পবিত্র আশুরা ও মহররম-১

0 361

  আশুরা উপলক্ষ্যে ওস্তাদ আয়াতু্ল্লাহ মিসবাহ তাকী ইয়াযদীর প্রথমদিনের বক্তব্য

  আপনার ওপর সালাম, হে আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইন। আর সালাম সেই সব রূহের প্রতি যারা আপনার ফানা হওয়ার কারণে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন।
শহীদানের নেতা হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইনের (আঃ) শোকাবহ ম্মৃতিময় দিনগুলোর আগমনে হযরত ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন), মহান রাহ্বার, মহান মার্জা’এ তাক্বলীদগণ ও হোসাইনী আদর্শের একনিষ্ঠ প্রেমিক আপনাদের সকলের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আশা করি মহান আল্লাহ্ তা’আলা এ দুনিয়ায় ও পরকালে হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইনের সাথে আমাদের সম্পর্ককে কখনো দুর্বল হতে দেবেন না।
আশূরার আদর্শ ও হোসাইনী আদর্শ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে গভীর করার এবং স্বাভাবিকভাবেই বিশেষ করে তরুণদের মনে হযরত আবা আব্দিল্লাহ আল্-হোসাইন (আঃ)-এর অভু্যত্থান সম্পর্কে যে সব প্রশ্নের উদয় হয় সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনার জন্য এ দিনগুলো হচ্ছে উত্তম সুযোগ। এর ফলে শহীদগণের নেতা হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইন (আঃ) সম্বন্ধে আমাদের সকলের, বিশেষ করে আমাদের প্রিয় তরুণদের জ্ঞান বৃদ্ধি পাবে। তাহলে আমরা আমাদের অধিকতর জ্ঞানের আলোকে এ থেকে আমাদের এ পার্থিব জীবনের জন্য এবং পরকালীন জীবনের জন্যও অধিকতর কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হবো।

আমরা নিজেরাও ধরে নিচ্ছি যে, সমাজে যে তরুণ সবেমাত্র চৈন্তিক বিকাশের অধিকারী হয়েছে এবং তার চারদিককার সকল সামাজিক বিষয়াদিকে বুঝতে চায় ও তার কারণ সমূহ অনুধাবন করতে চায়, এ থেকে তারা সে সব মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবে।
তরুণরা আশূরার দিনগুলোতে দেখতে পায়, কালো পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি একের পর এক বৈঠক করছেন এবং লোকেরা কালো পোশাক পরিধান করছে, কালো পতাকা বহন করছে, বিভিন্ন দল বুক চাপড়াচ্ছে ও শিকলগুচ্ছ দ্বারা নিজেদেরকে আঘাত করছে, আর লোকেরা অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। আর তারা এমন এমন কাজ লক্ষ্য করছে অন্যান্য দিনে বা অন্যান্য সভা-সমাবেশে যা দেখা যায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে এ প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে, এ অনুষ্ঠান কেন করা হচ্ছে? কেন একজন লোক কালো পোশাক পরিধান করবে? লোকেরা মধ্যরাত পর্যন্ত নিজ নিজ মাথায় ও বুকে আঘাত করবে কেন? কেন তারা এভাবে অশ্রু বিসর্জন দেবে?
হ্যা, এর একটি সহজ জবাব দেওয়া হয়। বলা হয়, যেহেতু সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) শহীদ হয়েছেন সেহেতু তাঁর স্মরণে আমাদেরকে অশ্রু বিসর্জন দিতে হবে। এতে সওয়াব আছে। কিয়ামতের দিন তিনি আমাদের জন্য শাফা’আত্ করবেন। মোটামুটি এ ধরনের জবাবই শোনা যায়। কিন্তু যেহেতু এক সময় আমরা নিজেরাও যৌবন ও কৈশোর বয়স অতিক্রম করে এসেছি, সেহেতু আমি যদি যথেষ্ট খোলামেলাভাবে বলতে চাই, তাহলে বলবো যে, ‘কেন এত অশ্রুপাত করতে হবে?’ এবং ‘কেন এভাবে মাথায় ও বুকে আঘাত করতে হবে?’ ইত্যাদি প্রশ্নের জন্য ঐ সব জবাব যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়।
এ ব্যাপারে যে সব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় সেগুলোকে আমরা সংক্ষেপে চারটি প্রশ্নে পরিণত করে পর্যালোচনা করতে পারি। আমরা এখানে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেবো যাতে আমরা আশূরার অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে আমাদের প্রিয় যুবক ও তরুণদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধতর করতে পারি এবং আশূরার সংস্কৃতিকে আরো বেশী উজ্জ্বল করে তুলে ধরতে পারি।
এ চারটি প্রশ্ন সেই একটি সাধারণ প্রশ্নের ভিতর থেকেই বেরিয়ে আসে যে, কেন এ অনুষ্ঠান এভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে? কিন্তু আমরা যখন তা নিয়ে আলোচনা করবো তখন, আমার মনে হয়, তা থেকে চারটি প্রশ্ন বের করা যাবে।
এ ব্যাপারে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে ঃ দীর্ঘ তেরশ’ বছর আগে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে কেন আমরা সে ঘটনাকে স্মরণ করবো এবং ঐ দিনের স্মরণে অনুষ্ঠান করবো? এ ছিলো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, তা সে ঘটনা তিক্তই হোক বা সুমধুরই হোক, তার প্রভাব-প্রতিক্রিয়া তো শেষ হয়ে গেছে। তাহলে তের শতাব্দীরও বেশী কাল পরে কেন আমরা সে ঘটনা স্মরণ করবো, কেন সে ঘটনাকে জীবন্ত করে রাখবো এবং তাঁদের জন্য অনুষ্ঠান করবো?
এসব প্রশ্নের জবাব দেয়া খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। কারণ আমরা অত্যন্ত সহজেই যে কোনো যুবক ও তরুণকে বুঝাতে পারি যে, অতীতের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সমাজের ভাগ্যের ওপর ও সমাজের ভবিষ্যতের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কোনো ঘটনার স্মৃতিচারণ মূলতঃ সে ঘটনারই পুনঃরূপদান তুল্য। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, লোকেরা যেন সে ঘটনা থেকে উপকৃত হতে পারে। আমরা যদি কোনো কল্যাণকর ঘটনা দেখতে পাই এবং সে ঘটনা যদি স্বীয় অবস্থানে শুভ প্রভাব ও কল্যাণের উৎস হয়ে থাকে তাহলে সে ঘটনার পুনঃরূপদানেও কমবেশী সে কল্যাণ নিহিত থাকে।
সকল মানব সমাজেই প্রচলিত আছে যে, তারা কোনো না কোনোভাবে তাদের অতীত ঘটনাবলীকে স্মরণ করে এবং সে সব ঘটনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এসব ঘটনা এমন সব ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত যারা তাঁদের সমাজের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। এসব ঘটনা জ্ঞানী-গুণী, মনীষী ও আবিষ্কর্তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট অথবা সং্িলষ্ট সমাজের রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাবলীর সাথে সংশ্লিষ্ট। এসব ঘটনা এমন লোকদের সাথে সংশ্লিষ্ট যারা একটি জাতির মুক্তির জন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা একেক জন জাতীয় বীরনায়ক ছিলেন অথবা অন্য কোনো না কোনোভাবে তাঁরা স্বীয় সমাজের ওপর কল্যাণকর প্রভাব রেখে যান।
বিশ্বের বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন সকল ব্যক্তিই এ ধরনের ব্যক্তিত্ববর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন। আর এটা যে একটি সত্যের কদর করার অনুভূতি শুধু তা-ই নয়, বরং এ হচ্ছে একটি অত্যন্ত পবিত্র অনুভূতি। এ হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে মানুষের মধ্যে নিহিত রাখা পবিত্রতম আশা-আকাঙ্ক্ষা সমূহের অন্যতম। এ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যাকে আমরা সত্যের স্বীকৃতির অনুভূতি, সত্য প্রতিষ্ঠার অনুভূতি ও সত্যের কদর করার অনুভূতি হিসেবে অভিহিত করতে পারি।
