ইমাম আলী (আ.)-এর বক্তব্যে বিশ্বজগত

নাহজুল বালাগা একটি সমুদ্রের মতোসেখান থেকে যতোই নেওয়া হোক না কেন,কমবে নাআমরা বিশাল এই সমুদ্র থেকে বিন্দুর মতো খানিকটা আহরণের চেষ্টা করবো

সুন্দর এই বিশ্বজগত আল্লাহর বিচিত্র নিয়ামতে পূর্ণমানুষ এইসব নিয়ামত থেকে উপকৃত হয়আমরা যদি একটু মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো যে,এই বিশ্বকে ঘিরে মানুষের রয়েছে বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা,চাওয়া-পাওয়া এককথায় ব্যাপক আকর্ষণমানুষের ব্যাপক গবেষণার ফলে বিশ্বের সূক্ষ্ম অণূ-পরমাণু আবিস্কৃত হয়েছেএইসব গবেষণায় পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টিতে যে অবিশ্বাস্যরকম শৃঙ্খলা লক্ষ্য করা গেছে তা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে বিশ্ব নিরর্থক সৃষ্টি করা হয় নিআর মানুষকেও খামোখাই পৃথিবীতে পাঠানো হয় নি

আলী (আঃ) বিশ্ব এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আল্লাহর নিদর্শন বলে মনে করেনতিনি বিশ্বাস করেন,পৃথিবীর সব কিছুই মানুষের উপকারে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং মানুষের উচিত প্রকৃতির যথার্থ ব্যবহার করাআল্লাহর অলি-আউলিয়া বা ধর্মীয় মনীষীগণও প্রাকৃতিক সম্পত তথা আল্লাহর নিয়ামতগুলোকে সৎ ও সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেনহযরত আলী (আঃ) চেষ্টা করেছেন পুকুর থেকে পানি তুলে খেজুর বাগান তৈরি করতে যাতে মানুষ সেগুলো থেকে উপকৃত হতে পারেপৃথিবীর সাথে মানুষের সম্পর্ককে আলী (আঃ) তুলনা করেছেন একজন ব্যবসায়ীর সাথে বাজারের সম্পর্ক কিংবা একজন কৃষক এবং কৃষিক্ষেতের সম্পর্কের সাথেএকইভাবে যে ব্যক্তি এই পৃথিবীতে কাজ করবে আখেরাতে তার ফল সে পাবে

আলী (আঃ) এর দৃষ্টিতে পৃথিবীটা ঈমানদারদের জন্যে একটি উত্তম স্থানতিনি মনে করেন দুনিয়া মানুষের জন্যে স্থায়ী কোনো বাসস্থান নয় বরং এটা মানুষের জন্যে একটা ক্রসিং-পয়েন্ট এবং পরিপূর্ণতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে লাফ দেওয়ার মঞ্চ

নাহজুল বালাগায় আলী (আঃ) এর এই দৃষ্টিভঙ্গি কথোপকথনের ভঙ্গিতে এসেছেসেখানে এক ব্যক্তি দুনিয়াকে ধিক্কার দেয় আর আলী (আঃ) তাকে তার ভুল ধরিয়ে দেয়কবি আত্তার এই বিষয়টিকে মুসিবাৎ নমেহ-তে কবিতার মতো করে ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবেঃ

آن يكي در پيش شير دادگر
ذم دنيا كرد بسياري مگر
حيدرش گفتا كه دنيا نيست بد
بد توييزيرا كه دوري از خرد

ন্যায়পরায়ন সিংহ আলীর সামনে সে
পৃথিবীকে দিয়েছে ধিক্কার প্রচুর,তবে
তার হায়দার বলেন পৃথিবী নয় মন্দ
মন্দ তো তুমি, জ্ঞান থেকে দূরে অন্ধ

 হযরত আলী (আঃ) এর দৃষ্টিতে যে ব্যক্তির ঈমান নেই তার জন্যে এই পৃথিবী ভয়াবহ এক নরক যা কেবল তার জন্যে ধ্বংসেরই দ্বার খুলে দেয়এই সমস্যা এমন সময় দেখা দেয় যখন মানুষ পার্থিব এই জগতের মোহে পড়ে যায়মানুষ যদি নিজের ব্যাপারে সতর্ক না হয় এবং এই বিশ্বজগত সম্পর্কে সচেতন না হয়,তাহলে পৃথিবীর সাথে তার সম্পর্ক ভিন্ন রূপ নেবে এবং ক্ষণিকের পথ চলার অঙ্গন এই বিশ্ব তার সামনে ভিন্ন লক্ষ্য তৈরি করবেএরকম অবস্থায় একজন মানুষ পৃথিবীর মোহজালে আটকা পড়ে যায়এই মোহ মানব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেএকেই বলে দুনিয়াপূজা,যার বিরুদ্ধে ইসলাম সংগ্রাম করতে বলেআলী (আঃ) ও মানুষকে এ ব্যাপারে হুশিয়ার করে দিচ্ছেন

