পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রে ইমাম মাহদী (আ.) বা ত্রাণকর্তার ধারণা ও দৃশ্য

পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রে ইমাম মাহদী (আ.) বা ত্রাণকর্তার ধারণা ও দৃশ্য

চিন্তাবিদ ও দার্শনিকরা প্রাচীন যুগ থেকেই আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। যেমন, প্লেটো তার কল্পিত ইউটোপিয়ায়, ফারাবী তার সূর্যের নগরে, টমাস ম্যুর তার কল্পিত পৃথিবীর স্বর্গে আদর্শ সমাজ বা দেশ গড়ার স্বপ্ন তুলে ধরেছেন। খোদায়ী ধর্মগুলোও মানুষকে ধ্বংস, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি দানকারী সর্বশেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সুসংসবাদ সব সময়ই দিয়ে এসেছে। সর্বশেষ ত্রাণকর্তার শাসন ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, সবার মধ্যে উচ্চ শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়া, ন্যায় বিচার, নিরাপত্তা, শান্তি এবং সবার জন্য সুখ-সমৃদ্ধি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু কথা হলো এই সর্বশেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাব কবে, কোথায় ও কিভাবে হবে এবং কবে এই ইউটোপিয়া বা কল্পনা বাস্তবায়িত হবে? সর্বশেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের যুগকে শেষ জামানা বা এপোক্যালিপসি বলা হয়। অবশ্য প্রত্যেক ধর্ম ও সম্প্রদায় ইতিহাসের শেষ অংশকে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে চিত্রিত করে আসছে।

 এসব বর্ণনার অধিকাংশের মধ্যেই অক্ষ শক্তি বা অসত্যের পক্ষের শক্তিগুলোর সাথে সর্বশেষ ত্রাণকর্তার অনুগত বাহিনীর রক্তাক্ত ও ভয়াবহ যুদ্ধ ঘটার এবং এসব ত্রাণকর্তার অনুগত বাহিনীর বিজয়ী হবার কথা বলা হয়েছে।
সর্বশেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সময়ে সত্য ও মিথ্যার পক্ষের শক্তিগুলোর লড়াইয়ে সত্যের শক্তির তথা সর্বশেষ ত্রাণকর্তার বিজয়ের বিষয়টি বিভিন্ন উপন্যাস, গল্প বা চলচ্চিত্র তৈরির মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এমনকি ত্রাণকর্তাকে আদর্শ বা নায়ক হিসেবে ধরে নিয়ে শিশুদের জন্যেও অনেক গল্প ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রি ও বিশেষ করে হলিউড অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। ভবিষ্যতের ব্যাপারে মানুষের জানার আগ্রহকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে ব্যাপক অর্থ উপার্জন এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আর এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্য উদ্দেশ্য হলো শেষ জামানা ও ত্রাণকর্তা সম্পর্কে পাশ্চাত্যের এবং ইহুদিবাদী মহলের চিন্তাধারা প্রচার করা। চলচ্চিত্রের ইতিহাসের প্রথম দিকের কিছু ছায়াছবিসহ বিভিন্ন সময়ের এবং সাম্প্রতিক সময়েরও অনেক পশ্চিমা চলচ্চিত্র এ উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছে। ১৯১৫ সালে নির্মিত বার্থ অফ এ নেশন বা একটি জাতির জন্ম এমনই এক ছায়াছবি। ইহুদি ধর্মের বিকৃত হয়ে-যাওয়া চিন্তাধারা বা ইহুদিবাদী চিন্তা-ভাবনা এ ছায়াছবিতে ভরপুর। ছায়াছবিটির পরিচালক গ্রিফিথের বর্ণবাদী চিন্তাভাবনা এবং অ-ইহুদিদের প্রতি তার গভীর বিদ্বেষ এ ছায়াছবির গোটা পরিবেশকে কলুষিত করে রেখেছে।
