, তারা ঐ প্রকৃত আলেমদের চরিত্রহনন করে যাতে জনগণ তাঁদের কাছ থেকে দূরে সরে যায় এবং এদের চারদিকে জমায়েত হয়।
এগুলো আমার কথা নয়। হযরত ইমাম বাকের (আঃ) তাঁর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিষ্য ও অনুসারী জাবেরের নিকট এ কথা বলেছেন এবং শেখ তূসী তাঁর “তাহ্যীব্” গ্রন্থে তা উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম (আঃ) বলেন ঃ يتبعون ظلات العلماء _ এরা আলেমদের ছায়ার পিছনে লেগে থাকে, প্রকৃত আলেমদের ভুলত্রুটি ও দুর্বলতা খুঁজে বেড়ায়। কোথাও হয়তো তাঁদের কোনো কাজে ভুল হয়েছে, কোনো ত্রুটি হয়ে গেছে; এরা সে ভুলত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য উঠেপড়ে লাগে যে, কোথায় ভুল করেছেন, কী ধরনের ভুল করেছেন।
ইমাম (আঃ) বলেন ঃ مقبلون ان الصلاة و الصيام و ما لا يکلفهم فی نفسه و لا مال _ এই ভণ্ড আলেমরা সাধারণ মানুষের সামনে যায় এবং নামায আদায় করে, রোযা রাখে এবং ঐ সব কাজ করে যা করলে তাদের জান ও মালের কোনো ক্ষতি হবে না। তারা এ ধরনের কাজ সমূহকে গ্রহণ করে। ما لا يکلفهم فی نفسه  و لا مال অর্থাৎ যে সব কাজ তাদের জান ও মালের ক্ষতি করে না।
কিন্তু “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” তাদের জান ও মালের ক্ষতি করে। এর নূ্যনতম ক্ষতি এই যে, লোকেরা যে তাদেরকে আগে সাহায্য করতো অতঃপর আর সাহায্য করে না। ধনী লোকেরা আর তাদেরকে সাহায্য করে না। কারণ, বেশীর ভাগ গুনাহ্ করে ধনীরা, পুঁজিপতিরা। বড় বড় পাপ কাজের উপায়-উপকরণ তাদের হাতেই আছে। তাই কেউ যখন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করতে চায় তখন তাকে পেশীশক্তির অধিকারীদের বা অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার অধিকারী লোকদের মোকাবিলা করতে হয়। ফলে তাদের স্বার্থের ক্ষতি হয়। তাই ঐ লোকেরা কেবল এমন ইবাদতের পিছনে ছোটে যা তাদের জান ও মালের ওপর সামান্যতম আঘাতও টেনে আনবে না।
و لو اقم الصلاة بسائر ما يعملون و اموالهم و ابدانهم و رفضوها کما رفضوا اتم الفرايض _ কিন্তু কখনো যদি তাদের সামনে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, নামায আদায় করলেও তাদের জান-মালের জন্য অসুবিধা হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে তারা নামাযও পরিত্যাগ করে। কারণ, তাদের নিকট “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” পরিত্যাগের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে ক্ষতি না হওয়া। যেহেতু তারা ভয় করে যে, এ দায়িত্ব পালন করলে জান ও মালের ক্ষতি হবে সেহেতু তারা এ কাজ পরিত্যাগ করে, সেহেতু নামায আদায় করলে যদি জান বা মালের ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে তাহলে একই যুক্তিতে তারা নামাযও পরিত্যাগ করে کما رفضوا اتم الفرايض و اشرفها _ ঠিক যেভাবে তারা পরিপূর্ণতম ও শ্রেষ্ঠতম ফরয কাজ অর্থাৎ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” এ কারণেই পরিত্যাগ করেছে।
ইমাম (আঃ) “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”কে বলছেন পরিপূর্ণতম ফরয ও শ্রেষ্ঠতম ফরয কাজ। অর্থাৎ তার গুরুত্ব নামাযের চেয়েও বেশী। ان الامر بالمعروف و نهي عن المنکر فريضاٌ عظيمة. _ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” কোনো মামুলী ব্যাপার নয়, বরং এ হচ্ছে এক বিরাট ফরয। তাই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” আঞ্জাম দেয়া না হলে অন্যান্য ফরয আমলও আদায় হয় না। সে ক্ষেত্রে সমাজে অন্যান্য ফরয আমলও টিকে থাকে না; দ্বীন ও দ্বীনের আহকাম টিকে থাকে না। “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” না থাকলে অন্যান্য ফরয কাজও পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
এরা হচ্ছে এমন লোক যারা গম বলে যব বিক্রি করে। তারা নিজেদেরকে ‘ইল্ম্ ও ইবাদতের অধিকারী বলে দাবী করে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তারা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর ওপর গুরুত্ব দেয় না, যদি না তাতে তাদের কোনো ক্ষতি হবার আশঙ্কা না থাকে।
হযরত ইমাম বাকের (আঃ) এদের সম্পর্কেই এরশাদ করেছেন যে, শেষ যমানায় এ ধরনের লোকদের উদ্ভব ঘটবে।