অবশ্য এটা সকল মানুষেরই ফিৎরাতী বা সহজাত আকাঙ্ক্ষা যে, যারা তাদের খেদমত করেছেন তারা তাঁদের খেদমতের কথা স্বীকার করে, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তাঁদের কথা স্মরণ রাখে এবং তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে। তবে এর চেয়েও বড় ব্যাপার আছে। তা হচ্ছে, সেই সব স্মৃতির স্মরণ যদি সমাজের সৌভাগ্যের ওপর প্রভাবের অধিকারী হয় তাহলে তা ঐ যুগে পুনরায় একটি প্রভাবশালী উপাদান সৃষ্টিতে সক্ষম হতে পারে। এ থেকে মনে হয় যেন সেই ঘটনাটি নতুন করে সংঘটিত হচ্ছে।
বেশ তো, আমরা যখন বিশ্বাস করি যে, আশূরার ঘটনা ছিলো ইসলামের ইতিহাসের এক বিরাট ঘটনা এবং তা মুসলমানদের সৌভাগ্যের ও জনগণের হেদায়াতের পথকে সমুজ্জ্বল করার ব্যাপারে একটা ভাগ্যনির্ধারক বা দিকনির্দেশক ভূমিকা পালন করেছিলো, তখন এ ঘটনা আমাদের জন্য খুবই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ ঘটনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন, এ ঘটনার পুনঃরূপদান আর তা স্মরণ করার ফলাফল দাঁড়ায় এই যে, আমরা সে ঘটনার কল্যাণকে আমাদের সমাজেও কাজে লাগাতে সক্ষম হবো।
আমরা সাধারণভাবে আমাদের যুবক ও তরুণদেরকে এ জবাব দিতে পারি এবং এর ফলে তারা এটা বুঝতে পারবে যে, কতক স্মৃতিকে জীবন্ত রাখা এবং অতীতে ঘটে যাওয়া কতক ঘটনার পুনঃরূপদান হচ্ছে এমন ধরনের বিচারবুদ্ধির রায় ভিত্তিক কাজ যাতে সমাজের স্বার্থ ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং তা সমাজের কল্যাণের প্রয়োজনকে পূরণ করতে পারে। সেই মূল ঘটনাটি যেভাবে সেই সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছিলো, সে ঘটনার স্মৃতিচারণ ও পুনঃরূপদানও ঠিক সেভাবেই স্বীয় যথাযথ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সেই প্রথম প্রশ্ন যে, কেন আমরা আশূরাকে জীবন্ত করে রাখবো? _ এটাই হচ্ছে তার জবাব।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, আশূরার স্মৃতিকে জীবন্ত রাখা কি কেবল এতেই নিহিত যে, লোকেরা বুকে করাঘাত হানবে, ক্রন্দন করবে, বিলাপ করবে, শহরকে কালো দ্বারা আবৃত করে ফেলবে, লোকেরা মধ্যরাত পর্যন্ত তাদের যিন্দেগীর প্রয়োজনীয় কাজকর্ম বন্ধ রাখবে এবং অনেক ক্ষেত্রে দিনের বেলা বাজার বন্ধ রাখবে? কিন্তু এ সবের তো এক ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি রয়েছে। বেশ তো, এ স্মৃতিকে তো এমন একভাবেও নবায়ন করা যেতে পারে যার ফলে এ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি অপেক্ষাকৃত কম হবে।
আমি এ সব অভিযোগের বাখ্যা এভাবে করতে চাই যে, যেহেতু, আমরা ধরে নিচ্ছি যে, অধিকাংশ মানুষেরই চিন্তা-চেতনা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক ও বস্তুগত বিষয়াদির প্রতি মনোযোগী, সেহেতু তারা ঘটনাবলীকে তাদের বস্তুগত ও অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির আলোকে বিচার করে থাকে।
আমরা মনে করতে পারি যে, যে তরুণ পরিপূর্ণ দ্বীনী শিক্ষা লাভ করে নি তার মাথায় হয়তো এ প্রশ্ন জাগতে পারে যে, এ ধরনের কাজ অর্থনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনে, এর ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়, লোকদের সময় নষ্ট করা হয়; লোকেরা যখন মধ্যরাত পর্যন্ত এভাবে বুক চাপড়ায়, শিকলগুচ্ছ দ্বারা নিজেদেরকে আঘাত করে, তখন পরদিন আর তাদের কাজকর্ম করার মতো অবস্থা থাকে না। লোকেরা এ ঘটনাকে জীবন্ত করে রাখার উদ্দেশ্যে দুই মাস যাবত কাজকর্মের ব্যাপারে ঢিলেঢালা ও গাছাড়া অবস্থায় থাকবে _ এর পরিবর্তে বিকল্প পন্থাও তো অবলম্বন করা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ, লোকেরা আলোচনা সভার আয়োজন করবে, সেমিনারের আয়োজন করবে, বক্তৃতা হবে। অবশ্য বক্তৃতা তো হচ্ছেই। কিন্তু প্রশ্নকর্তার মন-মগযে যা আসে তা হচ্ছে, টেলিভিশনে আলোচনা অনুষ্ঠান হবে ও রাতের বেলা সকলে বসে তা দেখবে এবং এর ফলে এ ঘটনা তাদের মস্তিষ্কে পুনর্জাগরিত হবে। এমতাবস্থায় এই দীর্ঘ দুই মাস যাবত এতসব শোকানুষ্ঠান, ক্রন্দন ও বিলাপ, মাথায় ও বুকে করাঘাত করা _ এ সবের কী প্রয়োজন? তারা বলে, একটি বৈঠক যদি যথেষ্ট না হয় তাহলে কনফারেন্স ধরনের দুইটি বৈঠক, এমনকি দশটি বৈঠকেরও আয়োজন করা যেতে পারে। একটি স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র পথ কি এই যে, লোকেরা বুক চাপড়াবে আর এত সব লোক নিজেদেরকে কষ্ট দেবে?
এ হচ্ছে দ্বিতীয় প্রশ্ন। আমরা যখন মেনে নিয়েছি যে, আশূরার ও হযরত ইমাম হোসাইন বিন্ আলী (আঃ)-এর স্মরণকে জীবন্ত করে রাখা আমাদের জন্য কল্যাণকর এবং সমাজের জন্য তাতে বাঞ্ছিত সুফল রয়েছে, তার পরে দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, তা এভাবে করতে হবে কেন? সারা দুনিয়ায় প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে এই যে, তারা যখন তাদের মহান ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে চায় তখন তারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং তাতে তারা আলোচনা করে এবং আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা প্রদান করে। তাহলে এখানে কেন এভাবে করা হয়?
এ প্রশ্নের জবাব প্রথম প্রশ্নের জবাবের চেয়ে কিছুটা জটিল। এর জবাব হচ্ছে এই যে, হযরত সাইয়েদুশ শুহাদার ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে বৈঠকী আলোচনা, কনফারেন্স, বক্তৃতা, প্রবন্ধ রচনা ও এ ধরনের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-গবেষণা মূলক কাজ অবশ্যই কল্যাণকর এবং এ সব কাজ করার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। অবশ্য এ সব কাজও হচ্ছে। সাইয়েদুশ শুহাদার নামের বরকতে এবং তাঁর স্মরণে আয়োজিত শোকানুষ্ঠানের বদৌলতে আমাদের সমাজেও অনেক কাজই হয়েছে এবং এ সবের আলোকচ্ছটায় অনেক গবেষণা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এভাবে লোকেরা অনেক কিছুই শিখতে পারছে। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আশূরার ঘটনা থেকে আমাদের সঠিক শিক্ষা লাভ ও তা কাজে লাগানোর জন্য কেবল এগুলোই কি যথেষ্ট? নাকি আরো কোনো কিছুর দরকার আছে? আমাদের মতে, এ শোকানুষ্ঠান সমূহেরও প্রয়োজন রয়েছে।
