ইসলামী আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মহান নেতার ভূমিকা

অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো, নবী-রাসুলসহ মুমিনদের একটি অন্যতম দায়িত্বআর ইহ ও পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিত করতে ন্যায়ের পথে চলা ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেইবিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-র প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন (আঃ)-ও সর্বদা ন্যায়ের পথে চলেছেন, কখনোই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননিকিন্তু একজন মুমিন শুধু নিজেই ন্যায় ও সত্যের পথে চলেন না, পাশাপাশি সমাজকেও সত্যের পথে পরিচালিত করতে সচেষ্ট হনআর ইমাম হোসেন (আঃ)-তো সাধারণ কোন মুসলমান নন, তিনি আহলে বাইতের মহান ইমাম, মুমিনদের নেতা সমাজকে সঠিক পথ প্রদর্শনের গুরু দায়িত্ব তার উপর অর্পিত
দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-র ওফাতের বা ইন্তেকালের পর অজ্ঞতার অন্ধকার ক্রমেই মুসলিম সমাজকে গ্রাস করছিলপ্রকৃত ইসলাম ধীরে ধীরে সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিলমানুষ নামাজ আদায় করার জন্য দিনে কয়েকবার মসজিদে যেত কিন্তু আল্লাহর সঠিক ইবাদতের প্রকৃত রহস্য সম্পর্কে তারা ছিল অসচেতন সারাক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করতো, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতো না

 

ইসলামের প্রকৃত আদর্শ, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিলধর্মীয় মুল্যবোধ ও চিন্তা-চেতনা প্রায় ভুলুন্ঠিতগোষ্ঠী প্রীতি ও সম্পদের প্রতি লালসা ধর্মের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিলশাসক শ্রেণী ক্রমেই দুর্নীতিপরায়ন ও জুলুমবাজে পরিণত হচ্ছিলধর্মহীন ও কপট ব্যক্তিরা সমাজে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে থাকেস্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের মতো করে ইসলাম ধর্ম ব্যাখ্যা করছিলএর ফলে সমাজ জীবনে প্রকৃত ইসলামের প্রভাব নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছিলআর অধিকাংশ মানুষ আস্তে আস্তে বিভ্রান্তিকর এ পরিস্থিতির সাথে অভ্যন্ত হয়ে এটাকেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি হিসেবে মেনে নিচ্ছিলকারোরই যেন কোন প্রতিক্রিয়া নেইআর এজিদের শাসনামলে ধর্মহীন তপরতা চরমে উঠে অবস্থায় ইমাম হোসেন (আঃ) জনগণকে সজাগ ও সচেতন করে তোলার চেষ্টা করলেন সবাইকে আল্লাহ ও রাসূলের পথে ফিরে আসার আহ্বান জানালেনসমাজের প্রভাবশালীদের কাছে চিঠি লিখে এ পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানালেন কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হলো না

শুধুমাত্র প্রচার কাজ বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ঘুমিয়ে পড়া মুসলিম উম্মাহকে জাগিয়ে তোলা তখন সম্ভব ছিল নাকালীন দুর্নীতিবাজ ও কপট শাসকগোষ্ঠির বিরুদ্ধে ব্যাপকভিত্তিক সংগ্রামই ছিল সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ, কাজেই ইমাম সংগ্রামের পথ বেছে নিলেনইমাম হোসেন (আঃ)-এর লক্ষ্য ছিল উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির স্বরূপ উন্মোচন করে মানুষের অন্তরাত্মা ও বিবেককে জাগিয়ে তোলা, প্রকৃত ইসলামী আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাসেই স্পর্শকাতর সময়ে এটিই ছিল ইমামের জন্য সবচেয়ে বড় দায়িত্বএ কারণে তিনি হজ্বের গুরুত্বপূর্ণ আনুষ্ঠানিকতা অর্ধসমাপ্ত রেখে কুফার পানে ছুটলেনপথিমধ্যে দেখা হলো কালীন প্রখ্যাত কবি ফারাযদাকের সাথেতিনি ফারাযদাককে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, বর্তমান সমাজ আল্লার প্রতি আনুগত্য থেকে দূরে সরে এসে শয়তানের পথ অনুসরণ করছেঅনাচার ও দুর্নীতি করছেনি:স্ব ও দরিদ্রদের সম্পদ কুক্ষিগত করছেকাজেই ইসলামী মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও জিহাদ করতে হবেকবি ফারাযদাকের উদ্দেশ্যে দেয়া ইমাম হোসেন (আঃ)-র ঐ বক্তব্য থেকে তকালীন সমাজের দূরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে

ইমাম হোসাইন (আ) তার সংগ্রাম তথা আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করেছিলেনতিনি বলেছিলেন, আমার আন্দোলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করা, আমি চাই সমাজে কোরআন ও সুন্নাহর সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে, যা আজ শাসক গোষ্ঠির হাতে উপেক্ষিত এবং অনিরাপদ হয়ে পড়েছে এই আন্দোলনের প্রথম দিকে কুফা ও অন্যান্য এলাকার কিছু মানুষ ইমাম হোসাইন (আ) এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল, কিন্তু প্রশাসনের প্রচন্ড চাপের মুখে এক পর্যায়ে তার তাদের আনুগত্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হয় আবার অনেকেই পার্থিব স্বার্থে বা ঈমানী দুর্বলতার কারণে ইমামের আন্দোলনের সাথে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকেআবার একদল মুসলমান আন্দোলনে না গিয়ে ঘরে বসে ইমাম হোসাইন(আঃ)-র জন্য দোয়া করাকেই নিজেদের কর্তব্য মনে করেছিলকিন্তু ইমাম হোসেন(আঃ) তার আন্দোলন ও সংগ্রামের কোন পর্যায়েই কপটতার আশ্রয় নেননি এবং নিজেও কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগেননিঐশী ধর্ম ইসলামের আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে মানুষের জন্য ইহ ও পরকালীন কল্যাণ নিশ্চিত করাই ছিল তার আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য

কোনো আন্দোলন যদি আদর্শ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভিত্তিক হয় তাহলে তার বিজয় অবসম্ভাবীকখনো কখনো সাময়িক বিজয় অর্জিত না হলেও চূড়ান্ত বিজয় আসবেইইমাম হোসেন(আঃ)-ও তার লক্ষ্যে উপনীত হবার মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছেনতিনি মক্কা থেকে কারবালা যাবার পথে বিভিন্ন ভাষণে সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, আমার যাত্রার উদ্দেশ্য হলো কপট উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মাচন করা, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং সকাজের আদেশ ও অস কাজের নিষেধ করাআল-কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মুহাম্মাদী দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করা ছাড়া আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেইতিনি তার কারবালায় নিজের জীবন উসর্গ করার মাধ্যমে ইসলামের ধারক-বাহক সেজে বসা কপট ও ভন্ড উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন ইমামের আন্দোলন ও আত্মত্যাগ ইসলামকে কুসংস্কার ও বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে নতুন জীবন দিয়েছেফলে উন্মোচিত হয়েছে নয়া দিগন্তেরকারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনার পর দীর্ঘ তেরো শতাব্দিরও বেশি অতিবাহিত হলেও মুসলমানদের মন থেকে ঐ ঘটনার প্রভাব মুছে যায়নিইমাম হোসেন(আঃ)-র শাহাদাতের ঘটনা আজও মানব সমাজকে সত্যের পথে সংগ্রামে উসাহ ও প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে

ইমাম হোসেন (আঃ) তার জীবন দিয়ে সবার সামনে এটা স্পষ্ট করে গেছেন যে, সমাজে যখনই জুলুম,নির্যাতন, অনাচার প্রাধান্য বিস্তার করবে এবং ন্যায় ও সত্যের আলোকে নিভিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলবে তখন প্রকৃত মুসলমানদের চুপ করে বসে থাকলে চলবে নাধর্মীয় আদর্শ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হতে হবে এবং প্রয়োজনে ধর্মের পথে জীবন উসর্গ করতে হবেমুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন না হবারও শিক্ষা দিয়ে গেছেন ইমাম হোসেন(আঃ)আমরা ইমাম হোসেন(আঃ) শিক্ষা ও আদর্শকে অনুসরণ করে ইহ ও পরকালীন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবো, এ প্রত্যাশা রইল

 

Comments (0)
Add Comment