অতঃপর উপসংহার। هنالک يتم غضب الله عليکم _ জনগণ যখন এ রকম হবে, তারা যখন এ ধরনের লোকদের অনুসরণ করবে তখন এ ধরনের লোকদের কারণে তোমাদের ওপর আল্লাহ্র আযাব নাযিলের পূর্বশর্ত পূর্ণ হয়ে যাবে। فيعمهم بعقابه _ তখন তার পরিণতি বা শাস্তি সকলের জন্য সর্বজনীন হয়ে যাবে অর্থাৎ তা সকল মানুষকেই গ্রাস করবে। و يهلک الابرار فی دار الفجار _ আর তা পাপীদের গৃহে অর্থাৎ পাপাীদের সমাজে অবস্থানকারী নেককার লোকদেরকেও ধ্বংস করবে। যেহেতু একই সমাজে ভালো লোক ও মন্দ লোক সংমিশ্রিত থাকবে সেহেতু আল্লাহ্ তা’আলার সর্বজনীন শাস্তি সাধারণভাবে সকলের ওপরই নাযিল হবে; ভালো-মন্দ, শুষ্ক-ভিজা সব কিছুকেই দগ্ধীভূত করবে। و صغار فی دار الکبار _ এমনকি বড়দের মধ্যে থাকা শিশুরাও আযাবের শিকার হবে। এ হবে এমন এক বালা যা যখন আসবে তখন তা সর্বজনীন রূপেই আসবে। তখন কাউকে এ থেকে ব্যতিক্রম করা হবে না। যে সমাজ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” পরিত্যাগ করবে তার জন্য এ ধরনের মুছিবত নাযিল হবে।
হযরত ইমাম বাকের (আঃ) বিষয়টির গুরুত্বের কারণে আবারো “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” সম্পর্কে কথা বলেন। ان الامر بالمعروف و نهي عن المنکر سبیل الانبیاء.  _ “নিঃসন্দেহে “আমর বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” হচ্ছে নবী-রাসূলগণের পথ।” অতএব, যারা নবী-রাসূলগণের (আঃ) পথে চলতে চায় তাদেরকে অবশ্যই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথায় তারা অন্য কোনো পথে চলছে; তারা নবী-রাসূলগণের (আঃ) পথে চলছে না। و منهاج الصلحاء তেমনি এ হচ্ছে ছালেহ্ লোকদের পথ _ উত্তম ও যথাযোগ্য লোকদের পথ। فريضة عظيمة بها تقام الفرائض _ “এ হচ্ছে এক বিরাট ফরয যার ওপর সকল ফরয দাঁড়িয়ে আছে।”
তিনি পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, অন্যান্য ফরয আদায় করা এই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” আদায়ের ওপর নির্ভরশীল। و تأمین المذاهب _ দ্বীনের পথ সমূহের নিরাপত্তাও এই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর ছায়াতলে অবস্থিত। و تحل المکاسب _ এর মাধ্যমেই উপার্জন হালাল হয়।
লোকেরা যদি চায় যে, তাদের আয়-উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্য হালাল হোক তাহলে তাদেরকে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথায় ধীরে ধীরে তাদের উপার্জনের মধ্যে রেবা প্রবেশ করবে। কেউ হারাম থেকে নিষেধ না করার কারণে লোকেরা আর হালাল-হারাম বাছবিচার করবে না। ফলে তারা হারাম উপার্জনে জড়িয়ে পড়বে। و ترد المظالم _ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করা হলে তার পরিণামে যুলুম-নির্যাতন বিতাড়িত হবে। কেউ যদি কারো হক নষ্ট করে থাকে তাহলে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর পরিণামে হকদারের কাছে তার হক ফিরে আসবে।
و تأمر الارض _ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর ছায়াতলে ধরণী আবাদ হবে অর্থাৎ বসবাসের উপযোগী হবে। কারণ, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর আওতা এতই ব্যাপক বিস্তৃত যে, এর ফলে পরিবেশ রক্ষা পাবে। মুনাফাপূজারী লোকেরা তাদের শক্তির দাপট দেখাবার জন্য বা অনেক বেশী লাভবান হওয়ার জন্য পরিবেশকে নষ্ট করে। তারা এমন সব বা এমনভাবে কলকারখানা নির্মাণ করে যে, তাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না, পরিবেশ বিনষ্ট করে। তারা কেন এমন করে? তারা অনেক বেশী অর্থ চায়। “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর মাধ্যমে এদেরকে প্রতিরোধ করা হবে। ফলে পরিবেশ ঠিক থাকবে এবং ধরণী বসবাসের উপযোগী থাকবে।
و ينتصف من الاعداء  _ “আর দুশমনদের নিকট থেকে ইনছাফ আদায় করা হবে।” অথাৎ আপনাদের দুশমনেরা আপনাদের সাথে ন্যায় ও ইনছাফ ভিত্তিক আচরণ করতে বাধ্য হবে। জনগণ যখন শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হয় এবং সাধারণ জনগণ যখন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করে তখন দুশমনরা আর যুলুম করার সাহস পায় না। তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, সামাজে প্রকৃত অর্থেই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর প্রচলন থাকতে হবে। কারণ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” কোনো ব্যক্তিগত কাজ নয় এবং এমন নয় যে, একজন আলেম কোথাও এ ব্যাপারে দু’চারটা কথা বললেন আর তাঁর দায়িত্ব পালন শেষ হয়ে গেলো। “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” যদি গোটা সমাজে প্রচলিত থাকে তাহলে আর দুশমনরা মু’মিনদের ওপর হামলা চালাতে সাহস পায় না।