এ প্রশ্নের জবাব দান একটি বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তা হচ্ছে, আমাদেরকে এ ব্যাপারে লোকদের প্রতি মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টিপাত করতে হবে এবং দেখতে হবে যে, আমাদের সচেতন আচরণের ক্ষেত্রে যে সব উপাদান প্রভাব বিস্তার করে তা কি শুধু জ্ঞান, নাকি আমাদের সামাজিক আচরণে নির্ধারণে অন্যান্য উপাদানও কার্যকর রয়েছে? আমরা যখন আমাদের নিজেদের কাজকর্মের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করি তখন দেখতে পাই, _ অবশ্য যারা মনোবিজ্ঞানের সাথে অধিকতর পরিচিত তাঁরা এ বিষয়টি অনেক বেশী ভালোভাবে জানেন যে, মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে কম পক্ষে দুই ধরনের উপাদান মৌলিক ভূমিকা পালন করে থাকে। এর মধ্যে এক ধরনের উপাদান হচ্ছে জ্ঞান _ মানুষ যা বুঝতে পারে ও গ্রহণ করে এবং তাদের বিচারবুদ্ধি যাতে পরিতৃপ্ত হয়; তারা তাদের মন-মগয দ্বারা একটি বিষয়কে গ্রহণ করে _ তা সেটি যে ধরনের বিষয়ই হোক না কেন, তারা তাদের নিজেদের অবস্থা অনুযায়ী তার অনুকূলে বিচারবুদ্ধি দ্বারা যুক্তি প্রদর্শন করে, অথবা তারা কোনো অভিজ্ঞতা থেকে এ জ্ঞানের অধিকারী হয়, অথবা জ্ঞানার্জনের আরো যে সব পন্থা রয়েছে সে সব পন্থার সাহায্য নিয়ে জ্ঞানের অধিকারী হয়।
নিঃসন্দেহে আমাদের জ্ঞান আমাদের আচরণের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু এটা একমাত্র প্রভাবশালী উপাদান নয়। এমন আরো অনেক উপাান রয়েছে আমাদের আচরণের ওপর যেগুলোর প্রভাব হয়তো জ্ঞানের চেয়েও বেশী। এসব উপাদানকে সামগ্রিকভাবে উদ্দীপক নামকরণ করা হয়েছে। অন্য কথায়, মানুষের আবেগ-অনুভূতি সমূহ, স্নেহমমতা, ঝোঁকপ্রবণতা, আগ্রহ-উদ্দীপনা, সহজাত কামনা-বাসনা ইত্যাদি হচ্ছে এমন কতগুলো অভ্যন্তরীণ ও মনস্তাত্তি্বক উপাদান যা আমাদের আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
আপনি আপনার যে কোনো ব্যক্তিগত আচরণকে, আপনার জীবনের ছোট্ট আচরণকে, বা আপনার পারিবারিক আচরণকে অথবা আপনার সামাজিক আচরণ বা রাজনৈতিক আচরণকে যখন পর্যালোচনা করবেন তখন আপনি দেখতে পাবেন যে, যে সব প্রধান উপাদান আপনাকে এ কাজটি সম্পাদনে বাধ্য করেছে তা হচ্ছে এই উদ্দীপক উপাদান সমূহ।
এ ব্যাপারে মরহূম শহীদ অধ্যাপক মোতাহ্হারী যে উপমা দিয়েছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনিও হয়তো এটি কারো কাছ থেকে উদ্ধৃত করে থাকবেন। আমি সর্বপ্রথম তাঁর মুখ থেকে শুনেছি; তিনি উপমা দিচ্ছিলেন যে, মানুষের আচরণের পিছনে দু’টি উপাদান কার্যকর থাকে ঠিক যেভাবে একটি গাড়ী চালাতে চাইলে তার জন্যে দু’টি উপাদান অপরিহার্য; একটি হচ্ছে তার মধ্যে যান্ত্রিক শক্তি তৈরী হতে হবে, তা সে শক্তি পেট্রোল থেকে তৈরী হোক বা অন্য কিছু থেকে; তার মধ্যে এ যান্ত্রিক শক্তি তৈরী হতে হবে, কেবল তাহলেই গাড়ীটিকে চালানো সম্ভব হবে। এ শক্তি ছাড়াও গাড়ীটিতে বাতিও থাকতে হবে _ যাতে ঠিকভাবে পথ দেখা যেতে পারে ও গাড়ীটি খাদে পড়ে না যায়। কোনো অন্ধকার পরিবেশে গাড়ীটির ইঞ্জিন যদি খুব ভালো কাজ করে এবং তাতে শক্তিও উৎপাদিত হয়, কিন্তু পথ যদি দেখা না যায় তাহলে সে গাড়ীটি চালাতে গিয়ে আমরা হয়তো অত্যন্ত ভয়াবহ বিপদে পতিত হবো। হয়তো এমন দুর্ঘটনা সংঘটিত হবে যার ফলে চালক ও যাত্রী নির্বিশেষে সকলের প্রাণহানি ঘটবে। অতএব, আমাদেরকে অবশ্যই পথ দেখতে পেতে হবে। আমাদেরকে পথ চিনতে হবে এবং জানতে হবে যে, আমাদেরকে কোন্ পথ দিয়ে কীভাবে যেতে হবে। কিন্তু গাড়ী চলার জন্য কেবল পথ আলোকিত হওয়াই যথেষ্ট নয়। গাড়ীতে সেই জ্বালানিও থাকতে হবে যা গাড়ীটিকে চালিয়ে নেয়ার জন্য যান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত হবে।
মানুষের সত্তার জন্যও দুই ধরনের উপাদান অপরিহার্য। আমাদের অভ্যন্তরে এমন একটি উপাদান থাকতে হবে যা আমাদেরকে কোনো একটি কাজ আঞ্জাম দেয়ার প্রতি আগ্রহী হতে উদ্বুদ্ধ করবে। এর ফলে আমরা কাজটি সম্পাদন করতে পসন্দ করবো, সে জন্য আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস অনুভব করবো। আর এ কাজ সম্পাদনে আগ্রহী হওয়ার জন্যে আমাদেরকে জানতে হবে যে, কেন এ কাজটি করবো, এ কাজ সম্পাদনে লাভ কী? তেমনি এ-ও জানতে হবে যে, কাজটি কীভাবে আঞ্জাম দিতে হবে? এগুলো হচ্ছে জ্ঞান সংশ্লিষ্ট উপাদান।
এসব জ্ঞান হয় পড়াশুনা করে অর্জন করতে হবে, নয়তো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে; যুক্তিতর্ক প্রয়োগের মাধ্যমে শিখতে হবে বা যে কাজ আঞ্জাম দিতে চাই সে কাজ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির কাছ থেকে শিখতে হবে। কিন্তু আমাদের দ্বারা কোনো কাজ সম্পাদন করানোর জন্য কেবল জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। কাজটি সম্পাদনে আমাদেরকে উদ্যোগী করে তোলার জন্য, কাজটির দিকে আমাদেরকে এগিয়ে দেয়ার জন্য আরো কতগুলো মনস্তাত্তি্বক উপকরণেরও প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের উপাদান সমূহকে মনস্তাত্তি্বক উদ্দীপক বলা হয়; প্রেরণাও বলা হয়। একে আবেগানুভূতিও বলা হয়।
বিষয়টিকে অন্যভাবে বললে বলতে হয় যে, এমন কিছু জিনিস আছে যা মানুষের মধ্যে গতিশীলতার আগ্রহ সৃষ্টি করে, তার মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা সৃষ্টি করে, উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে, ভাবাবেগ সৃষ্টি করে। এসব না থাকলে মানুষের দ্বারা কোনো কাজই সম্পাদিত হয় না। হাজার জন তাকে বলুক যে, অমুক খাদ্যোপাদান গ্রহণ শরীরের জন্য উপকারী, কিন্তু যতক্ষণ না তার ক্ষুধা লাগে, যতক্ষণ না তার মধ্যে খাবার আগ্রহ সৃষ্টি হয়, ততক্ষণ সে ব্যক্তি খাদ্য গ্রহণের জন্য যায় না। উদাহরণ স্বরূপ ধরে নেয়া যাক যে, কারো ক্ষুধা মরে গেছে, সে ক্ষুধামন্দা রোগে ভুগছে, বা অন্য কোনো অসুখে ভুগছে অথবা এমন কোনো কাজ করেছে যা ক্ষুধা নষ্ট করে দেয়, তাহলে তাকে যদি হাজার বারও বলা হয় যে, এ খাদ্য উপাদানটি তোমার জন্য খুবই উপকারী, তথাপি সে তা খাওয়ার জন্য আগ্রহী হবে না।
অতএব, জ্ঞান থাকার পরেও মানুষের অভ্যন্তরে এ ধরনের বিভিন্ন উদ্দীপনা থাকতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদিও এ ধরনেরই। সে হাজার জানুক যে, মানুষের জন্য সামাজিক তৎপরতা খুবই ভালো, খুবই কল্যাণকর, কিন্তু তা সত্ত্বেও যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মধ্যে কাজটি সম্পাদনের জন্য উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় ততক্ষণ সে সক্রিয় হয় না। সে বলে, ঠিক আছে, অন্যরা গিয়ে কাজটি আঞ্জাম দিক। আমার দ্বারা এ কাজ সম্পাদিত হতে হলে সেজন্য আমার একটি উদ্দেশ্য থাকতে হবে, কোনো একটি উপাদান আমাকে গতিশীল করে তুলুক।
আমরা যখন স্বীকার করে নিয়েছি যে, সচেতন তৎপরতা ও মানবিক আচরণের জন্যে দুই ধরনের উপাদান অপরিহার্য ঃ এক ধরনের উপাদান হচ্ছে জ্ঞান ও অপর ধরনের উপাদান হচ্ছে আবেগানুভূতি সমূহ, অতঃপর আমরা যখন জেনেছি যে, হযরত সাইয়েদুশ শুহাদার তৎপরতা মানুষের সৌভাগ্যের ক্ষেত্রে কেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তখন আমরা ধরে নিচ্ছি যে, আমাদের জন্য এ জ্ঞান অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এই জ্ঞান নিজে নিজেই আমাদের মধ্যে তৎপরতা সৃষ্টিকারী ভূমিকা পালন করবে না। এসব ঘটনা জানা ও তার স্মৃতির স্মরণ যখন আমাদেরকে এমন কাজ সম্পাদনে বাধ্য করে, এমন পথের অনুসরণে বাধ্য করে যার ফলে আমাদের মধ্যে এমন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় যে, আমাদের মনও চায়, আমরা এ কাজ সম্পাদন করি, তখন স্বয়ং ঐ জ্ঞান আমাদের মধ্যে এ আগ্রহ তৈরী করে না, বরং এ জন্য আমাদের আবেগ-অনুভূতি সমূহকে উদ্দীপিত করতে হবে, আমাদের ভাবাবেগকে জাগ্রত করতে হবে, তাহলে আমরাও অনুরূপ একটি কাজ সম্পাদন করতে চাইবো।