এর পরের বছরগুলোতে ফিলিস্তিনে ইসরাইল নামের একটি অবৈধ ও দখলদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন যোগানোর জন্য পাশ্চাত্যে অনেক ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে। হযরত মূসা (আঃ)’র টেন কমান্ডম্যান্টস বা দশ নির্দেশমালা ও বেনহুর নামের ছায়াছবিগুলো এ জন্যই তৈরি ও বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয়। চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট সমালোচক ও বিশেষজ্ঞ এরিক রড এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এ ছায়াছবিগুলো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অনুসারে নির্মিত হয়েছে বলে বলা যায় না। ছবিগুলোর পরিচালক ঘটনার ক্ষেত্রে এতটাই হস্তক্ষেপ করেছেন যে, পরিচালক নিজেই খ্রিস্টানদের প্রতিক্রিয়াকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে এসব ছায়াছবি তৈরির কথা স্বীকার করেছেন। গত কয়েক দশকে টফলার, হাংটিনটন ও ফুকোইয়ামার মতো আধিপত্যকামী মার্কিন চিন্তাবিদ পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় বিতর্কের কলেবরে অনেক সাম্রাজ্যবাদী ধারণা বা মতবাদ প্রচার করেছেন। আর এসব ধারণাও পাশ্চাত্যের অনেক ছায়াছবিতে সূক্ষ্ম কৌশলে প্রচার করা হচ্ছে। অবশ্য এ জন্য প্রধানতঃ ধর্মীয় আচ্ছাদন বা রং ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এসব আচ্ছাদনের ভেতর দিয়েও রাজনৈতিক বক্তব্য স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে। এ ধরনের একটি ছায়াছবির দৃষ্টান্ত হল, ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে বা স্বাধীনতা দিবস। ১৯৯৬ সালে নির্মিত এ ছায়াছবিতে দেখা যায় একটি মহাশুন্যযান পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে বলে বিভিন্ন কম্পিউটার থেকে খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ঐ নভোযান থেকে আসা সিগনালগুলোর অর্থ বুঝতে পেরে নভোযানটিকে মোকাবেলা করার পদ্ধতি শিক্ষা দিতে থাকেন। ফলে নভোযানটি পৃথিবীতে হামলা করলে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রয়োগ করা কৌশলের মাধ্যমে তাকে পরাস্ত করা হয় এবং নভোযানটি পৃথিবী ছেড়ে পালিয়ে যায়। ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে বা স্বাধীনতা দিবস শীর্ষক এই ছায়াছবিতে মার্কিন ও ইহুদিবাদী নেতাদের অনেক মনোভাব তুলে ধরা হয়েছে এবং ত্রাণকর্তাকে ইহুদি হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ ছায়াছবিতে পৃথিবীর শেষ সময় ঘনিয়ে আসার কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এবং ইহুদিরা যে এ জন্য খুশী তাও গোপন করা হয় নি। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ম্যাট্রিক্স নামের তিনটি ছায়াছবি নির্মাণ করা হয়। এসব ছায়াছবিতেও ভবিষ্যৎ ত্রাণকর্তার কথা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছবিগুলোর ঘটনাকে ২২০০ সালের বলে দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, সে সময় যন্ত্রদানব মানুষের মগজের ওপর আধিপত্য করবে। এ অবস্থায় নিও নামের একজন নির্বাচিত ব্যক্তিত্ব বা নায়ক ঐসব যন্ত্রদানবকে পরাজিত করে মানবজাতিকে মুক্ত করেন। যায়ন নামের পাহাড়ে গিয়ে (neo) নিও এই মুক্তির ব্যবস্থা নেন। যায়ন বা সাহইয়ুন পাহাড়টি রয়েছে ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দস শহরে। এভাবে দেখানো হয়েছে যে নতুন বা নিও নামের ত্রাণকর্তা মানুষকে জায়ন পাহাড়ের দিকে পরিচালিত করছেন। ইহুদিবাদীদের কথিত প্রতিশ্রুত-ভূমি বা দখলদার ইসরাইলের প্রতি দর্শকদের মনে ভালো ধারণা সৃষ্টির জন্যই যে এ ধরনের গল্প সাজানো হয়েছে তা স্পষ্ট। পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রে ইহুদিবাদ বা বিকৃত ইহুদি চিন্তাধারা তুলে ধরার পাশাপাশি ইসলামী চিন্তাধারা ও মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপরও আঘাত হানা হচ্ছে। ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টির জন্য ইসলামকে বিকৃতভাবে তুলে ধরার এ প্রচেষ্টার একটি নিদর্শন হলো দ্যা ম্যান হু স’ টোমোরো বা যে লোকটি ভবিষ্যৎকে দেখেছেন শীর্ষক ছায়াছবি। ষোড়ষ শতকের গণক নস্ট্রাডমাসের ভবিষদ্বাণীর আলোকে নির্মিত হয়েছে এ ছায়াছবি। নস্ট্রাডমাসের ভবিষদ্বাণী শীর্ষক বইয়ের আলোকে মেট্রো গোল্ডেনমায়ার কোম্পানী এই ছায়াছবি নির্মাণ করে ইসলাম ধর্মে উল্লেখিত ভবিষ্যতের ত্রাণকর্তা বা হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) সম্পর্কে খারাপ ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। এ ছায়াছবিতে হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)কে পুরোপুরি সত্যের বিপরীতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং তাঁর সম্পর্কে মুসলমানদের বিশ্বাসকে উপহাস করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরানের অধ্যাপক হাসান বুলখারি বলেছেন, হলিউডের ছায়াছবি এখন বেশ জোরালোভাবে শেষ ত্রাণকর্তার ধারণা প্রচার করছে। তারা একদিকে ইসলামের হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) সম্পর্কিত ধারণাকে আঘাত করছে বা বিকৃত করছে অন্যদিকে শেষ ত্রাণকর্তা সম্পর্কে নিজের আজগুবি কল্পনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে আমি এ কথা বলছি না, বরং হলিউডের ছায়াছবি বিশ্লেষণ করেই আমার মধ্যে এ ধারণা জন্মেছে।
জনাব হাসান বুলখারি আরো বলেছেন, সংকটপীড়িত মানুষ এখন ঐশী বা খোদায়ী সাহায্যের আশা করছে বা ভবিষ্যতের ত্রাণকর্তার জন্য অপেক্ষা করছে। হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) ‘র দাওয়াতি কার্যক্রম তুলে ধরা মুসলমানসহ সবারই দায়িত্ব। আর এ জন্য গণমাধ্যম ব্যবহার করা জরুরী। আমি নিশ্চিত যে এ আহ্বান মানুষের মধ্যে সাড়া জাগাবে এবং এভাবে পাশ্চাত্যের প্রচার-যুদ্ধ মোকাবেলা করাও সম্ভব হবে। মানবজাতি যে শেষ ত্রাণকর্তা তথা হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)’র আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার অন্যতম লক্ষণ হলো বিশ্বজয়ী বা অলৌকিক নায়কদের কাহিনীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। দর্শকদের কাছে স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান ও সুপারম্যান জাতীয় নায়ক চরিত্রের ব্যাপক জনপ্রিয়তা এর প্রমাণ। দ্যা ডার্ক নাইট বা অন্ধকারের বিজয়ী বীর শীর্ষক ছায়াছবি এ ধারারই আরেকটি সংযোজন। রেকর্ড পরিমাণে এ ছায়াছবির কপি বিক্রির ঘটনায় বোঝা যায় মুক্তির জন্য অধীর মানব জাতি বর্তমান যুগের সংকট থেকে রক্ষা পেতে চায়। এটা স্পষ্ট হযরত ইমাম মাহদী (আঃ) যখন আবির্ভূত হবেন তখন সমস্ত মুক্তি-পাগল মানুষ তাঁকে সাদরে বরণ করে নেবে এবং আলোর অফুরাণ বন্যায় কেটে যাবে জুলুম ও অন্যায়-অবিচারের নিকষ আঁধার। তাই এই মহান ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের পটভূমি তৈরির জন্য মুসলিম দেশগুলোর প্রচার মাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে এবং হযরত ইমাম মাহদী (আঃ)’র পরিচিতি তুলে ধরার জন্যও মুসলমানদেরকে আরো বেশী সক্রিয় হতে হবে।

Comments (0)
Add Comment