এর চূড়ান্ত সুফল হচ্ছে استقيموا الامور _ সমস্ত বিষয়ই ঠিকঠাক হয়ে যাবে। প্রকৃত পক্ষে এ-ই হলো ‘ইছ্লাহ্’ বা সংশোধন বা সংস্কার। এর ফলে সমস্ত রকমের পাপাচার, অনাচার ও দুর্নীতি অপসারিত হবে এবং সকল কাজ সঠিকভাবে সম্পাদিত হবে। এগুলো হচ্ছে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর সুফল।
হযরত ইমাম বাকের (আঃ) একদিকে এ মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, শেষ যুগে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” নিষ্প্রভ হয়ে যাবে; লোকেরা কখনো কখনো এর আমল করবে, তবে কেবল তাতে ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে। কার্যতঃ সামাজিকভাবে তার প্রচলন উঠে যাবে এবং তার রওনক থাকবে না। সমাজ থেকে তা হারিয়ে যাবে; কোণঠাসা হয়ে যাবে। আল্লাহ্র শুকরিয়া যে, এখনো অবস্থা সে পর্যায়ে পেঁৗছে নি।
হযরত ইমাম (আঃ) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, পরিস্থিতি এরূপ দাঁড়ালে তোমরা আল্লাহ্র আযাবের ভয় করো। কারণ, এমন হলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এমন আযাব নাযিল হবে যার ফলে শুকনা কাঠের সাথে কাঁচা গাছও পুড়ে যাবে; সে আযাব বড় ও ছোট নির্বিশেষে সকলকেই গ্রাস করবে।
হযরত ইমাম সতর্কবাণী উচ্চারণের পর নছিহত করেন যে, তোমরা কী করলে এ রকম হবে না _ এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না। তোমরা যারা আমার অনুসারী তারা আমার নছিহত শোনো এবং জেনে নাও যে, এহেন পরিস্থিতির শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে হলে কী করতে হবে। فانکروا بقلوبکم _ তোমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে এই যে, সমাজে খারাপ কাজ হতে দেখলে অন্তরে তাকে ঘৃণা করো, তার প্রতি অসন্তুষ্ট হও; এতে যেন তোমাদের অন্তর সঙ্কুচিত হয়ে যায়। তোমরা যখন কোনো খারাপ কাজ দেখবে, পাপ কাজ দেখবে তখন যেন এরূপ না হয় যে, শুধু মনে হবে, লোকটি খারাপ কাজ বা পাপ কাজ করেছে, অথচ তোমাদের মনে তার প্রতি ঘৃণার উদ্রক হবে না।
এখন তো সাংস্কৃতিক ভবন সমূহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কিন্তু ছেলেমেয়েরা এর বাইরেও বিভিন্ন ধরনের বিনোদনে লিপ্ত হচ্ছে; এ সবে নিজেদেরকে ব্যস্ত করে তুলছে। তারা নাচ শিখছে, এক বিশেষ ধরনের সঙ্গীতের চর্চা করছে। বলা হয়, ‘ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিল্পকলা থাকবে না এটা কেমন কথা?’ ইত্যাকার কথা বলা হয়।
“আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে এই যে, যখন এ ধরনের আপত্তিকর কর্মকাণ্ড দেখবেন তখন যেন আপনাদের অন্তরে এসব পাপকর্মের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়, আপনাদের মনে যেন কষ্ট লাগে। এসব কিছুতে যদি মনে কষ্ট না লাগে তাহলে তা হচ্ছে নিফাকের সূচনা। অর্থাৎ আপনারা আল্লাহ্র নির্দেশের প্রতি সন্তুষ্ট নন; আপনাদের মন চায় না যে, আল্লাহ্র আহকাম যথাযথভাবে কার্যকর হোক। বরং আল্লাহ্র আহকাম কার্যকর হলে আপনারা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আনন্দিত হবেন না।
যে কোম নগরী হচ্ছে ইসলামী জাহানের কেন্দ্র, ইসলামের উম্মুল কুরা, শহীদের খুন আর অভু্যত্থানের নগরী, সেই কোম নগরীর ঈদগাহের পাশে একজন নারী এসে এক ঘণ্টা যাবত প্রদর্শনী করে; তথাকথিত ছন্দিত প্রদর্শনী! তা-ও কোমের ঈদগাহের পাশে! এটা কোনো পুরুষের শিল্পকৌশল প্রদর্শনী ছিলো না। একক প্রদর্শনী করলো; মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছন্দিত অঙ্গসঞ্চালন, যাতে ছন্দ আছে। অর্থাৎ এ ছিলো নাচ; সে ছিলো নর্তকী, যদিও সহজ ধরনের নাচ দেখায়। আর ঐ লোকেরা সেখানে বসে বসে তা দেখলো। কেউ টু শব্দটিও করলো না। সেখানে এমন লোকও উপস্থিত ছিলো যারা নিজেরা কখনো নাচ দেখতে যায় নি; অন্ততঃ আমরা তাদের সম্পর্কে এমন কথা জানি না। তারা এবার পরিস্থিতির শিকার হয়েই হোক, এবার একটা সুযোগ পেয়ে গেলো।
তেমনি অনেক লোক আছে যে, সিনেমা হলে অশ্লীল ফিল্ম দেখানো হচ্ছে জানা থাকা সত্ত্বেও তা দেখার জন্য টিকেটের লাইনে দাঁড়ায়। এসব ফিল্মে এমন সব দৃশ্য থাকে যা মোটেই বাঞ্ছিত নয়।