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, দুই ধরনের উপাদানের প্রয়োজন। আলোচনা সভা, সংলাপ ও বক্তৃতা-ভাষণ প্রথম ধরনের উপাদানের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। অর্থাৎ তা থেকে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি। কিন্তু আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগ সমূহকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আমাদের জন্য আরেক ধরনের উপাদানেরও প্রয়োজন রয়েছে। অবশ্য স্বয়ং জ্ঞান, স্মৃতিচারণ, অধ্যয়ন ইত্যাদি এ ব্যাপারে ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু মৌলিক ভূমিকা কেবল সেই সব জিনিসই পালন করতে পারে যা আমাদের জীবনে আবেগানুভূতি সমূহ ও ভাবাবেগের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
কোনো দৃশ্যের দর্শন তথা যখন কোনো দৃশ্যের পুনঃনির্মাণ করা হয় এবং মানুষ তা নিকট থেকে দর্শন করে, অন্যদিকে কেউ যখন শোনে যে, এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিলো, অথবা তার জানা থাকে যে, এরূপ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো, সে ক্ষেত্রে এই দেখা ও জানার মধ্যে বিরাট পার্থক্য হয়ে থাকে।
আপনারা নিজেরাও আপনাদের জীবনে এ ধরনের অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়ে থাকতে পারেন। যে ঘটনা সম্পর্কে আপনারা জানেন যে, তা সংঘটিত হয়েছিলো বা সংঘটিত হচ্ছে, কিন্তু তা স্বচক্ষে দেখতে পান নি, অতঃপর আপনারা যখন স্বচক্ষে দেখতে পান যে, ঘটনাটি ঘটেছে, তখন এতদুভয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ঘটে।
আমরা সবাই জানি যে, এই শহরে বহু বঞ্চিত মানুষ আছে। কিন্তু একজন বঞ্চিত মানুষকে দেখলে তা আমাদের মধ্যে এমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে যে, না দেখে জানার পুরো জ্ঞানও কখনোই আমাদের মধ্যে অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে না।
মানুষ যখন একজন রোগীর করুণ অবস্থা দেখতে পায়, যখন একজন ইয়াতিমের অবস্থা বা একজন শহীদের সন্তানের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে পায়, তখন সে ব্যক্তির মধ্যে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, শুধু জানা থেকে কখনোই তার মধ্যে অনুরূপ প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে না। এ সত্যটি যেমন আমরা আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেও অনুভব করতে পারি, তেমনি দ্বীনী জ্ঞানসূত্র সমূহ অধ্যয়ন করেও তা জানতে পারি।
এবার উদাহরণ স্বরূপ আমি কোরআন মজীদ থেকে এমন একটি ঘটনা উল্লেখ করবো যা আপনাদের সকলেরই জানা আছে।
আপনারা জানেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা তূর পর্বতে গিয়ে তাঁর ইবাদত করার জন্য হযরত মূসা (আঃ)কে আহ্বান করেন। তখন লোকদেরকে বলা হয় যে, তিনি সেখানে এক মাস অবস্থান করবেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা ছিলো এই যে, তিনি সেখানে চলি্লশ দিন অবস্থান করুন। আল্লাহ্ বলেন ঃ “আর আমরা মূসার কাছ থেকে তিরিশ রজনীর প্রতিশ্রতি নিলাম এবং (পরে) তাকে দশ রজনী দিয়ে সম্পূরণ করলাম।”
কিন্তু লোকেরা ঐ দশ দিনের কথা জানতো না। আর এটা ছিলো বনী ইসরাঈল জাতির জন্য একটি পরীক্ষা। তাই যখনই তিরিশ দিন পূর্ণ হলো অমনি তারা হযরত মূসা (আঃ)-এর অনুপস্থিতিকালীন তাঁর স্থলাভিষিক্ত হযরত হারূন (আঃ)-এর কাছে এলো এবং বললো ঃ “তোমার ভাই তো এলো না।” তিনি বললেন ঃ “আমরা অপেক্ষা করবো; ইনশা আল্লাহ্ তিনি আসবেন।” বর্ণিত আছে যে, পরদিন তারা আবার এসে বললো ঃ “মূসা তো আসে নি; বুঝাই যাচ্ছে যে, সে আমাদেরকে ফেলে রেখে চলে গেছে।”
সামেরী এ সুযোগকে কাজে লাগালো এবং সেই গোবৎসটি তৈরী করলো আর লোকদেরকে তার পূজা করার জন্য আহ্বান জানালো। তারা বললো ঃ “এ হচ্ছে তোমাদের খোদা আর মূসার খোদাও এ-ই।” সামেরী বললো, মূসা যে খোদা সম্বন্ধে বলেছিলো যে, আমি পর্বতে যাবো এবং তাঁর কাছে মুনাজাত করবো, আর যিনি মূসাকে নবুওয়াতে অভিষিক্ত করেছেন এ-ই সেই খোদা। আমি তাকেই তৈরী করেছি।
বনী ইসরাঈলের অনেক লোকই গোবৎসের সামনে সিজদায় পতিত হলো এবং তার পূজায় মশগূল হলো।
আল্লাহ্ তা’আলা তূর পর্বতে হযরত মূসা (আঃ)কে ওহী করলেন যে, তোমার কওমের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং তোমার এই দশ দিনের অনুপস্থিতিতে লোকেরা মূর্তিপূজারী হয়ে গেছে।
হযরত মূসা (আঃ) ঘটনাটির কথা শুনলেন, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি মনে কষ্টও পেলেন না, শিরে করাঘাতও করলেন না এবং তাঁর জীবন তিক্ত বলেও অনুভূত হলো না। উক্ত দশ দিন শেষ হলে ও সেখানে অবস্থানের মোট চলি্লশ দিন পূর্ণ হলে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর নিকট কয়েকটি আসমানী ফলক নাযিল করলেন।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সম্ভবতঃ নবী-রাসূলগণের (আঃ) মধ্যে এমন আর কোনো নবী বা রাসূল ছিলেন না আল্লাহ্ তা’আলা যার নিকট আসমানী ফলক আকারে কিতাব নাযিল করেছিলেন এবং সে নবী বা রাসূল এসে লোকদের হাতে সে ফলক তুলে দিয়েছিলেন। ইসলামেও এমনটি ঘটে নি। হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ওপর আয়াত নাযিল হয় এবং তিনি লোকদেরকে তা শুনিয়ে দেন।
হযরত মূসা (আঃ) যে নূরানী ফলক সমূহ নিয়ে আসেন লোকেরা তা দেখতে পায়, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তারা যা দেখতে ও শুনতে পায় তা হচ্ছে নবীর কালাম। যেহেতু বনী ইসরাইল ছিলো এমন একটি জনগোষ্ঠী যারা বিভিন্ন ধরনের বাহানার আশ্রয় নিতো। এ কারণে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের ওপর যে কিতাব নাযিল করেন তাকে আসমানী ফলক আকারে নাযিল করেন।
হযরত মূসা (আঃ) তাঁর ওপর নাযিলকৃত আসমানী ফলক সমূহ নিয়ে লোকদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত হুকুম-আহ্কাম ও শরয়ী বিধিবধানের আনুগত্য করার জন্য দাওয়াত দিতে এলেন। তিনি যখন এলেন তখন দেখলেন যে, লোকেরা গোবৎসের পূজা করছে। তিনি যেইমাত্র দেখলেন যে, লোকেরা গোবৎসের পূজা করছে সাথে সাথে তাঁর জীবন বিষিয়ে উঠলো। তাঁর জীবনটা এমনই বিষিয়ে উঠলো যে, তিনি ফলকগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। “সে (মূসা) ফলকগুলো ফেলে দিলো এবং তার (হারূনের) মাথা ধরে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো।” তিনি হযরত হারূন (আঃ)-এর দাড়ি ধরে ঝাঁকালেন এবং চিৎকার করে বললেন ঃ কেন লোকদেরকে এ কাজ করতে দিলে? _ “তাহলে কি তুমি আমার নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছো?”