আমরা ইমাম আলী (আঃ) এর দৃষ্টিতে পৃথিবীর নেতিবাচক দিকটি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো

আলী (আঃ) পৃথিবীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেনতিনি বলেছেন যে,উপরে ওঠার সিঁড়ি হলো পবিত্রতা,সততা ইত্যাদি গুণাবলিকিন্তু যখনই তিনি পৃথিবীর অসুন্দর রূপ নিয়ে কথা বলেছেন তখনই মনে হয়েছে তিনি যেন এমন কোনো ঘৃণিত শত্রু সম্পর্কে কথা বলছেন যে কিনা মানুষকে সবসময় ধোকা দেয়তিনি পৃথিবীকে এমন এক সাপের সাথে তুলনা দেন,যে সাপ দেখতে বেশ সুন্দর এবং নাদুস নুদুস অথচ তার দাঁতের নিচে আছে মারাত্মক বিষঅন্যত্র তিনি বলেছেন-পৃথিবী তাঁর কাছে এমন একটা পাতার মতো অর্থহীন যার মুখে বসে আছে আস্ত এক ফড়িং কিংবা ছাগলের নাকের পানির মতোই তুচ্ছঘৃণিত এই পৃথিবী এমন এক জগত,যে আল্লাহর কাছ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং মানবিকতাকে ধ্বংস করে দেয়।

আলী (আঃ) এর মতে মানুষ যদি পৃথিবীর মোহে পড়ে যায় তাহলে সে তার উন্নত সকল মূল্যবোধকে হারাতে বসেএ কারণেই তিনি পৃথিবীর নশ্বরতা নিয়ে বারবার কথা বলেছেনহযরত আলী (আঃ) পৃথিবীকে কঠিন ঝড়ের সাথে তুলনা করেন,যেই ঝড় সমুদ্রের বুকের নৌকায় বসবাসকারীদেরকে মুহূর্তের মধ্যে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়,আবার কাউকে কাউকে সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে মারে,কেউবা ঢেউয়ের বুকে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যায় এবং ভবঘুরে বানিয়ে ছেড়ে দেয়

পৃথিবী সম্পর্কে মানুষকে এভাবে ভীতি প্রদর্শন করানোর পর ইমাম আলী (আঃ) আল্লাহর সকল বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেন,তারা যেন সুস্বাস্থ্য এবং সময়-সুযোগকে অমূল্য রতন ভাবে এবং মৃত্যুর বাস্তবতাকে যথার্থভাবে মেনে নিয়ে অতীতের ভুল শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেতিনি বলেন-হে আল্লাহর বান্দাগণ! সাবধান হও! তোমার মুখে ভাষা থাকতে থাকতে,তোমার শরীর সুস্থ থাকতে থাকতে ,শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো খেদমতের জন্যে প্রস্তুত থাকতে থাকতে এবং ফিরে আসার পথ উন্মুক্ত থাকতে থাকতে সাবধান হও! সুযোগ এবং সামর্থ হারাবার আগেভাগেই হুশিয়ার হও! অনিবার্য মৃত্যুর দূত তোমার দরোজায় টোকা দেওয়ার আগে ভাগেই হুশিয়ার হও!
ইমাম আলী (আঃ) বোঝাতে চেয়েছেন যে শারিরীক সামর্থ থাকতে থাকতেই আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগি বেশি বেশি করে নাও! যে-কোনো সময় মৃত্যু এসে যেতে পারে কিংবা বার্ধক্যের সময় ইচ্ছা থাকলেও ইবাদাত বন্দেগি যৌবনকালের মতো করা সম্ভব হয় না

দুনিয়ার চাকচিক্য এমন যে এই মোহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্যে একটা শক্তির প্রয়োজন হয় যে শক্তি মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং ইচ্ছাশক্তি বৃদ্ধি করেসেইসাথে এই শক্তি পৃথিবীকে নশ্বর হিসেবে সবসময় সামনে তুলে ধরে আর অবিনশ্বর পারলৌকিক জীবনের দিকে নিয়ে যায় এবং এভাবে নিজের সত্যিকারের সৌভাগ্য নিশ্চিত করেইমাম আলী (আঃ) পরহেজগারী এবং খোদাভীতিকেই এই শক্তি তথা মানুষের ভাগ্য নিয়ন্তা বলে বোঝাতে চেয়েছেনযারা নিজেদেরকে আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে রজ্জুবদ্ধ করেছে এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টিজগতের বাস্তবতার দিকে অগ্রসর হয়েছে তাদের ব্যাপারে সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে যে-আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পরকালের শেষ বিচারের দিন কঠিন মুসবতের সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সহযোগী হবেন। (সূত্র:ইসলাম শিয়া)

Comments (0)
Add Comment