এ জাতীয় পরিস্থিতিতে সর্ব প্রথম যা হওয়া উচিৎ তা হচ্ছে انکروا بقلوبکم _ আপনারা অন্তরে এগুলোকে ঘৃণা করুন। এগুলো যেন আপনাদের খারাপ লাগে, এই ভেবে যেন মনে কষ্ট হয় যে, এসব কাজ কেন হচ্ছে? অতঃপর والفقوا بالصمدهم _ এরপর তোমরা তা মুখে প্রকাশ করো; প্রতিবাদ করো।
প্রথমে মুখে আনা বা প্রতিবাদ করা হয়তো কিছুটা নম্রভাবে হতে পারে। স্নেহ-মমতার সাথে নিষেধ করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে এভাবে হওয়াই ভালো। কিন্তু এর পরে و السکوا بها جواههم _ আপনারা যখন গুনাহ্র কাজ হতে দেখবেন এবং নম্র ভাষায় বুঝিয়ে তাদেরকে তা থেকে বিরত রাখতে পারবেন না, যখন “এ অশ্লীল কাজ কেন করছো?” বললে তারা লজ্জিত না হয়, বরং আপনাদের সামনে প্রতিবাদের স্বরে বলে, “এটা আমাদের স্বাধীনতা; আমার ইচ্ছা এটা করবো” , তখন আর নম্রতা ও স্নেহ-মমতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই।
এবার আমি “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর পরবর্তী পর্যায়ের কথা বলতে চাই। আপনারা যখন নম্র ভাষায় বুঝাবার চেষ্টা করলেন, নছিহত করলেন, হাসিমুখে তাদের সাথে কথা বললেন, তাতে যখন কাজ হলো না তখন কঠোরতার আশ্রয় নিতে হবে। السکوا بها جواههم _ তা তাদের চেহারার ওপরে নিক্ষেপ করুন। অবশ্য এর মানে এ নয় যে, হাত দিয়ে মারবেন, বরং কথার দ্বারা। অর্থাৎ তাদের সাথে এমন শক্তভাবে কথা বলুন যেন মনে হয় যে, তাদের চেহারার ওপরে আঘাত করতে যাচ্ছেন। السکوا بها جواههم তাদের মুখের ওপরে শক্ত কথা বলুন; বলুন ঃ “তোমাকে বলছি, কেন গুনাহ্র কাজ করছো? বন্ধ করো এ কাজ।”
হ্যা, নম্র কথায় কাজ না হলে এ ধরনের শক্ত কথা বলতে হবে। কিন্তু এ ধরনের শক্ত কথা বলা সকলের কাজ নয়। এ হচ্ছে বিশষভাবে আমাদের মতো লোকদের কাজ, আমরা যারা এ ধরনের শিথিলতা প্রদর্শনকারী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত। কিন্তু আমাদের মধ্যে আর সেই চেতনা ও মনোবল নেই। আমরা ভয় করছি যে, আমরা যদি এ ধরনের কথা বলি তাহলে সাথে সাথে আমাদেরকে অপবাদ দেবে, বলবে যে, এরা সহিংসতাবাদী; এরা সভ্যতা বিবর্জিত।
তারা অপবাদ দিচ্ছে কি দিচ্ছে না? যতটা জানা যায়, তারা রাশ্তে হামলা করেছে, খোর্রামাবাদে হামলা করেছে, আরো অনেক জায়গায় হামলা করেছে। তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে, জ্বালাতন করবে, মারধোর করবে, বাঁধবে অথবা মারধোর করতে করতে মেরে ফেলবে, ঠিক যেমনটা কমবেশী প্রতিদিনই দেখতে পাচ্ছি। তারা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” সংস্থার লোকদেরকে হত্যা করছে, অথবা হুমকি দিচ্ছে, বা মারধোর করছে, হাত-পা বেঁধে এক জায়গায় নিয়ে ফেলে দিচ্ছে। তাদেরকে টেলিফোনে হুমকি দিচ্ছে ও বিরক্ত করছে।
হ্যা, মানুষের এতে ভয় পাওয়ারই কথা। কেউ যখন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করতে চায় তখন তার ফল হচ্ছে এই। হ্যা, এরা তো প্রশাসনেরই লোক যারা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালনের জন্য বিচার বিভাগ থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত। আর অন্যদের অবস্থা তো বোঝাই যাচ্ছে।
ইমাম (আঃ) বলেন, তোমাদেরকে যা করতে বললাম তা করতে গেলে অনেক লোক তোমাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, অথবা তোমাদেরকে এই বলে তিরস্কার করবে যে, কেন তোমরা লোকদের সাথে রূঢ় আচরণ করছো? রূঢ় ভাষায় কথা বলছো কেন? এমনও হতে পারে যে, তোমাদের বন্ধুরাও তোমাদেরকে তিরস্কার করবে। কিন্তু و لا تخافوا لومة لائم  _ তোমরা যদি চাও যে, এমন দিন না আসুক যখন এমন বালা নাযিল হবে যা শুকনা-ভিজা নির্বিশেষে সব কিছুকে পোড়াবে, তাহলে তিরস্কারকারীদের তিরস্কারকে ভয় করো না, এমনকি তা যদি তোমাদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের পক্ষ থেকে কঠোরতম তিরস্কারও হয়।
হ্যা, এখানে ইমাম বাকের (আঃ)-এর কিট প্রশ্ন করা হতে পারে যে, আপনি তো বললেন, এসব কাজ করো, আমরা এসেছি এবং এ ধরনের লোকদের সাথে প্রথমে বেশ নম্র ভাষায় কথা বলেছি, তাদেরকে নছিহত করেছি, অনুরোধ করেছি, অনুনয়-বিনয় করেছি, এরপর কড়া কথা বলেছি, আর কাউকে ভয়ও পাই নি; আমরা নিজেদেরকে সকল প্রকার বিপদের মুখোমুখি করেছি। কিন্তু এরা এমন লোক যে, কোনো কথাই শুনছে না; মোটেই প্রভাবিত হয় না। এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। এমতাবস্থায় কী করবো?