অতএব, সুস্পষ্ট যে, স্রেফ জ্ঞানীসুলভ আলোচনা ও পর্যালোচনা এই শোকানুষ্ঠানের ভুমিকা পালন করতে পারে না। তাই সমাজে এমন দৃশ্যের অবতারণা করতে হবে যা মানুষের ভাবাবেগকে জাগ্রত করতে পারে। লোকেরা যখন সকাল বেলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখতে পায় যে, সকলেই কালো পোশাক পরিধান করেছে এবং সর্বত্র কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে তখন তা হৃদয় সমূহকে আলোড়িত করে। হ্যা, আমরা জানি যে, আগামী কাল মহররম শুরু হচ্ছে, কিন্তু কালো পতাকা চোখে পড়লে তা মানুষের হৃদয়ে এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করে যা কেবল পয়লা মহররমের কথা জানা থাকলে ঘটে না। তারপর এভাবে দলে দলে লোকেরা যখন অত্যন্ত আবেগ ও উচ্ছ্বাসের সাথে বুক চাপড়ায় তখন তা মানুষের মাঝে এমন প্রভাব বিস্তার করে যে, অন্য কোনো কাজই অনুরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
হ্যা, দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো এই যে, আমরা যখন সাইয়েদুশ্ শুহাদার স্মৃতিকে জীবন্ত রাখতে চাই তখন এজন্য আলোচনা সভা, সংলাপ, বক্তৃতা-ভাষণ, রাউন্ড টেবিল বৈঠক ইত্যাদির আয়োজনকে কেন যথেষ্ট গণ্য করছি না; কেন শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে? এর জবাব হচ্ছে, এ কারণে এ সব দৃশ্যের অবতারণা করতে হবে যে, জ্ঞান ছাড়াও আমাদের মধ্যে আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগকে অধিকতর শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগ যখন উদ্দীপিত হয় তখন তা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
আপনারা আপনাদের ব্যক্তিগত জীবনে, তেমনি সামাজিক ও সামষ্টিক জীবনে, বিশেষ করে বিগত তিরিশ-চলি্লশ বছরে তাগূতী ও কুফরী প্রশাসনের বিরুদ্ধে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে এর দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করেছেন। তা হচ্ছে, মহররম ও সফর মাসে হযরত সাইয়েদুশ শুহাদার নাম এবং সাইয়েদুশ শুহাদার স্মরণে আয়োজিত শোকানুষ্ঠান সমূহ জনগণকে আন্দোলনে উদ্দীপিত করতো। আশূরার দিনগুলো ছাড়া অন্য সময়ে এবং এসব ঐতিহ্যিক শোকানুষ্ঠান সমূহ ও অনুরূপ অনুষ্ঠানাদি ছাড়া লোকদের মধ্যে এ ধরনের জোশ ও উচ্ছ্বাস তৈরী হতো না। অর্থাৎ কেবল বক্তৃতা, আলোচনা ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ নয়, বরং এমন কাজ করা দরকার, এমন আচরণ প্রদর্শন করা দরকার যা মানুষের মধ্যে আবেগানুভূতি, ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাসকে উদ্দীপিত করবে। কেবল তখনই তা প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।
এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, কেন হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) বার বার বলতেন যে, আমাদের যা কিছু আছে তার সবই আমরা মহররম ও সফর থেকে পেয়েছি। এ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, কেন তিনি এই ঐতিহ্যিক রূপেই শোকানুষ্ঠান করার ওপর এত গুরুত্ব আরোপ করতেন। এর কারণ ছিলো এই যে, তা দীর্ঘ তেরশ’ বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এবং এ দীর্ঘ সময়ে দেখা গেছে যে, তা মানুষের দ্বীনী আবেগানুভূতি, ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাসকে উদ্দীপিত করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে থাকে, মু’জিযার মতো প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, কী বিপ্লবের যুগে, কী যুদ্ধের যুগে রণাঙ্গনে, আমাদের যে সব বিজয় অর্জিত হয়েছে তার বেশীর ভাগই ছিলো জনগণের আবেগ ও উচ্ছ্বাসের প্রভাব _ যে আবেগ ও উচ্ছ্বাস আশূরার দিনগুলোতে সাইয়েদুশ শুহাদার নামের বরকতে সৃষ্টি হতো। এ প্রভাব কোনো ছোটোখাটো ব্যাপার নয়। জনগণের মধ্যে এভাবে যে ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাসের এবং আন্দোলনের সৃষ্টি হয় তা অন্য কোন্ মূল্যের বিনিময়ে সৃষ্টি করা সম্ভব হতো?
এ সব অনুষ্ঠান লোকদের মধ্যে এমন এক পবিত্র প্রেম সৃষ্টি করে দেয় যে, তা লোকদেরকে শাহাদাতের জন্য প্রস্তুত করে দেয়। যদ বলি যে, অন্য কোনো আদর্শেই এবং অন্য কোনো সমাজেই এ ধরনের উপাদানের অস্তিত্ব নেই তাহলে তা অতিশয়োক্তি হবে না। অতএব, আশূরার ঘটনার স্মরণের জন্য যে আলোচনা ও সংলাপ ছাড়া অন্যান্য কাজও করা প্রয়োজন _ যে কাজ লোকদের মধ্যে ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস উদ্দীপিত করার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী হবে, তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো।
উক্ত প্রশ্নের সাধারণ ও সংক্ষিপ্ত জবাব এই যে, মানুষকে শুধু জ্ঞানের জন্য সৃষ্টি করা হয় নি। আমাদের মাঝে জ্ঞান ছাড়াও অন্য হাতিয়ারও রয়েছে, তা হচ্ছে উদ্দীপনা ও উচ্ছ্বাস _ যা আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগ থেকে উদ্ভূত হয়। এগুলো যাতে স্বীয় ভূমিকা পালন করতে পারে সে উদ্দেশ্যে এগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আর এ সব অনুষ্ঠানই হচ্ছে তা শক্তিশালী করার মাধ্যম।
উক্ত প্রশ্নের পর আরেকটি প্রশ্ন উপস্থাপিত হয়।
এ পর্যন্ত আমরা বুঝতে পেরেছি যে, সমাজে এমন একটি উপাদান তৈরী করা প্রয়োজন যা মানুষের মধ্যে দ্বীনী ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাসকে উদ্দীপিত করবে _ যাতে তারা সাইয়েদুশ শুহাদার ভূমিকার অনুরূপ ভূমিকা পালন করতে চাইবে, তাঁর চলার পথে চলতে চাইবে, এজন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে।
তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে, মানুষের মধ্যে ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস জাগ্রত করার জন্য শোকানুষ্ঠান ও ক্রন্দন একমাত্র পন্থা নয়। এমনও হতে পারে যে, উৎসব ও আনন্দজনক অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও মানুষের মধ্যে ভাবাবেগ জাগ্রত হতে পারে। হ্যা, আমরা নিজেরাও জানি যে, পবিত্র ব্যক্তিদের জন্মদিনগুলোতে, বিশেষ করে স্বয়ং সাইয়েদুশ শুহাদার জন্মদিনে যখন উৎসব-অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয় এবং প্রশংসামূলক কবিতা ও সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়, সেগুলোর মাধ্যমেও মানুষের মধ্যে ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়। তৃতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে এই যে, মানুষের ভাবাবেগকে জাগ্রত করার জন্য কেন আমরা আনন্দজনক অনুষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাই না? এ জন্য ক্রন্দন করতে হবে কেন? নিজেকে আঘাত করতে হবে কেন? শিকলগুচ্ছের দ্বারা নিজেকে আঘাত করবো কেন? বরং আমরা আনন্দজনক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো, লোকদের মধ্যে মিষ্টি ও মিষ্ট জিনিস বিতরণ করবো, প্রশংসামূলক কবিতা ও প্রশংসাগীতি পরিবেশন করবো, সঙ্গীত পরিবেশন করবো _ যাতে লোকদের মধ্যে ভাবাবেগ জাগ্রত হয়।
এ প্রশ্নের জবাব এই যে, ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস বিভিন্ন ধরনের। যে কোনো ধরনের আবেগানুভূতি, ভাবাবেগ ও উচ্ছ্বাস উদ্দীপিত করার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। আর ইসলামের ইতিহাসে যে ঘটনা সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে তা হচ্ছে হযরত আবা আবদিল্লাহ্ আল্-হোসাইনের (আঃ) শাহাদাত। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি ইসলামের ইতিহাসকে বদলে দেন। তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি কিয়ামত দিবস পর্যন্ত লোকদেরকে আন্দোলনের জন্য, সংগ্রামের জন্য, প্রতিরোধের জন্য ও দৃঢ়তার জন্য শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কেবল উৎসব ও আনন্দের অনুষ্ঠান এ ভূমিকা পালনের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং ঐ ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যশীল কাজ আঞ্জাম দিতে হবে। অর্থাৎ এমন কাজ করতে হবে যাতে মানুষের অন্তরে দুঃখ-বেদনা জাগ্রত হয়, লোকদের চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয়ে যায়, হৃদয় সমূহে ভাবাবেগ, উচ্ছ্বাস ও প্রেমের জন্ম হয়। আর এ ঘটনার ক্ষেত্রে যে কাজটি এ ভূমিকা পালন করতে পারে তা হচ্ছে এই শোকানুষ্ঠান এবং ক্রন্দন করা ও অন্যদেরকে ক্রন্দন করানো। নচেৎ হাসি ও আনন্দ কখনোই এ ভূমিকা পালন করতে পারে না।
হাসি ও আনন্দ কখনোই একজন মানুষকে শাহাদাত-প্রেমিক বানাতে পারে না। কখনোই তা একজন মানুষকে ইরাকের শালাম্চার রণাঙ্গনে টেনে নিয়ে যেতে পারে না, কখনোই তা দীর্ঘ আট বছরব্যাপী যুদ্ধকে লোকদের জন্য সহনীয় করে তুলতে পারে না। এ জন্য এক ভিন্ন ধরনের প্রেমের প্রয়োজন _ যা জ্বালা, অশ্রু ও আবেগ তৈরী করবে। আর তার উপায় হচ্ছে এই শোকানুষ্ঠান সমূহ।
এই ছিলো তৃতীয় প্রশ্ন অর্থাৎ সাইয়েদুশ শুহাদার স্মৃতি জীবন্ত রাখার জন্য কেন আমরা শোকানুষ্ঠান করবো, ক্রন্দন করবো _ তার জবাব। কিন্তু এ প্রশ্নের ধারাবাহিকতায় আরো একটি প্রশ্ন আছে যা প্রধানতঃ আশূরার দিনগুলোতে উপস্থাপন করা হয়। প্রধানতঃ মুনাফিকরাই এ প্রশ্নটি করে থাকে।
অবশ্য আধুনিক মুনাফিকরাই এ প্রশ্নটি তুলে থাকে। তারা বলে, খুবই ভালো কথা। আমরা এ পর্যন্ত মানি যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর ইতিহাস অত্যন্ত প্রভাবশালী ও আন্দোলন সৃষ্টিকারী ছিলো। তাই অবশ্যই তাঁকে মনে রাখতে হবে এবং তাঁর জন্য শোকানুষ্ঠানও করতে হবে। এ পর্যন্ত আমরাও মানি। কিন্তু আপনারা এইসব শোকানুষ্ঠানে অন্য কাজও করে থাকেন। আপনারা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)কে স্মরণ করা এবং তাঁর জন্য অশ্রুপাত করা ছাড়াও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর দুশমনদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করছেন। এ কাজটি কেন করছেন? এ তো এক ধরনের সহিংসতা, এ তো এক ধরনের খারাপ ধারণা পোষণ, এ তো এক ধরনের নেতিবাচক আবেগানুভূতি। এ কাজটা আমাদেরকে আধুনিক মানুষ হতে দেবে না। আপনাদের মধ্যে যখন আবেগানুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে তখন আপনারা যান ক্রন্দন করুন গিয়ে, শোকানুষ্ঠান করুন গিয়ে। কিন্তু তাঁর দুশমনদের ওপর লা’নত করছেন কেন? আপনারা এই যে বলছেন ঃ “তোমার দুশমনদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে আমি আল্লাহ্র নৈকট্য কামনা করছি।” আশূরার যিয়ারতনামায় এ কথাগুলো বলছেন এবং সেই সাথে তাঁর দুশমনদের বিরুদ্ধে একশ’ বার ল’নত করছেন কেন? বরং তাঁর পবির্তে ইমাম হোসাইনের (আঃ) প্রতি একশ’ বার সালাম পাঠান। তা না করে লা’নত করছেন কেন? গালি দিচ্ছেন কেন? এভাবে লোকদের মনে অন্যদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা দিচ্ছেন কেন? অন্যদের সম্পর্কে নেতিবাচক ভাবাবেগ তৈরী করছেন কেন? আজকের যুগ হচ্ছে এমন একটি যুগ যখন সকল মানুষের সাথে হাসিখুশীর সাথে, আনন্দের সাথে ও হাসিমুখে আচরণ করতে হবে। আজকে জীবনের কথা বলতে হবে, আনন্দের কথা বলতে হবে, শান্তি ও সমঝোতার কথা, আপোসের কথা বলতে হবে। অন্যদিকে লা’নত বর্ষণ করার ও অন্যদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, অন্যদের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন _ এ সব কাজ হচ্ছে এক ধরনের সহিংসতা _ যা চৌদ্দশ’ বছর আগের ব্যাপার এবং হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)কে হত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। কিন্তু আজকে, আজকের সমাজ, আজকের মানুষ এসব বিষয়কে পসন্দ করে না। আসুন, এর পরিবর্তে আপোসরফার ও সমঝোতার পথ গ্রহণ করুন, দুশমনদের সামনেও হাসিমুখ হোন, তাদেরকেও ভালোবাসুন। ইসলাম কি ভালোবাসার ধর্ম নয়? দয়া ও অনুগ্রহের ধর্ম নয়? এই যে কেবল লা’নত করছেন, দোষারোপ করছেন _ এটা আপনারা কী ধরনের কাজ করছেন?
