পুত্রের প্রতি পিতার নির্দেশিকাপত্র

মুয়াবিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সিফ্‌ফীন প্রানে- সংঘঠিত যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে (৬১৭ খ্রী.) হাযিরিন [সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী স্থানের একটি গ্রাম] নামক স্থানে ক্যাম্প করার পর এ পত্রটি ইমাম হাসান (আ.)-এর উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন।
মানব ও পার্থিব ঘটনাবলী
এ পত্র এমন পিতার, যিনি সহসাই মৃত্যুবরণ করবেন, যিনি সময়ের কষ্টের সারবত্তা স্বীকার করেন যিনি জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, যিনি সময়ের দূর্দশার কাছে নিজেকে সর্ম্পণ করেছেন, যিনি পরলোকগামীদের আবাসস্থলে বাস করছেন এবং যিনি যেকোন দিন পৃথিবী থেকে প্রস্থানের অপেক্ষায় আছেন। এমন পুত্রের প্রতি, যিনি যা অর্জন করতে পারেন নি তা পাবার আকুল আকাঙ্খা করেন, যিনি পদচারণা করছেন তাদের পথে যারা মারা গেছে, যিনি দুনিয়ার ব্যধিসমূহের শিকার, যিনি যুগের গন্ডিভুক্ত, যিনি দুর্দশার লক্ষ্য, যিনি দুনিয়ার বঞ্চনার শিকার, যিনি প্রতারণাময় পার্থিব সামগ্রীর সম্মুখে, যিনি পতনশীলদের প্রতীক, যিনি মৃত্যুর হাতে বন্দি,  যিনি কষ্টে জড়িত, যিনি দুঃখের সহবাসি, যিনি শোক ও তাপে আক্রান্ত , যিনি কামনা-বাসনার তীরে জর্জরিত এবং মৃতদের উত্তরসূরী।
সকল প্রশংসা একমাত্র মহান প্রতিপালকের; তারপর এদুনিয়াকে আমার কাছ থেকে বিতাড়িত করে [আমি যা শিখতে পেরেছি এখন তুমি তা জেনে রাখো] আমার উপর সময়ের আক্রমণ ও আমার প্রতি পরকালের আগমনই আমার নিজকে ছাড়া অন্য কাউকে স্মরণ করা থেকে বিরত রেখেছে এবং আমার সকল মনযোগকে পরকালমুখী করে রেখেছে। ফলে এই আত্মচিন্তায় মগ্নতা নিজ ব্যতীত অন্য সবকিছু থেকে আমাকে ফিরিয়ে রেখেছে, অন্যদের প্রতি মশগুল হওয়া থেকে আমার মনযোগকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আর আমাকে আমার কামনা-বাসনা অনুগামী হওয়া থেকে রক্ষা করেছে এবং প্রতিটি কর্মের প্রকৃতরূপ আমার কাছে উম্মোচিত হয়েছে। তাই আমাকে এমন পথে পরিচালিত করেছে যা ছেলেমি খেলা নয়। আমাকে এমন এক বাস্তবতায় উত্তীর্ণ করেছে যেখানে সকল মিথ্যা ও কলুষতার পথ রূদ্ধ।  এখানে আমি তোমাকে আমার জীবনের অংশ হিসাবে দেখেছি বরং তুমি আমার পূর্ণজীবন। তাই তোমার ওপর আঘাত হলে মনে হয় যেন আমার ওপর সে আঘাত পতিত হয়েছে এবং যদি তোমার কাছে মৃত্যু আসে তবে মনে হয় যেন  সে আমার জীবনকে ছিনিয়ে নিয়েছে। সুতরাং তোমার কাজকর্ম আমার নিজের বলে মনে করেছি যেমন করে আমার বিষয়াবলী আমার বলে মনে হয়। তাই আমি  এচিঠিটি তোমাকে লিখছি যাতে তুমি দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কঠিন মূহুর্তে পথনির্দেশনা দিবে, আমি বেঁচে থাকি আর না থাকি।
আত্মশুদ্ধির বিভিন্ন স্তর
হে আমার পুত্র, আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি আল্লাহকে ভয় করতে এবং সর্বদা তাঁর আদেশ মেনে চলতে, তাঁর স্মরণে তোমার হৃদয়কে জীবিত রাখতে এবং তাঁর রজ্জুকে শক্ত করে ধরতে। আল্লাহ্‌ও তোমার মধ্যকার সম্পর্কের মত এতখানি বিশ্বস্ত মাধ্যম আর কোনটি আছে, যদি তুমি তা ধরে রাখ? উপদেশ দ্বারা, তোমার হৃদয়কে উজ্জীবিত কর এবং অবৈধ কর্মের  প্রতি বিমুখ হয়ে তোমার কামনা-বাসনাকে মেরে ফেলো, তোমার জীবনকে দৃঢ় ঈমান দ্বারা শক্তিশালী কর, প্রজ্ঞার আলো দ্বারা জ্যোতি দান কর, মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে এটাকে অবদমিত কর, তার থেকে পতন হওয়ার স্বীকারোক্তি গ্রহণ কর, দুনিয়ার দুর্যোগময় পরিবর্তন পর্যালোচনা করে তাকে জ্ঞান দান কর এবং কালের কর্তৃত্বে দিবা ও রাত্রির পরিবর্তন ও নেতিবাচক ঘটনাসমূহ দেখিয়ে তাকে ভীত কর।
অতীত লোকদের ঘটনাবলী তার কাছে উপস্থাপন কর, এবং অতীতগামী লোকদের জীবনে কি নিপাতিত হয়েছিলো তা তাকে স্মরণ করিয়ে দাও, অতীতগামী লোকদের শহরে ভ্রমণ কর এবং তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃত্তিসমূহ পর্যাবেক্ষণ কর,  ভেবে দেখ তারা কী করেছিল, কী রেখে চলে গেছে, তারা কোত্থেকে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং কোথায় অবতরণ করেছে?
তুমি দেখবে তারা বন্ধু-বান্ধব সব রেখে নিঃসঙ্গের চরাচরে চলে গেছে। সহসাই তুমিও তাদের মতো চলে যাবে ! সুতরাং তোমার ভবিষ্যত অবস্থানের জায়গাকে সুসজ্জিত কর। দুনিয়ার কাছে পরকালের  জীবনকে বিক্রি করো না, যা তুমি জান না সে বিষয়ে কথা বলা পরিহার করো এবং যে বিষয়ে তোমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি সে বিষয়ে কথা বলো না। যে পথে গেলে পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে সেপথ থেকে দূরে থেকো। কেননা, পথহারা ও দিশাহারা অবস্থায় পথ চলা থেকে বিরত থাকা, ধ্বংস ও পতনে নিপাতিত হওয়া থেকে উত্তম।
(নাহজুল বালাগার ৩১ নম্বর পত্র)

Comments (0)
Add Comment