হ্যা, এটা যদি প্রাথমিক পর্যায়ের ব্যাপার হয়ে থাকে, ঠিক হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর পরের অবস্থা, তখনো লোকদের মধ্যে ঈমানের জোশ ছিলো, বৈপ্লবিক উচ্ছাস ছিলো, তখন যেহেতু শুরুতেই বিপদকে রোখার চেষ্টা করা হতো ফলে তাঁদের জন্য কাজ বেশ সহজ ছিলো। নদীকে ঠেকাতে চাইলে ঝর্ণার উৎসস্থলেই বাঁধ দিতে হবে। এটা কঠিন নয়। কিন্তু এমন পরিস্থিতিরও উদ্ভব হতে পারে যা এ রকম হবে না। হয়তো যিনি “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করবেন এরা তাঁর সামনে রুখে দাঁড়াবে, তাঁকে গালি দেবে, হয়তো মারধোর করবে, হুমকি দেবে।
এ ক্ষেত্রে যা-ই ঘটুক তা দু’টি অবস্থার কোনো একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে; তার বাইরে যাবে না। আপনি যখন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করবেন তখন আপনার মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এবং জনগণের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে দু’টি অবস্থার কোনো একটি হতে পারে। হয় সে আপনার কৃত “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দ্বারা প্রভাবিত হবে এবং মন্দ কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নেবে, অথবা সে ঔদ্ধত্য দেখাবে, জেদ করবে, আপনার সামনে রুখে দাঁড়াবে, এবং ঘটনাক্রমে এমনও হতে পারে যে, যেসব কথা তার বেলায়ই প্রযোজ্য তা-ই আপনার উদ্দেশে ছুঁড়ে দেবে। এর চাইতেও বেশীদূর এগোলে ইসলামের পবিত্র বিষয়াবলী ও ব্যক্তিত্বগণের প্রতিও ধৃষ্টতা দেখাতে পারে।
আমি যে সব ঘটনা জানি তা যদি বলতাম তাহলে আপনাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতো। কিন্তু আল্লাহ্র রহমত যে, কোমে এখনো সে ধরনের কিছু হয় নি, তাই তা বলা থেকে বিরত থাকলাম।
হ্যা, এ দু’টি অবস্থার যে কোনো একটি হতে পারে। হয় “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার দ্বারা প্রভাবিত হবে, মন্দ কাজ থেকে বিরত হবে, সঠিক পথে আসবে। এরূপ হলে খুবই ভালো; এরপর আর তার ব্যাপারে আপনার কিছুই করার নেই; আপনার হুজ্জাত বা দায়িত্ব পালন সমাপ্ত হয়েছে। অতঃপর তাদের সাথে স্নেহ-মমতা সহকারে, আন্তরিকতা সহকারে আচরণ করুন, তাদেরকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করুন। তারা ভুল করেছিলো; তা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। فان تابوا و الی الحق رجعوا فلا سبیل له _ তারা যদি তাওবাহ্ করে, গুনাহ্ থেকে বিরত হয়, সত্যের দিকে ফিরে আসে তাহলে ‘খোশ আমদেদ’ _ খুবই ভালো কথা। কিন্তু যদি এমনটি না হয়, বরং যদি এর বিপরীত ঘটে, তাহলে
انما السبیل علی الذین يظلمون الناس و يبغون فی الارض بغير الحق . اولئک لهم عذاب الیم _ “কেবল তাদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নিতে হবে যারা লোকদের ওপর যুলুম করে এবং ধরণীর বুকে বিদ্রোহাত্মক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” এটা কোরআন মজীদের আয়াত।
তারা যদি আপনাদের নছিহতে কান না দেয় এবং তাদের পাপাচার, তাদের যুলুম-অত্যাচার ও তাদের বক্র আচরণ অব্যাহত রাখার জন্য জেদ করতে থাকে তখন আপনাদের ওপর অপর একটি দায়িত্ব বর্তায়। তখন তাদের মোকাবিলায় আপনাদেরকে অন্য একভাবে আচরণ করতে হবে। এবার আপনাদের দায়িত্ব কথা বলা, তিরস্কার করা ও কঠোর ভাষা প্রয়োগ থেকেও আরো এক ধাপ বেড়ে যাবে।
পরিস্থিতি যখন এ পর্যায়ে উপনীত হবে فجاهدوهم بابدانکم _ তখন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। যেহেতু এরা ইসলামের দুশমন সেহেতু তোমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। فجاهدوهم بابدانکم و ابغضوهم بقلوبکم. _ তোমরা এদের ওপরে তোমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হও, এদেরকে দুশমন গণ্য করো এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। সকলের সাথেই তো আর বন্ধুত্ব করা চলে না। এই যে লোকেরা ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে, প্রকাশ্যেই ইসলামের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, ইসলামের আহ্কামকে অবজ্ঞা করছে, ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলোকে ও পবিত্র ব্যক্তিদেরকে অবমাননা করছে, এদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সংগ্রাম করতে হবে এবং অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এদেরকে দুশমন গণ্য করতে হবে।
আপনারা হয়তো বলবেন যে, ইসলাম তো দয়া-অনুগ্রহের ধর্ম, ভালোবাসার ধর্ম, দয়া দর্রতার ধর্ম। হ্যা, তবে সেই সাথে ইসলাম দুশমনীর ধর্মও বটে। ইসলাম যথাস্থানে দয়া, অনুগ্রহ ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে, তেমনি যথাস্থানে সহিংসতা, কঠোরতা ও দুশমনী প্রদর্শন করে।
ابغضوهم بقلوبکم _ তোমরা এদের ওপরে তোমাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হও, এদেরকে দুশমন গণ্য করো। কিন্তু সাবধান, সতর্ক থাকবেন, আপনারা যখন তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন তখন নিজ নিজ অন্তরের নিয়্যতের দিকে তাকাবেন। কারণ, এ অবস্থায় আপনাদের কাছে শয়তান আসবে।
যে নামায পড়ে না তার কাছে শয়তান এসে বলে না যে, যাও রিয়াকারী করো। যে নামাযই পড়ে না তার আবার রিয়াকারী কিসের? কিন্তু কেউ যখন নামায পড়ে, বিশেষ করে যে ব্যক্তি মসজিদে অন্য লোকদের সামনে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করে তথা ইমামতি করে তখন শয়তান চলে আসে তার কাছে, তাকে ওয়াস্ওয়াসা দেয় যে, “দোয়ালি্লন্”কে একটু বেশী করে টেনে পড়ো যাতে লোকেরা বলে যে, কত সুন্দর করে তেলাওয়াত করেন উনি!