কেউ যদি আসলেই না জানার কারণে এসব প্রশ্ন করে তাহলে তার জবাব দেয়া কঠিন নয়। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে, এর প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে যে, যারা এ ধনের কথা বলে তাদের অনেকেরই মাথায় অন্য চিন্তা কাজ করছে; তাদের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। তারা অন্য এক নীতিমালার অনুসরণ করছে, নয়তো তারা অন্যদের তৈরী করা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। তবে আমরা ধরে নিচ্ছি যে, তারা জেনেবুঝে ও বুদ্ধিমানের মতো এ প্রশ্ন করেছে এবং জবাব শোনার জন্যই প্রশ্ন করেছে। অতএব, আমরাও এর যুক্তিসঙ্গত জবাব দেবো।
কেন তারা এ প্রশ্ন করেছে আমরা এখন সে বিচারে যাবো না; বিষয়টা আমরা ব্রাকেটের মধ্যে রেখে দিচ্ছি। একজন তরুণ প্রশ্ন করেছে, আবা আবদিল্লাহ্র ঘাতকদের প্রতি লা’নত করতে হবে কেন? আপনারা আশূরার যিয়ারতনামায় যেসব লা’নত বর্ষণ করছেন তার পরিবর্তে ইমাম হোসাইনের প্রতি আরো একশ’ বার সালাম করুন। সাইয়েদুশ শুহাদার প্রতি সালাম পাঠানোতে কি সওয়াব নেই? তাহলে ঐ একশ’ বার লা’নতের পরিবর্তে একশ’ বার সালাম পাঠান। এতে অসুবিধাটা কোথায়? অন্যদিকে এত সব লা’নত, দোষ বর্ণনা, গালি দেয়া, কটুকাটব্য করা, সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া _ এ সবের কী প্রয়োজন আছে?
তার এ প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব হচ্ছে এই যে, ঠিক যেভাবে মানুষকে কেবল জ্ঞান সহকারে সৃষ্টি করা হয় নি, সেভাবেই কেবল ইতিবাচক আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগ সহকারে সৃষ্টি করা হয় নি। বরং মানুষ হচ্ছে এমন এক সৃষ্টি যে ইতিবাচক আবেগানুভূতিরও অধিকারী, আবার নেতিবাচক আবেগানুভূতিরও অধিকারী; তেমনি সে যেমন ইতিবাচক ভাবাবেগের অধিকারী তেমনি নেতিবাচক ভাবাবেগেরও অধিকারী। আমাদের সত্তায় যেভাবে আনন্দ নিহিত আছে তেমনি দুঃখ-বেদনাও নিহিত আছে। আল্লাহ্ তা’আলাই এগুলো আমাদের মধ্যে দিয়েছেন; আমাদেরকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
বস্তুতঃ কোনো মানুষই দুঃখ-বেদনা ছাড়া যিন্দেগী যাপন করতে পারে না। আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে যেভাবে হাসি দিয়েছেন ঠিক সেভাবেই ক্রন্দন দিয়েছেন। হাসির জায়গায় যেমন হাসতে হবে, তেমনি ক্রন্দনের জায়গায় ক্রন্দন করতে হবে। এগুলো আল্লাহ্ তা’আলাই দিয়েছেন এবং আমরা এরূপই সৃষ্টি হয়েছি। অতএব, আমাদের সত্তার একটি অংশকে বন্ধ করে দেয়ার মানে হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে যে সব বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন আমরা সেগুলোকে কাজে লাগাবো না, অথচ তা কাজে লাগানোর জন্যই আমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
আল্লাহ্ তা’আলা যে আমাদের মধ্যে ক্রন্দনের বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছেন তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ক্রন্দন করতে হবে। আমাদেরকে তার যথোপযুক্ত ক্ষেত্র খুঁজে পেতে হবে। নচেৎ আমাদের সত্তায় যে ক্রন্দনের বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে তা অর্থহীন হয়ে যায়। আল্লাহ্ তা’আলা কেন মানুষের মধ্যে এ সব আবেগানভূতি দিয়েছেন? কেন মানুষ দুঃখিত, বিমর্ষ ও ব্যথিত হয়? কেন সে অশ্রুপাত করে? বুঝাই যাচ্ছে যে, মানুষের জীবনে ক্রন্দনেরও স্থান আছে এবং মানুষের পূর্ণতায় তার ভূমিকা রয়েছে। আল্লাহ্র কাছে ক্রন্দন করা, তাঁর শাস্তিকে ভয় করা, আল্লাহ্র দীদারের জন্য অধীর হওয়া, প্রিয়জনের সাথে মিলনের জন্য উদগ্রীব হওয়া, অথবা কোনো প্রিয়জনের জন্য সমবেদনার কারণে মূহ্যমান হয়ে পড়া অথবা কোনো প্রিয়জনের ওপর আপতিত বিপদাপদের কারণে মানুষের ভেঙ্গে পড়া _ এগুলো হচ্ছে মানব প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য।
কোথাও না কেথাও ক্রন্দনের বহিঃপ্রকাশ ঘটা প্রয়োজন। ঠিক সেভাবেই, যারা আমাদের সেবাযত্ন করে আল্লাহ্ তা’আলা তাদের জন্য আমাদের মাঝে ভালোবাসা, করুণা ও মমত্ববোধ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তেমনি যারা পূর্ণতার অধিকারী, তা হোক শারীরিক পূর্ণতা বা বিচারবুদ্ধির পূর্ণতা বা মনস্তাত্তি্বক পূর্ণতা বা স্নেহমমতার পূর্ণতা, মানুষ যখন অনুভব করে যে, কোথাও পূর্ণতা আছে, তখন সে তাকে পসন্দ করে, ভালোবাসে।
মানুষের সত্তায় ঠিক এর বিপরীত একটি জায়গাও রয়েছে যার নাম দুশমনের প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশ। মানব সন্তানের প্রকৃতিতে যেমন এ বৈশিষ্ট্য নিহিত রয়েছে যে, যে ব্যক্তি তার সেবাযত্ন করে তাকে সে ভালোবাসে, তেমনি এ-ও তার প্রকৃতিতে নিহিত রয়েছে যে, যে কেউ তার ক্ষতি করলে সে তার দুশমনে পরিণত হয়ে যায়। তবে একজন মু’মিনের জন্য বস্তুগত ক্ষতির তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। কারণ, স্বয়ং এ দুনিয়ারই তার কাছে কোনো মূল্য নেই। কিন্তু যে দুশমন মানুষের কাছ থেকে দ্বীনকে কেড়ে নেয়, যে দুশমন মানুষের কাছ থেকে চিরন্তন সৌভাগ্য কেড়ে নেয়, তাকে কি সে উপেক্ষা করতে পারে?
কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে ঃ “নিঃসন্দেহে শয়তান তোমাদের দুশমন, অতএব, তোমরা তাকে দুশমন রূপে গ্রহণ করো।” অতএব, শয়তানের উদ্দেশে হাসিমুখ দেখানো যায় না, তার সাথে সমঝোতা করা যায় না। নচেৎ তুমিও শয়তানে পরিণত হয়ে যাবে। আল্লাহ্র ওলীগণের সাথে বন্ধুত্ব করা যদি জরুরী হয় তাহলে আল্লাহ্র দুশমনদের সাথে অবশ্যই দুশমনী করতে হবে।
এটাই হচ্ছে মানবিক প্রকৃতি এবং মানুষের পূর্ণতা ও সৌভাগ্য এতেই নিহিত। আল্লাহ্র দুশমনের সাথে দুশমনী না থাকলে সে আর মানুষ থাকে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে তাদের সাথে তার আচরণ বন্ধুসুলভ হয়ে যায়। তখন তারা পরস্পর মিশ্রিত হয়ে যায়, পরস্পর মেলামেশা ও ওঠাবসা করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সে তাদের আচরণ গ্রহণ করে, তাদের বক্তব্যকে গ্রহণ করে নেয়, কালক্রমে সে নিজেই আরেক জন শয়তানে পরিণত হয়ে যায় এবং তাদের মতোই কথা বলতে থাকে।
আপনারা কি দেখছেন না এ ব্যাপারে কোরআন মজীদ কী বলছে? “যারা আমাদের আয়াতকে উপহাস করে (হে রাসূল!) আপনি যখন তাদেরকে দেখবেন তখন তাদেরকে পরিহার করে চলবেন।” অতএব, কোনো মু’মিন যখন দেখবে যে, কেউ দ্বীনের সমালোচনা করছে, দ্বীনের অবমাননা করছে, দ্বীন সম্পর্কে আপত্তিকর কথাবার্তা বলছে, উপহাস করছে, বিদ্রুপ করছে, তখন ঐ মু’মিনের কর্তব্য হচ্ছে সে তাদের নিকটবর্তী হবে না, তাদের কোনো কথা শুনবে না।
উক্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এরপর এরশাদ হয়েছে যে, কেউ যদি এ উপদেশ না শোনে অর্থাৎ মু’মিনদের মধ্য থেকে কেউ যদি এ উপদেশ গ্রহণ না করে তাহলে সে যেন জেনে রাখে যে, শেষ পর্যন্ত সে তাদের দলেই শামিল হয়ে যাবে। আর “নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কাফেরদের ও মুনাফিকদের সকলকেই জাহান্নামে একত্রিত করবেন।”
দ্বীনকে উপহাসকারীদের সাথে যারা সুসম্পর্ক রাখে, তাদেরকে হাসিখুশী চেহারা দেখায়, শেষ পর্যন্ত উপহাসকারীদের কথাবার্তা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, আর তাদের ওপর যখন ওদের কথাবার্তার প্রভাব পড়ে, তখন তাদের অন্তরে দ্বীন সম্পর্কে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়। অতঃপর যখন সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয় তখন ঈমানের ঘোষণা নিফাক হয়ে দাঁড়ায়। আর যে ব্যক্তির অন্তরে ঈমান নেই কিন্তু প্রকাশ্যে সে বলে ‘আমি মুসলমান’, এটা তার জন্য নিফাক হয়ে যায়, তখন কোরআন মজীদের ঘোষণা তার জন্য প্রযোজ্য হয়ে যায়। কাফেরদের সাথে ওঠাবসা ও মেলামেশার কারণে এ ধরনের লোক মুনাফিকে পরিণত হয়, অতএব, আখেরাতেও তারা জাহান্নামে কাফেরদের সঙ্গী হবে।
অন্য কথায়, দুশমনদের সাথে দুশমনী করা এ সব রোগজীবাণু, এসব ক্ষতি ও এসব বিপদাপদের মোকাবিলায় এক ধরনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। মানুষের শরীরে যেমন এক ধরনের আকর্ষণকারী শক্তি আছে যা কল্যাণকর উপাদান সমূহকে আকর্ষণ করে, তেমনি এক ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে যা বিষাক্ত জিনিস সমূহকে ও রোগজীবাণুকে প্রতিহত করে; রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে সেগুলোকে হত্যা করে। শ্বেতকণিকা সমূহের কাজ এটাই। শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়ে পড়ে তখন সে শরীরে রোগজীবাণু সমূহ বিকাশপ্রাপ্ত হয়; তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আর শরীরে যখন রোগজীবাণুর বিকাশ ঘটে তখন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর রোগের শেষ পরিণতি হচ্ছে মৃতু্য।
কিন্তু যদি বলি, না জনাব, শরীরে যখন রোগজীবাণু প্রবেশ করেছে তখন তাকে বলবো, খোশ আমদেদ। বলবো, রোগজীবাণু সাহেবগণ! আপনারা আমার চোখে ও মাথায় মেহমান হিসেবে থাকুন, আপনাদের প্রতি সম্মান দেখানো আমার জন্য অপরিহার্য। না, বরং শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে রোগজীবাণুকে তাড়িয়ে দিতে হবে, বের করে দিতে হবে, তাদেরকে হত্যা করতে হবে।
বস্তুতঃ এ হচ্ছে খোদায়ী রীতি, খোদায়ী সুব্যবস্থাপনা ও পরম প্রজ্ঞা। আর প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির জন্যই দু’টি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একটি হচ্ছে আকর্ষণের ব্যবস্থা, একটি হচ্ছে বিতাড়ন বা দমনের ব্যবস্থা। ঠিক যেভাবে প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির বিকাশের জন্যই তার প্রয়োজনীয় উপাদান সমূহ আকর্ষণ করা অপরিহার্য, ঠিক সেভাবেই তার জন্য বিষাক্ত ও ক্ষতিকর উপাদান সমূহের বিতাড়ন ও দমন অপরিহার্য। ক্ষতিকর উপাদান সমূহ প্রতিহত করতে না পারলে তার পক্ষে তার জীবন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। তাই প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টিই, বিশষ করে প্রাণীকুল ও মানুষ প্রতিরক্ষা শক্তি বা ক্ষতি প্রতিরোধ শক্তির অধিকারী। এ শক্তির কাজ হচ্ছে শরীরের জন্য ক্ষতিকর জিনিসকে বের করে দেয়া।
প্রাণীদেহে কতগুলো জিনিস স্বাভাবিকভাবে সব সময়ই আছে যা এক ধরনের যন্ত্রের মতো কাজ করে। যেমন ঃ তার কিডনি আছে, মূত্রথলি আছে; এগুলো ক্ষতিকর জিনিস বের করে দেয়ার কাজ করে। অনেক সময় বাইরে থেকে প্রবেশকারী রোগজীবাণু হামলা করে, তখন শ্বেতকণিকাগুলোকে কর্মতৎপর হয়ে উঠতে হয়; তারা রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করে ও তাদেরকে হত্যা করে এবং সেগুলোকে পুঁজ বা এ ধরনের অন্য কোনো রূপে বের করে দেয়।
মানুষের আত্মার ভিতরে, তার চেতনার ভিতরেও এ ধরনের উপাদান থাকা অপরিহার্য। এক ধরনের উপাদান কতক মানসিক উপাদান আকর্ষণ করবে যার ফলে, যারা আমাদের জন্য কল্যাণকর আমরা তাদের ওপর সন্তুষ্ট হবো, তাদেরকে পসন্দ করবো, ভালোবাসবো, তাদের কাছাকাছি হবো, আমরা জ্ঞান অর্জন করবো, পূর্ণতা অর্জন করবো, আদব-কায়দা শিক্ষা করবো, চারিত্রিক শিক্ষা অর্জন করবো। মানুষ ভালো জিনিসগুলোকে কেন পসন্দ করে? কারণ সে এগুলোর কাছে এসে এগুলো থেকে কল্যাণ হাসিল করে। এর বিপরীতে খারাপ জিনিসগুলোকে আমাদের অপসন্দ হওয়া উচিৎ। এর বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে ভালোর বিপরীত। যারা ভালো, যারা পূর্ণতার উৎস, যারা সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভূমিকার অধিকারী, কার্যতঃ তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। আর এর বিপরীতে যারা সমাজের জন্য ক্ষতিকর, কার্যতঃ তাদের সাথে দুশমনী করা প্রয়োজন।
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন ঃ “ইবরাহীম ও তার সঙ্গীসাথীদের মাঝে তোমাদের জন্য অনুসরণীয় উত্তম আদর্শ রয়েছে; যখন তারা তাদের কওমের উদ্দেশে বললো ঃ অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যাদের উপাসনা করছো তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নকারী। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার বরছি এবং আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরদিনের জন্য শত্রুতা ও বিদ্বেষ শুরু হলো যতক্ষণ না তোমরা একমাত্র আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনয়ন করো।” কোরআন মজীদ বলছে যে, আপনাদের উচিৎ হযরত ইবরাহীমের (আঃ) আর তাঁর সঙ্গীসাথীদের অনুসরণ করা।
আপনারা জানেন যে, ইসলামী সংস্কৃতিতে হযরত ইবরাহীম (আঃ) অত্যন্ত সমুন্নত অবস্থানের অধিকারী। হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলতেন ঃ আমি ইবরাহীমের অনুসারী। ‘ইসলাম’ নামটিও হযরত ইবরাহীম (আঃ)ই এ দ্বীন ও আদর্শের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন ঃ “সে তোমাদেরকে মুসলিমীন নামকরণ করে।”
কোরআন মজীদ কেন হযরত ইবরাহীমের (আঃ) অনুসরণ করতে বলেছে? কী করেছিলেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথীগণ? তাঁরা তাঁদের জাতির মূর্তিপূজার বিরোধিতা করেছিলেন এবং এ কারণে তাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছিলো। তাই মূর্তিপূজারীরা তাঁদেরকে সেখান থেকে বের করে দিয়েছিলো। তখন তাঁরা তাদের উদ্দেশে বললেন ঃ আমরা তোমাদের ওপর অসন্তুষ্ট; “অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদকারী।” তাঁরা সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিলেন এবং কেবল এখানেই থেমে থাকলেন না, বরং ঘোষণা করলেন ঃ তোমাদের ও আমাদের মধ্যে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত শত্রুতা ও বিদ্বেষের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলো যদি না তোমরা তোমাদের অপরাধ ও পাপাচার থেকে বিরত হও।
এ কারণেই আমরা ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে ও বড় শয়তানের বরুদ্ধে এত শত্রুতা পোষণ করি। আমরা কিছুতেই ‘আমেরিকা নিপাত যাক’ শ্লোগান বাদ দিতে দেবো না, কারণ আমরা হযরত ইবরাহীমের (আঃ) অনুসারী।
কোরআন মজীদ এরশাদ করেছে, তোমরা ইবরাহীমের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো; তোমরা সুস্পষ্ট ভাষায় বলো ঃ ‘ইসলামের দুশমনরা নিপাত যাক’। তোমরা তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের শত্রুতার ঘোষণা দাও। সবখানে হাসিমুখ নিয়ে যাওয়া চলে না। কোনো কোনো জায়গায় গোমড়ামুখো হতে হয়; মুখে অসন্তুষ্টির চিহ্ন ফুটিয়ে তুলতে হয়। সাথে সাথে বলতে হয়, আমরা তোমাদের দুশমন; আমরা তোমাদের সাথে আপোসরফা করবো না, সমঝোতা করবো না, যদি না তোমরা বিশ্বাসঘাতকতা বন্ধ করো। এ হচ্ছে কোরআন মজীদের নির্দেশ।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন বলা হতো যে, ফুরূ’এ দ্বীন অর্থাৎ দ্বীনের শাখা-প্রশাখা দশটি। ‘আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহি ‘আনিল্ মুন্কার্ _ ‘ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ’-এর পরবর্তী কাজটি বলা হতো “তাওয়াল্লা ও তাবার্রী”। অর্থাৎ সমস্ত মুসলমানের জন্য যে সব ফরয কাজের প্রতি মনোযোগী হওয়া ও তদনুযায়ী আমল করা অপরিহার্য তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার বন্ধুদেরকে ভালোবাসতে হবে এবং আল্লাহ্ তা’আলার দুশমনদের সাথে দুশমনী করতে হবে।
কেবল আল্লাহ্ তা’আলার বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্ব রাখাই যথেষ্ট নয়। আল্লাহ্ তা’আলার দুশমনদের সাথে দুশমনী না থাকলে তাঁর বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্বও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শরীরে যদি প্রতিহতকরণ ও প্রতিরক্ষা করণ ব্যবস্থা না থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় উপাদান আকর্ষণের ক্ষমতাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, আমাদেরকে আকর্ষণ ও প্রতিহত করণের ক্ষেত্রগুলোকে যথাযথভাবে জেনে নিতে হবে। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই যে, ক্ষেত্রবিশেষে ভুল করা হয়; যা আকর্ষণ করা প্রয়োজন আমরা তাকে প্রতিহত করি।
যে ব্যক্তি অজ্ঞতা সহকারে কথা বলেছে এবং এ কারণে ভুল কথা বলেছে, সে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। অতঃপর সে যদি তা বুঝতে পেরে লজ্জিত হয় ও সংশোধিত হয়, অথবা তার ভুল ধরিয়ে দিলে সে যদি তা মেনে নেয় তাহলে নিঃসন্দেহে সে ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। এ ধরনের লোকের সাথে দুশমনী করা ঠিক নয়। কোনো ব্যক্তি একটি গুনাহ্র কাজ করেছে কেবল এ কারণেই তাকে সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেয়া ঠিক নয়; তাকে সংশোধন করতে হবে। সে হচ্ছে রোগী; তার সেবাযত্ন করা প্রয়োজন। এটা দুশমনী প্রকাশের ক্ষেত্র নয়, যদি না কেউ জেনেবুঝে সমাজে পাপাচারের বিস্তার ঘটাবার চেষ্টা করে। এরূপ করলে তার এ কাজ হচ্ছে সমাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, পরিকল্পিত পাপাচার, নোংরামি; এরূপ ব্যক্তির সাথে অবশ্যই দুশমনী করতে হবে। কিন্তু কেউ যদি ভুলবশতঃ গুনাহ্ করে ফেলে, ভুল কাজ করে ফেলে, তাহলে তার সঙ্গে দয়ার্দ্রতার সাথে আচরণ করতে হবে। তার মান-ইজ্জত নষ্ট না করার চেষ্টা করতে হবে, তাকে সংশোধন করতে হবে, তার প্রতি দয়ার্দ্রতা দেখাতে হবে, তার সমস্যা থাকলে সে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
কিন্তু যে ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে দুশমনী করছে তার বেলায় বলতে হবে যে, আমরা সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকতে চাই। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন ঃ “(হে রাসূল!) ইয়াহূদী ও খৃস্টানরা কখনোই আপনার ওপর সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না আপনি তাদের আদর্শের অনুসরণ করেন।” আপনারা যতক্ষণ আপনাদের বিপ্লব থেকে হাত গুটিয়ে না নেবেন ততক্ষণ আমেরিকা আপনাদের ওপর সন্তুষ্ট হবে না।
আপনারা প্রতিদিনই দেখতে পাবেন যে, এ ধরনের কারো সাথে আপোসরফা ও সমঝোতা মানে কী, তাদের সাথে হাসিমুখ হওয়ার পরিণতি কী। তাদের প্রতি চূড়ান্ত অসন্তুষ্টি, বিদ্বেষ ও কঠোরতা প্রদর্শন এবং গোমড়ামুখো হওয়া অপরিহার্য। তাদের শিরের ওপর নিপাত বর্ষণ করা প্রয়োজন। কারণ, আমাদের মৃতু্য ও ধ্বংস ছাড়া তারা আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবে না। এতারা কেবল আমাদের শারীরিক মৃতু্যই চায় না, বরং তারা আমাদের রূহের _ আমাদের চেতনার মৃতু্য চায়, আমাদের দ্বীনের মৃতু্য চায়।
আমাদের আজকের এ আলোচনার মূল মর্ম হচ্ছে এই যে, সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর স্মরণ মানে হোসাইনী যিন্দেগীর পুনঃনির্মাণ যাতে আমরা তা থেকে কল্যাণ হাসিল করতে পারি। কেবল এ কারণেই জ্ঞানমূলক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ও তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা যাবে না যে, মানুষের জন্য আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগ উদ্দীপিত করার প্রয়োজন রয়েছে। আর কেবল ইতিবাচক আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগ এবং হাসিখুশী ও আনন্দকে এ কারণে যথেষ্ট গণ্য করা যাবে না যে, সাইয়েদুশ শুহাদার স্মৃতি ও তাঁর মযলুম অবস্থাকে জীবন্ত রাখা কেবল দুঃখ, বেদনা, ক্রন্দন ও বিলাপ ইত্যাদি তিক্ত আবেগানুভূতি ও ভাবাবেগের মাধ্যমেই সম্ভব।
অর্থাৎ হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ, তাঁর কবরের মাটির প্রতি ভালোবাসা নিবেদন এবং হোসাইনী ভূমির কদর করার পাশাপাশি ইমাম হোসাইনের (আঃ) দুশমন, ইসলামের দুশমন ও আল্লাহ্র দুশমনদের প্রতি কঠোর ভাষা প্রয়োগ করতে হবে, ঘৃণা ও অভিশাপ বর্ষণ করতে হবে। কেবল সালাম ও দরূদ আমাদের সমস্যার সমাধান দেবে না। আমরা হোসাইনী কল্যাণ লাভ করতে পারবো না যদি না তাঁর দুশমনদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করি; এরপর তাঁকে সালাম করতে হবে। মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে কোরআন মজীদও প্রথমে এরশাদ করেছে যে, তারা “কাফেরদের প্রতি রূঢ়” , এরপর এরশাদ হয়েছে ঃ “তাদের নিজেদের মধ্যে দয়াদর্্রচিত্ত”।
অতএব, সালামের পাশাপাশি লা’নতও থাকতে হবে। ইসলামের দুশমনদের প্রতি সম্পর্কচ্ছেদ ও দুশমনীর ঘোষণাও থাকতে হবে। আমরা যদি এমন হই তাহলেই আমরা হোসাইনী, অন্যথায় অযথা যেন আমরা নিজেদেরকে হোসাইনী বলে দাবী না করি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.