তেমনি একজন আশূরার শোকানুষ্ঠানে এলো না, চলে গেলো কোনো সাংস্কৃতিক ভবনে, কী জানি, হয়তো সিনেমায়, বা থিয়েটারে। তাকে নিয়ে তো শয়তানের কোনো কাজ নেই। সে তো গিয়েছেই, সে নিজেই নিজেকে জাহান্নামের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু যখন কেউ আশূরার শোকানুষ্ঠানে আসে তখন শয়তান এসে তাকে ওয়াস্ওয়াসা দেয়। বলে, তুমি ক্রন্দন করার ভান করো, দেখাও যে, তুমি অন্তরে খুবই কষ্ট পাচ্ছো _ যাতে লোকেরা বলে যে, এ লোকটা ইমাম হোসাইন (আঃ)কে কতই না ভালোবাসে! লোকটা বেলায়াতের ভক্ত।
শয়তান আসে সত্যপন্থীদের কাছে। আপনি যদি “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন না করেন তো শয়তানের আপনাকে নিয়ে কোনো কাজ নেই। কারণ, তাহলে তো আপনি তার বন্ধু এবং সাথী; আপনি নিজেই তখন একজন ছোট শয়তান।
কিন্তু আপনি যখন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করবেন তখন আপনার ও শয়তানের পথ পৃথক হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি হয়তো ভবিষ্যতে কোনো ক্ষমতা বা পদ পাওয়ার জন্য এ কাজ করতে পারেন। কত লোক যে রণাঙ্গনে গিয়ে যুদ্ধ করেছে, আর ফিরে এসে দেখেছে যে, সব পদ অপদার্থ লোকেরা দখল করে বসে আছে, আর তার হাত খালি। এ ধরনের লোক ভাবতে পারে যে, এবার আমাদের পালা; যদি পালা ভিত্তিকও হয়, তো আমাদের পালা। লোকেরা কী হারে চোরাচালানের কাজ করেছে, কত না কামাই করেছে, তা বেশ, এবার আমরা কয়েক দিন চোরাচালানের মাল বেচাবিক্রি করবো যাতে সামান্য অর্থ হাতে আসে। অথচ এরা রণাঙ্গনে গিয়ে যুদ্ধ করেছে। শয়তান এদের কাছে আসে।
আপনারা যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চান তাহলে নিজেদের নিয়্যতকে ঠিক করুন; ক্ষমতা লাভের চিন্তা করবেন না। এ রকম চিন্তা করবেন না যে, এ সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ধনসম্পদ হস্তগত করবেন অথবা জনগণের সামনে আপনাদের মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। নচেৎ বলবো যে, নিজেদের জীবনও দিলেন, কিন্তু ছওয়াবও পেলেন না। কারণ, যেহেতু শয়তানী উদ্দেশ্যে এবং প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে এ কাজ করেছেন তাই ছওয়াব পাবেন না। ইবাদতের মূল্য হয় তখন যখন তা কেবল আল্লাহ্র জন্য হয়।
و ابغضوهم بقلوبکم غير طالبین سلطان و لا باقين مالاٌ و لا مريدين بالظلم ظفرانه _ তোমরা তাদেরকে অন্তর থেকে দুশমন গণ্য করো, তবে তোমাদের অন্তরে যেন ক্ষমতা লাভের লোভ না থাকে, ধনসম্পদ লাভের উদ্দেশ্যও পোষণ করো না, তেমনি অন্যায়ভাবে ও বিদ্রোহাত্মক পন্থায় অন্যদের ওপর বিজয়ী হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও পোষণ করো না। অন্যদের ওপর বিজয় কাম্য বটে, তবে তা হতে হবে যথাযথ পথে, শরীয়ত সম্মত পথে; যে কোনো পন্থায় বিজয়ের অধিকারী হওয়া কাম্য নয়। কিন্তু রাজনীতির খেলায় এ ধরনের কথা নেই। সে ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য দ্বারাই তা হাসিলের পন্থার বৈধাবৈধতা নির্ধারিত হয়। আমাদের দলকে বিজয়ী করতে হবে, তা যা হবার হোক। আমরা নির্বাচনে বিজয়ী হবো, তা যা হবার হোক না কেন।
কিন্তু ইসলাম যখন বলে যে, তোমরা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করো এবং এজন্য প্রয়োজনে নিজেদের জীবনও বিপন্ন করো, তখন কী অবস্থা দাঁড়ায়? তখন যেন শয়তান এসে ওয়াস্ওয়াসা দিতে না পারে যে, আমাদেরকে অবশ্যই বিজয়ী হতে হবে, এমনকি অবৈধ পন্থায় হলেও। বরং আমাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার আহ্কাম পুরোপুরি মেনে চলতে হবে, খোদায়ী সীমারেখাকে সঠিকভাবে মেনে নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আপনারা আপনাদের নিয়্যতকে একনিষ্ঠ করুন, কেবল আল্লাহ্ তা’আলার জন্য “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করুন।
হ্যা, এদের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। তাহলে এরপর কী হবে? এরশাদ হয়েছে যে, মৌখিক নছিহতের ফলে যদি তারা সংশোধন না হয় তাহলে সংগ্রাম ও জিহাদের পালা আসবে। তখন এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে থাকুন حتی يطيعوا الی امر الله যতক্ষণ না তারা আল্লাহ্র আদেশের আনুগত্য করে। তাদেরকে আল্লাহ্র হুকুমের সামনে মাথা নত করে দিতে হবে, বড় শয়তানের নির্দেশের সামনে নয়। বড় শয়তান যে রাজনৈতিক ধারা নির্দেশ করে, যে সব নীতি নির্ধারণ করে দেয়, যতক্ষণ না তারা সে সবকে উপেক্ষা করে আল্লাহ্র আদেশের সামনে মাথা নত করে দেয়। و ينظروا علی طاعته _ আর তাঁর আনুগত্যের ওপর স্থির থাকে। এই ছিলো হযরত ইমাম বাকের (আঃ)-এর নছিহত।
হযরত ইমাম বাকের (আঃ) তাঁর এ নছিহতের শেষের দিকে একটি কাহিনী উল্লেখ করেন। আমরা যাতে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর বিরাট দায়িত্ব ভুলে না যাই এবং অবশ্যই এ দায়িত্ব পালন করি সে উদ্দেশ্যে ইমাম এ কাহিনীটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন ঃ আল্লাহ্ তা’আলা হযরত শোয়াইব (আঃ)কে ওহী করেন, انی لمعذب من قوم مأة الف _ আমি তোমার কওমের এক লক্ষ লোককে আযাব দেবো _ ধ্বংস করে দেবো
اربعين الف من شرارهم _ এদের মধ্যে থাকবে চলি্লশ হাজার পাপাচারী ও গুনাহ্গার, و ستين الف من خيارهم. _ আর ষাট হাজার থাকবে তাদের মধ্যকার ভালো লোক।
হযরত শোয়াইব (আঃ) এতে খুবই বিস্মিত হলেন।
فقال يا رب هؤلاء اشرار _ তিনি বললেন, “হে আমার রব! ওরা তো পাপাচারী।” ওদেরকে ধ্বংস করা হবে _ এটা ঠিক আছে, কারণ, এটাই তাদের فما قال أ الاخيار  _ তারপর তিনি বললেন, কিন্তু ভালো লোকদেরকেও কি ধ্বংস করা হবে? কেন? فأوحی عج و جل الیه داهنوا اهل المعاصي و لم يغضبوا لغضبی _ অতঃপর মহাপ্রতাপময় আল্লাহ্ তা’আলা হযরত শোয়াইব (আঃ)কে ওহী করে বললেন ঃ “কারণ, তারা পাপাচারীদেরকে সমীহ করে ও সন্তুষ্ট রেখে চলেছে এবং আমার অসন্তুষ্টির ভয়ে তাদের সাথে শত্রুতা করে নি।”
এখানে মূল বক্তব্যে داهنوا ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে, যার মানে তারা “মুদাহানা” (مداهنه) করেছে। “মুদাহানা” মানে কী জানেন? “মুদাহানা” মানে হলো তোয়াজ করা, আপোস করে চলা, অন্যায়-অপরাধকে দেখেও না দেখার ভান করা। داهنوا ক্রিয়াপদের মূল হচ্ছে دهن অর্থাৎ তেল বা গ্রিজ লাগানো। কেউ যখন কোনো যন্ত্রকে চালু করতে চায় তখন তার বিভিন্ন পার্টস্-এর মধ্যে যাতে ঘর্ষণ না ঘটে সে উদ্দেশ্যে কী করে? তাকে পিচ্ছিল করা জন্য তেল বা গ্রিজ ব্যবহার করে। তেমনি লোকেরা যখন চায় যে, অন্যদের সাথে সংঘাতের সৃষ্টি না হোক তখন তারা কী করে? তারা হাসিমুখে কথা বলে ও হাসিমুখের কথা শোনে; অপর পক্ষ পাপে লিপ্ত কিনা তাতে তার কী আসে যায়? একেই বলা হয় “মুদাহানা”।
হযরত শোয়াইব (আঃ)-এর কওমের ষাট হাজার ভালো লোক যে আযাবের শিকার হলো তাদের অপরাধ এই যে, তারা পাপাচারীদের সাথে নম্র আচরণ করতো ও আপোস করে চলতো। তারা পাপাচারীদের সামনে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করে নি। و لم يغضبوا لغضبی _ তারা আমার অসন্তুষ্টি বা গযবের ভয়ে পাপাচারীদের সাথে শত্রুতা করে নি, তাই তাদের জন্যও আমার গযব অবধারিত হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকদের সাথে শত্রুতা করাও ফরয হয়ে যায়। কারণ, ঐ সব ক্ষেত্রে শত্রুতা না করলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ঐ ভালো লোকদেরকেও শাস্তি দেয়া হয়।
যারা বলে ইসলাম শুধু দয়া-অনুগ্রহ ও ভালোবাসার ধর্ম তারা অদ্ভূত এক ইসলামের কথা বলে। অথচ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, যেহেতু আমার জন্য তারা পাপাচারীদের সাথে শত্রুতা করে নি সেহেতু ষাট হাজার ভালো লোককে শাস্তি দেবো। এ থেকে সুস্পষ্ট যে, কতক ব্যাপারে আমাদেরকে আক্রোশ ও শত্রুতা পোষণ করতে হবে। সব সময় ও সকল ক্ষেত্রে কেবল নম্রতা ও হাসিমুখ নিয়ে যিন্দেগী যাপন করা যায় না। আল্লাহ্ তা’আলাও আমাদের কাছে এমনটি চান নি। سکوا بها جباههم _ অর্থাৎ তাদের সাথে রূঢ় ভাষায় কথা বলো।
এ মর্মে কতক প্রশ্ন এসেছিলো যে, আপনি মিম্বারে বসে বা অন্যান্য জায়গায় বক্তৃতা করার সময় অনেক সময় রেগে যান কেন? আপনারা কি এ প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন? আমি এর আলাদা কোনো জবাব দেবো না। হযরত ইমাম বাকের (আঃ) আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
আপনাদের অনুমতিক্রমে আমি আর দু’তিনটি ছোট রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করবো এবং আজকের আলোচনার সমাপ্তি টানবো।
হযরত ইমাম জাফর ছাদেক (আঃ) তাঁর পূর্বপুরুষ আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এরশাদ করেছেন ঃ اذن الانکار ان تلقي اهل المعاصي بوجوه المکفئرة _ “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” বা মন্দ কাজ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তোমার পক্ষে যদি আর কিছুই করা সম্ভব না হয় তাহলে অন্ততঃ পাপাচারীর সামনে মুখ গোমড়া করে থেকো। পাপাচারীদের মোকাবিলায় এ নূ্যনতম দায়িত্ব পালন থেকে কেউই রেহাই পাবে না, যদি না দয়াদর্্র আচরণ কৌশল হয়ে থাকে। অর্থাৎ আপনার যদি জানা থাকে যে, সে ভুল করেছে এবং আপনি যদি তাকে এ থেকে ফিরাতে চান; আপনি তাকে উপদেশ দিতে চান এবং তার ফলে তার সংশোধনের আশা আছে। এ উদ্দেশ্যে আপনি তাকে মেহমানদারীও করতে পারেন, তার সাথে নম্র আচরণ করতে পারেন এবং তাকে টাকাপয়সাও দিতে পারেন। এটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। এটা মানুষকে হেদায়াত করার একটি কৌশল।
কিন্তু যে সব পাপাচারী লোক পাপাচারের ক্ষেত্রে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করে, বলে ঃ “তোমার কী?” বলে ঃ “এটা আমার স্বাধীনতা।” বলে ঃ “আমার মন যা চায় তা-ই করবো।” এ ধরনের ধৃষ্ট লোকদের সাথে মুখে বিরক্তি ও অসন্তুষ্টি ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং কড়া ভাষায় কথা বলতে হবে, অবশ্য যদি তা করার মতো শক্তি থাকে, যদি পরদিন আপনাকে পাকড়াও না করে যে, কেন একজন নাগরিকের সাথে অশোভন ও অবমাননাকর আচরণ করেছো?
এ রেওয়াইয়াতটি শেখ তূসীর “তাহ্যীব্” গ্রন্থ থেকে নিয়েছি। এবার “কাফী” গ্রন্থ থেকে একটি ছোট রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করবো। হযরত ইমাম জাফর ছাদেক (আঃ) এরশাদ করেন ঃ
ان الله عج و جل بعث ملکين الی المدينة  ليقلباها _ মহামহিম ও মহাপ্রতাপময় আল্লাহ্ তা’আলা একটি শহরকে তার অধিবাসীদের সহ উল্টে দেয়ার জন্য দু’জন ফেরেশতা পাঠান।
ক্ষেত্র বিশেষে আল্লাহ্ তা’আলার আযাব এ ধরনের হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতা পাঠিয়ে কওমে লূতকে সহ তাদের বাসস্থানকে উল্টে দিয়েছিলেন।
এরা ছিলো একটি ধৃষ্ট জনগোষ্ঠী যারা অনবরত পাপাচার করে চলেছিলো এবং কিছুতেই তাওবাহ্ করার ও পাপাচার পরিত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। তাই আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকে সহ তাদের শহরকে উল্টে দেয়ার জন্য ফেরেশতা পাঠান। উক্ত দু’জন ফেরেশতা যখন শহরটিকে উল্টে দেয়ার জন্য এলো তখন তারা দেখতে পেলো যে, সেখানে এমন এক ব্যক্তি রয়েছেন যিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় রত; সব সময় দো’আ-মুনাজাত ও ইবাদত-বন্দেগী করছেন এবং আল্লাহ্র নিকট কান্নাকাটি করছেন। দু’জন ফেরেশতার মধ্য থেকে একজন বললো ঃ “আমি এই আবেদ ব্যক্তিকে শস্তি দিতে এবং তাকে সহ শহরটিকে উল্টে দিতে সাহস পাচ্ছি না। তাই এসো, এ বিষয়ে আল্লাহ্র কাছে জিজ্ঞেস করি।” অপর ফেরেশতা বললো ঃ “তুমি তোমার কাজ করো।” প্রথম ফেরেশতা বললো ঃ “আমি ভয় পাচ্ছি। আল্লাহ্র কাছে বলবো যে, এখানে এই আবেদ ব্যক্তি রয়েছেন।” শেষ পর্যন্ত সে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো ঃ “হে আল্লাহ্! আমরা তো আমাদের দায়িত্ব পালনের জন্য এখানে এসেছি। কিন্তু এখানে দেখতে পাচ্ছি এক ব্যক্তি ইবাদত করছে।”
আমাদের ধারণা অনুযায়ী, হয়তো ঐ ফেরেশতার মাথায় এ ধারণা তৈরী হয়ে থাকবে যে, হয়তো হুকুম জারী করার সময় পর্যন্ত সে তাওবাহ্ করে নি; পরে তাওবাহ্ করেছে। হয়তো এ ব্যক্তির তাওবাহ্ করার ফলে আমাদের করণীয় বদলে গিয়ে থাকবে।
উক্ত ফেরেশতা আল্লাহ্র কাছে প্রশ্ন করলো ঃ “এখানে এই ব্যক্তি ইবাদত-বন্দেগী ও দো’আ-মুনাজাতে মশগুল, এমতাবস্থায় আমরা কি আমাদের প্রতি প্রদত্ত হুকুম পালন করবো, নাকি হুকুম পরিবর্তিত হয়ে গেছে?” আল্লাহ্ তা’আলা বললেন ঃ “তোমাদের দায়িত্ব অপরিবর্তিতই রয়েছে। যাও, শহরটিকে ধ্বংস করে দাও।” এরপর স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলা এ ধরনের ইবাদতকারীদেরকে আযাবের অন্তর্ভুক্ত করার কারণ ব্যাখ্যা করেন ঃ فان الذا رجل لم يتغير وجهه غيظ قط _ হ্যা, সে ইবাদতকারী ও মুনাজাতকারী বটে, কিন্তু কখনোই আল্লাহ্র জন্য রাগে ও ক্রোধে তার চেহারার রং পরিবর্তিত হয় নি। অর্থাৎ সে দেখেছে যে, লোকেরা পাপাচারে লিপ্ত, কিন্তু তা সত্ত্বেও পাপ ও পাপাচারীদের প্রতি রাগে ও ক্রোধে কখনো তার চেহারার রং বদলায় নি। কারণ, এসব দেখে সে তার মনে কষ্ট পায় নি। যেহেতু আল্লাহ্র জন্য তার অবস্থায় কোনো পরিবর্তন ঘটে নি, সে পাপাচারের প্রতি অসন্তুষ্টি পোষণ করে নি ও ক্রুদ্ধ হয় নি সেহেতু তাকে ঐ পাপাচারীদেরই অন্তর্ভুক্ত গণ্য করতে হবে।
হে পরোয়ারদেগার! সাইয়েদুশ শুহাদা (আঃ)-এর মর্যাদার উছিলায় তোমার কাছে আবেদন করছি,
ইসলাম ও মুসলমানদের ইজ্জত ও মর্যাদা দিনের পর দিন বৃদ্ধি করে দাও।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর ছায়াতলে আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে পরিচিত করে দাও।
দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে সফল করে দাও।
হযরত ইমাম খোমেইনীর ও শহীদগণের রূহকে কারবালার শহীদগণের সাথে হাশর করো।
আমাদের ওপরে মহান রাহ্বারের ছায়া স্থায়ী করে দাও।
আমাদের শেষ পরিণামকে শুভ পরিণামে পরিণত করে দাও।

Leave A Reply

Your email address will not be published.